মুন্সিগঞ্জ, ২৬ মার্চ ২০২৫, নিজস্ব প্রতিনিধি (আমার বিক্রমপুর)
সূর্যোদয়ের সাথে সাথে মুন্সিগঞ্জ পৌরসভা চত্বরে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে মুন্সিগঞ্জে শুরু হয়েছে ৫৪তম স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের সরকারি কর্মসূচি।
পরে কাচারি এলাকায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিফলকে আনুষ্ঠানিকভাবে জেলা প্রশাসনের শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনের মধ্য দিয়ে সেখানে বীর মুক্তিযোদ্ধা, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা পুস্পস্তবক অর্পণ করেন।
সকাল সাড়ে ৮টার দিকে শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান স্টেডিয়ামে আনুষ্ঠানিক পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণে প্যারেড, কুচকাওয়াজ ও ডিসপ্লে। এসময় সালাম গ্রহণ করেন জেলা প্রশাসক ফাতেমা তুল জান্নাত ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শামসুল আলম সরকার।
সকাল ১১টায় জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আলোচনা সভা ও সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
এছাড়া বাদ যোহর জেলার সকল মসজিদ, মন্দির, গীর্জা ও অন্যান্য উপসনালয়ে জাতির শান্তি, সমৃদ্ধি, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর উদযাপনে বাংলাদেশ
পাকিস্তানি শোষণ-বঞ্চনার শৃঙ্খল ভেঙে লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়ে স্বাধীন স্বদেশ বিনির্মাণের ৫৪তম বার্ষিকীতে পৌঁছেছে বাংলাদেশ।
চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের পথ ধরে তরুণ প্রজন্ম এখন স্বপ্ন দেখছে ‘বৈষম্যহীন’ নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের; বুধবার স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে ঝরছে সেই পথে দৃঢ় থাকার প্রত্যয়।
পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার দিন উদযাপনে লাল-সবুজের বর্ণিল সাজে সেজেছে গোটা দেশ; মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণ নিয়ে স্বাধীনতার আনন্দক্ষণ উদযাপনে বাংলাদেশ প্রস্তুত।
স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
বাণীতে বৈষম্য ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে নিজ নিজ অবস্থান থেকে আরও বেশি অবদান রাখার আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন।
তিনি বলেন, “দেশ ও জাতিকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে আরো এগিয়ে নিয়ে যাই, বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াক এক নতুন বাংলাদেশ-মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে এই আমার প্রত্যাশা।”
বাণীতে দেশে ও প্রবাসে বসবাসরত সব বাংলাদেশিকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়ে দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করেন রাষ্ট্রপ্রধান।
মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, “স্বাধীনতার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার পাশাপাশি পরমতসহিষ্ণুতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন সুসংহত করতে হবে। রাষ্ট্র ও সমাজের সকল ক্ষেত্রে সাম্য, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
“জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে তরুণ প্রজন্ম আমাদের স্বাধীনতার অপূর্ণ স্বপ্নগুলো পূরণে আবারো বুকের তাজা রক্ত দিয়ে গেছে। নতুন প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ, সুখী, সুন্দর ও উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা আমাদের পবিত্র কর্তব্য।”
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে দেওয়া বাণীতে এ মাহেন্দ্রক্ষণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে দেশের উন্নয়ন, শান্তি এবং সমৃদ্ধির পথে কাজের শপথ করার আহ্বান জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, “স্বাধীনতা অর্জন ছিল আমাদের আত্মমর্যাদা, অস্তিত্ব রক্ষা এবং অধিকার আদায়ের দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের চূড়ান্ত ধাপ। যে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়ায়, তার আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়েছিল আজকের এই দিনে।
“আমি সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহীদদের, যাদের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।”
বাংলাদেশের নতুন বাস্তবতায় এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, “গত ১৬ বছর দেশের মানুষ এই স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারে নাই। স্বৈরাচারী শাসক জগদ্দল পাথরের মত জনগণের ঘাড়ে চেপে বসে তাদের স্বাধীনতা ও মৌলিক সব অধিকার কেড়ে নিয়েছিল। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার সফল গণ-অভ্যুত্থান দেশের মানুষকে স্বৈরাচারের রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করেছে।
“অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশকে আরও উন্নত ও শক্তিশালী করতে এবং স্বাধীনতার পূর্ণ সুফল জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর। রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে সুশাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, জনমুখী ও টেকসই উন্নয়ন এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।”
তেইশ বছরের শোষণ থেকে বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের শ্বাসরোধ করতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এ দেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের সেই অভিযানে কালরাতের প্রথম প্রহরে ঢাকায় চালানো হয় গণহত্যা।
২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। তৎকালীন সীমান্তরক্ষী বাহিনী ইপিআরের বেতারে তার এই ঘোষণা প্রচারিত হয়।
এরপর নয় মাসের যুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান, আড়াই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি এবং জাতির অসামান্য ত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে।
একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে নিহতদের স্মরণে জাতীয়ভাবে মঙ্গলবার ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালন করেছে বাংলাদেশ। কালরাত স্মরণে এক মিনিট বাতি নিভিয়ে রাখার মত আয়োজনও ছিল।
সেই রাত পেরিয়ে বুধবার স্বাধীনতা দিবসে বাঙালি জাতি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের।
স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সাধারণ ছুটির দিনে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা আয়োজনে পালিত হবে গৌরবের দিনটি।
এবার এমন এক সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৪তম বার্ষিকী উদযাপন হচ্ছে, যখন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে মাঠের রাজনীতিতে নেই।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের শাসনাবসানের পর দেশ চালাচ্ছে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
ক্ষমতাচ্যুত হয়ে গত ৫ অগাস্ট ভারতে পালিয়ে গিয়ে এখনও সেখানে অবস্থান করছেন শেখ হাসিনা; মাঠে নেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
জুলাই-অগাস্টে আন্দোলনকারীদের উপর ‘গণহত্যা’ চালানোর অভিযোগে শেখ হাসিনা ও তার দলের নেতাকর্মীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এর মধ্যে শেখ হাসিনার ‘স্বৈরশাসন’ পেরিয়ে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে ইউনূস সরকার।