মুন্সিগঞ্জ, ৯ মে ২০২৫, ডেস্ক রিপোর্ট (আমার বিক্রমপুর)
আজ ৯ মে গজারিয়া গণহত্যা দিবস। মুন্সিগঞ্জের গজারিয়াবাসীর জন্য শোকাবহ দিন আজ। এই দিনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী গজারিয়ার ইসমানিরচর, গোসাইরচরসহ ১০ গ্রামের ৩৬০ নিরপরাধ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করে।
দিনটি উপলক্ষে শুক্রবার বাদ জুমা উপজেলার গোসাইর চর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে বিশেষ দোয়া ও শোক র্যালী করেছে ‘গজারিয়া ইউনিয়ন শহীদ পরিবার কল্যাণ পরিষদ’।
নিচের পুরো লেখাটি লিখেছেন- সাংবাদিক শাহনাজ শারমীন।
৯ মে ১৯৭১, রোববার ভোর। আগের দিন ঈদে মিলাদুন্নবীর মিলাদ তবারক বিতরণ নামাজ পড়ে মানুষ গভীর ঘুমে। হঠাৎ গুলির শব্দ আর নারী-পুরুষ-শিশুর আর্তচিৎকার। পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে বেলুচ রেজিমেন্টের ১০০ জন আর্মির হাতে গজারিয়ার ১০ গ্রামে ৩৬০ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়, অত্যাচারিত হয় অসংখ্য নারী।
ধর্ষণ, লুটতরাজ ও আগুন, সব মিলিয়ে এক ভয়াল দিন ছিল ৯ মে ১৯৭১। আর ১২ মে ইসলামাবাদে পাঠানো ঢাকার ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনের টেলিগ্রামে বলছে ৫০০ জনের গণহত্যা চালানো হয়েছিলো। গণহত্যা গজারিয়া বইয়ের লেখক গবেষক শাহাদাত পারভেজ জানালেন, মাত্র ১৩০ জনের পরিচয় শনাক্ত করা গেছে।
মেঘনার পাড়ে মুন্সিগঞ্জের ছয়টি উপজেলার একটি গজারিয়া। ১৯৭১ সালের চার মে গজারিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থানীয় যুবকরা জরুরি সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের জন্য। আট মে সন্ধ্যায় গজারিয়া অগ্নিবীণা সমিতির কার্যালয় আরেকটি সভা হয় রাত অব্দি।
এরপরের দিন চারদিকে ভোরের নিস্তব্ধতায় হঠাৎ গুলির শব্দ। হানাদার বাহিনীর একটি দোতলা লঞ্চের দুটি গান বোট গভীর রাতে গজারিয়া মেঘনা নদীতে ভেড়ে। তার আগে থানা আক্রমণ করে দখলে নেয়। গজারিয়ার মেঘনার শাখা নদী ফুলদী তীরের ১০ গ্রাম গোসাইরচর, নয়নগর, বালুরচর, বাঁশগাঁও জেলেপাড়া, ফুলদী, নাগের চর, কলসেরকান্দি, দড়িকান্দি ও গজারিয়া গ্রামে চালায় হত্যা নির্যাতন লুটপাট। ভেঙে ফেলা হয় সব বাড়ির ট্রানজিস্টার, যেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শুনতে না পারে কেউ।
১২ মে ঢাকার ডেপুটি হাই কমিশন থেকে কে. ডব্লিউ. হ্যাজেল ইসলামাবাদের ব্রিটিশ হাই কমিশনের কূটনৈতিক এ. এ. হ্যালিলিকে পাঠানো দুই পৃষ্ঠার গোপনীয় এ টেলিগ্রাম বার্তায় ১০টি ঘটনার বর্ণনা করা হয়। এর মধ্যে দুই নম্বর ভুক্তিতে গজারিয়া গণহত্যার বর্ণনা দিয়ে বলা হয়, ‘৯ মে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকা শহরের কাছে অবস্থিত গজারিয়া থানার চারটি গ্রামে অভিযান চালিয়ে তাদের মাটিতে গুঁড়িয়ে দেয় এবং বিপুল সংখ্যক মানুষকে হত্যা করে, সেটিও প্রায় ৫০০ জনের বেশি। ৬ মে গজারিয়া পুলিশ স্টেশনের কাছে মুক্তিবাহিনীর এক বৈঠকের খবর শুনে সেনাবাহিনী এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়। গজারিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ ও সেকেন্ড অফিসারকে গ্রেপ্তার এবং বেধড়ক মারধর করে।
গণকবরের শহীদদের স্মৃতিফলকে নিজের বাবার নাম দেখিয়ে শহীদ পুত্র জাহেদ বলছিলেন, তার পরিবারের সাত জনেক মেরে ফেলার সেই ঘটনা। বাবা, দাদা, চাচাসহ সব হারিয়ে কিশোর জাহেদই ছিলো সেই পরিবারের একমাত্র পুরুষ সদস্য।
গোসাইচর চার নম্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রবীন শিক্ষক আসাদুজ্জামানের চাচা পালাতে গিয়ে হানাদার বাহিনীর গুলিতে নিহত হন। আবার তার ফুপা নদী পেরোতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। এভাবে তার পরিবারের তিনজনকে হত্যা করা হয়।
তিনি বলেন সেদিন সকাল ছয়টার মধ্যেই সোনালি মার্কেট এলাকায় রাস্তার ওপর সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, কৃষক, মুক্তিযোদ্ধাসহ ১১০ জনকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। সন্ধ্যা পর্যন্ত আক্রান্ত গ্রামগুলো থেকে খুঁজে খুঁজে হত্যা করা হয় মোট ৩৬০ জনকে। এমন কোনো বাড়ি ছিলোনা, যেখানে কাউকে হত্যা করা হয়নি।
ইসমানির চরের দুই নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা তানেসউদ্দীন বলছিলেন, পাকিস্তানি বাহিনী ওই দিন শুধু নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষদের হত্যা করে ক্ষান্ত হয়নি। সমান তালে ধর্ষণ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগসহ গ্রামবাসীদের অর্থ-সম্পদ লুটও করেছে। সেই হত্যার প্রতিশোধই যুদ্ধের ময়দানে টেনে নেয় তরুণ মুক্তিযোদ্ধা তানেস উদ্দীনকে। আগরতলায় প্রশিক্ষণ শেষে অংশ নেন সম্মুখ সমরে। ভবেরচর ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া, বাঞ্ছারামপুর, ঘাগুটিয়াসহ বিভিন্ন গ্রাম শত্রু মুক্ত করার বীর সৈনিক তিনি। এই গণহত্যার দিন রাতেই তিনি মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে ভারতের ট্রেনিং সেন্টারে রওনা হন।
তানেস বলছিলেন, সেই দিন প্রাণের ভয়ে মসজিদের মধ্যে ঢুকে যারা কোরান শরীফ পড়ছিলো, তারা ভেবেছিলো মুসলমান পাকিস্তানি বাহিনী তাদের মারবে না। কিন্তু তাদেরও রেহাই দেয়নি। গুলিতে যারা মারা যায়নি, তাদের বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছিলো।
দীর্ঘদিন নিজ এলাকার গণহত্যা নিয়ে গবেষণা করেছেন শাহদাত পারভেজ। অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৮ তে প্রকাশিত হয়েছে সাহাদাত পারভেজের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়ে লেখা বই ‘গণহত্যা গজারিয়া : রক্ত মৃত্যু মুক্তি’।
বইটিতে ১৯৭১ সালের ৯ মে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায়ে ভয়াবহ গণহত্যার বর্বর চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। গণহত্যার পর তারা গজারিয়ায় স্থায়ীভাবে সেনা ক্যাম্প স্থাপন করে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা সাত মাস নিরীহ মানুষের ওপর নিপীড়ন, নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ চালায়। বইটিতে সেই ঘটনার অনুপুঙ্খ বিবরণ আছে। প্রয়োজনীয় তথ্য, উপাত্ত, ছবি, দলিল, তালিকা, ঘটনাক্রম ও সময়ানুক্রম যুক্ত আছে এতে। ঘটনার বিবরণ ছাড়াও আছে ৩৪ জন ভুক্তভোগীর সাক্ষাৎকার। গণহত্যার স্বীকার অনেকেই এখানে আত্মীয় বাড়িতে নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় এসেছিলেন ।অনেক লাশ যেমন পাওয়া যায়নি, তেমনি অনেকের পরিচয়ও বের করা যায়নি শেষ পর্যন্ত।
সাহাদাত আরও বলছিলেন, শিশুরাও সেইদিন রেহাই পায়নি। আর নারীদের ঘর থেকে ধরে এনে গোসাইচর জামে মসজিদের পাশে বীজিগারে অত্যাচার করে হানাদার বাহিনী।নারীদের চীৎকারে ছড়িয়ে পড়েছিলো গ্রামের আনাচে কানাচে। হেড কোয়াটারের নির্দেশ ছিলো মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত সবাইকে হত্যা করার। তাই যুবকদের খুঁজে সবার আগে।
সে সময়ের নথিপত্র বলছে গণহত্যার ৯ দিন পর ১৮ মে স্থানীয় মুসলিম লীগ নেতা আব্দুল গফুর চৌধুরী আহ্বায়ক আর টুকু মুন্সিকে যুগ্ম আহবায়ক করে ২৪ সদস্যের গজারিয়ায় থানা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। আর এক মাসের মধ্যে পাকিস্তানি ক্যাম্প আর রাজাকার বাহিনীও গঠন করা হয়।
নদীতে বয়ে যায় রক্তের বহর। ৯ মে’র পর পড়ে থাকা লাশ দাফন আর সৎকারের জন্য মানুষ পাওয়া যায়নি। গোসলের পরিবর্তে পানি ছিটানো হয় মরদেহে। অপরিচিত লাশের ধর্ম কি জানা যায় নি। লাশের জাত পাত না খুঁজে তলাপাতা, পুরনো শাড়ি আর চাদর পেঁচিয়ে এক গর্তে মাটি চাপা দেওয়া হয়। অসংখ্য লাশ ফুলদী আর মেঘনার বুকে ভেসে গেছে সেদিন। ভেসে যাওয়া লাশ শকুন আর কাকে খায়। তাদের পরিচয় আর পাওয়া যায়নি।
বিশেষ কৃতজ্ঞতা- সাহাদাত পারভেজ, লেখক, গবেষক ও খ্যাতিমান আলোকচিত্রী।