মুন্সিগঞ্জ, ৬ আগস্ট ২০২৪, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)
মুন্সিগঞ্জ আওয়ামী লীগকে দীর্ঘ বছর ধরে একই পরিবারে কুক্ষিগত করে রাখা প্রতাপশালী পরিবারটিতে ছন্দ পতন হয়েছে। বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধুর জীবনের শেষ সময়কালের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, তার পুত্র সদ্য বিলুপ্ত মুন্সিগঞ্জ ৩ আসনের সংসদ সদস্য (সাবেক) ফয়সাল বিপ্লব ও তার স্ত্রী মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র চৌধুরী ফাহরিয়া আফরিন এবং মহিউদ্দিনের আপন ছোট ভাই সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আনিস উজ্জামান।
জেলা পরিষদ, মুন্সিগঞ্জ পৌরসভা, সদর উপজেলা, জেলা আওয়ামী লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, জেলা যুবলীগ, সর্বশেষ জাতীয় সংসদের আসন মুন্সিগঞ্জে সবই ছিলো এই এক পরিবারের দখলে।
সোমবার দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও দেশ ছাড়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর মুন্সিগঞ্জ শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিজয় মিছিল বের হয়। এসময় বিক্ষুদ্ধ জনতার মিছিল থেকে আগুন দেয়া হয় এই পরিবারের প্রাসাদ হিসেবে পরিচিত মধ্য কোটগাও এলাকার বাড়িতে। বিপ্লবের পিতা মহিউদ্দিন তার দ্বিতীয় স্ত্রী সোহানা তাহমিনাকে নিয়ে থাকতেন শহরের কাচারি এলাকায় গড়ে তোলা বহুতল ভবনে। তাকেও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বানান মহিউদ্দিন।
পালানোর আগ পর্যন্ত মহিউদ্দিন যে বাসায় ছিলেন সেই ভবনটি সরকারি অকৃষি খাস জমির উপর নির্মিত। বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে ২০১৫ সালে এক হাজার ১ টাকার বিনিময়ে ৬ শতাংশ জমি ‘দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত’ পান তিনি। ওই জমির উপরে নির্মাণ করেন ৬তলা বিশিষ্ট ‘মলুদা কমপ্লেক্স’। পুরো ভবন ভাড়ায় দিয়ে নিচ তলায় ছোট একটি কোনায় বানান জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়। একসাথে ৫০ জনও বসা যায় না সেখানে।
২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের আগস্ট ৫ তারিখ পর্যন্ত টানা ১৫ বছর আওয়ামীটি লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন দলটিকে নিজেদের পরিবারের স্বার্থে ব্যবহারের জন্য যা কিছু দরকার ছিলো সবই করা হয়েছে এই পরিবারটির পক্ষ হতে। এর বাইরে কেউ সুবিধা করে বেশিদিন টিকে থাকতে পারেনি মুন্সিগঞ্জে। এমনকি স্বাধীন সাংবাদিকতায় হস্তক্ষেপের ঘটনা ছিলো নিয়মিত।
মহিউদ্দিন নামা
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর ওই সময়ের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী মহিউদ্দিন আসলে কোথায় ছিলেন সে প্রশ্ন নিয়ে বিভিন্ন সময় আক্ষেপ ছিলো মুজিব কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার। সর্বসমক্ষে সেটি প্রকাশ না করলেও বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী খন্দকার মোস্তাকের সাথে মহিউদ্দিন আহমেদের ৭৫ পরবর্তী ঘনিষ্ঠতার কথা অনেক গোয়েন্দা সংস্থাই শেখ হাসিনাকে জানিয়েছিলেন। দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কাছে সে কথা প্রায়ই বলতেন হাসিনা।
মহিউদ্দিন আহমেদের আদি নিবাস সদর উপজেলার বাংলাবাজার ইউনিয়নের কাইজ্জার চর গ্রামে। তার পিতা ওসমান গণি মুক্তিযুদ্ধের সময় শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। সেই সূত্রে অনেকেই মহিউদ্দিনকে ‘রাজাকারপুত্র’ নামে ডাকতেন।
সামান্য স্বার্থের দ্বন্দে আপন ভাতিজা তাসলিমুজ্জামান তাপসকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যার দায়ে জেলে যেতেও হয়েছিলো মহিউদ্দিনকে। ২০০৭ সালে আলোচিত এক-এগারোর সময় শীর্ষ ৫০ দুর্নীতিবাজের একজন চিহ্নিত হন মহিউদ্দিন। সেসময়ও দীর্ঘদিন পলাতক থাকেন তিনি।
৪ বছরের মাথায় ২০১১ সালে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হন তিনি। এরপর আর ‘বিমুখ’ হননি। জেলা পরিষদ মহিউদ্দিনের দখলে আছে টানা ১৩ বছর। আইন অনুযায়ী তিনি থাকবেন আরও দুই বছর। তবে আগেরমত দাপুটে ভাব যে দেখাতে পারবেন না তা একেবারেই নিশ্চিত।
অভিযোগ আছে, জেলা আওয়ামী লীগের ‘আজীবন’ সভাপতি খ্যাত মহিউদ্দিন আওয়ামী লীগের টানা শাসনামালে পদ ও নৌকা মার্কা নিয়ে বাণিজ্য করে কামিয়েছেন কয়েক শ কোটি টাকা। দলের ত্যাগী কর্মীদের মূল্যায়ন না করার অভিযোগে ২০২২ সালে শ্রীনগর উপজেলার হাঁসাড়া ইউনিয়ন কমিটি করতে গিয়ে হাঁসাড়া কালী কিশোর স্কুল এন্ড কলেজ মাঠে জনরোষের মুখে পড়ে মারধরের শিকার হন তিনি।
৭ মাসের এমপি মাদকাসক্ত ‘দরবেশ বাবা’
টানা ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা অনিচ্ছা সত্ত্বেও গণঅভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে যাওয়ার মুখে যে নতুন জাগরণের সৃষ্টি হয়েছে তাতে ছন্দপতন হয়েছে মহিউদ্দিন পরিবারের। সংসদ সদস্য পদ গেছে পরিবারের ‘রাজপুত্র’ ও ‘দরবেশ বাবা’ খ্যাত ফয়সাল বিপ্লবের। অতিরিক্ত মাদকাসক্তির কারনে যিনি দীর্ঘদিন নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
মুন্সিগঞ্জ পৌরসভায় দুইবারের মেয়র ছিলেন এই বিপ্লব। মেয়াদকালে টেন্ডারবিহীন-লুটপাটের অভয়ারণ্যে পরিণত করেন পৌরসভা কার্যালয়টিকে। নিজের পছন্দমত ছাত্রলীগ নেতাদের বাইরে কাজ পাননি কেউই। এ থেকেও বিপ্লবকে দিতে হয়েছে কমিশন।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার ফর্মুলায় নিজ দলের প্রার্থী মৃণাল কান্তি দাসের বিরুদ্ধে কাঁচি প্রতীক নিয়ে ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ হন বিপ্লব। ব্যাপক বলপ্রয়োগ-সংঘাত ও হত্যার মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হন তিনি। নির্বাচনের পরও নিজ দলের প্রতিদ্বন্দী নেতাকর্মীদের উপর চালান নির্মম প্রতিশোধ। কিন্তু ৭ মাস না পেরোতেই সরকার পতনের মুখে গদি হারান বিপ্লব। নিমিষেই শেষ হয়ে যায় তার সকল দম্ভ, হিংসা, অহংকার। বিপ্লবকে এমপি বানাতে যারা বিনিয়োগ করেছিলেন এখন চরম আফসোসে রয়েছেন তারা।
প্রেম থেকে প্রণয়, তারও লাগবে ক্ষমতা
একসময় সঙ্গীতকে খুব ভালোবাসতেন আফরিন। এরপর পরিচয় তরুণ যুবক বিপ্লবের সাথে। প্রেম থেকে প্রণয়। কিন্তু তারও লাগবে ক্ষমতা। বিপ্লবের মা ফজিলাতুন নেসা মহিউদ্দিন যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তার সামনে দাড়িয়ে ঠিকমতো কথাও বলতে সাহস পেতেন না এই আফরিন। অথচ মহিউদ্দিন তার দ্বিতীয় স্ত্রী সোহানাকে নিয়ে আলাদা সংসারে চলে গেলে বিপ্লবকে কথায় কথায় উঠতে-বসতে বাধ্য করেন আফরিন। তার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত থেকে শুরু করে প্রশাসন-সাংবাদিক ম্যানেজ সব দায়িত্ব পালন করতে থাকেন তিনি।
বিপ্লবের স্ত্রী চৌধুরী ফাহরিয়া আফরিন চলতি বছরের মার্চে উপ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মুন্সিগঞ্জ পৌরসভায় মেয়র নির্বাচিত হলেও তার মেয়াদকাল বাকি রয়েছে ১৬ মাস। এর মধ্যে ফিরে এলেও ভস্মীভূত পৌর কার্যালয় সংস্কারেই সময় চলে যাবে তার। খুব একটা সুবিধা করতে পারবেন না তিনি।
আতঙ্কের নাম-আনিসের দুই পুত্র
মহিউদ্দিন পরিবারের আরেক সদস্য আনিস উজ্জামান। তিনি মহিউদ্দিনের ছোট ভাই। চতুর্থবারের মত ক্ষমতায় বসে আছেন মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলায়।
সাদামাটা চলাফেরায় তার সুনাম থাকলেও তার দুই পুত্র আক্তারুজ্জামান রাজিব ও রাজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি লুটপাট, জমি দখল, মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, অস্ত্রবাজির অভিযোগ রয়েছে অসংখ্য। রাজিব টানা ১৯ বছর ছিলেন যুবলীগের দায়িত্বে। কোন কোন কমিটির বিনিময়ে ৫০ লাখ-১ কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুষও নিয়েছেন তিনি। এছাড়া সদর উপজেলা পরিষদের সকল টেন্ডারের একচ্ছত্র আধিপত্যও ছিলো এই দুই ভাইয়ের নিয়ন্ত্রণে। তৃণমূল নেতাকর্মীদের জন্য মহিলা আওয়ামী লীগটিকেও উন্মুক্ত রাখেনি এই পরিবার। রাজন-রাজিবের মা অর্থাৎ আনিস উজ্জামানের স্ত্রী তহুরা জামানও দখল করেছেন জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ।
সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে আনিসের ভাতিজা বিপ্লব এমপি হলে ‘নৌকার সমর্থন’ করায় অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পড়েন আনিস। এর ৪ মাস পরই উপজেলা নির্বাচন চলে এলে অবিশ্বাস্যভাবে নিজের তুলনায় বয়সে অনেক ছোট ভাতিজা বিপ্লবের কাছে রাজনৈতিক আত্মসমর্পণ করতে হয় আনিসকে। বিপ্লবের আস্থা অর্জনে ব্যানারে নিজের বড় ভাই এবং রাজনীতিতে সিনিয়র মহিউদ্দিনের চেয়েও বড় ছবি লাগাতে হয় আনিসকে। বিপ্লব মদিনা শরীফ ছুয়ে আফসারউদ্দিন ভুইয়াকে চেয়ারম্যান বানানোর শপথ করলেও সেই জায়গা থেকে পরে সরে আসেন পরিবারের চাপে। মনোনয়ন বাতিল-পুনরায় বহাল নানা নাটকীয়তার পর বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় নির্বাচিত হয়ে যান আনিস উজ্জামান।
বিভিন্ন সময়ে এই মহিউদ্দিন পরিবারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) একাধিক অভিযোগ পড়লেও চাপে থাকা সংস্থাটি স্বাধীনভাবে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ পায়নি কখনো।