মাহবুব অালম বাবুঃ
রত্মগর্ভা মুন্সীগঞ্জবাসীর চিত্তবিনোদনের রঙ্গমঞ্চ সিনেমা হলগুলো একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এরই মধ্যে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে মুন্সীগঞ্জ শহরের প্রায় শতবর্ষী রাধাগোবিন্দ ছবিঘর। ৬৫ বছর বয়সী মুন্সীগঞ্জ শহরের ‘দর্পণা’ দর্শক চিত্তবিনোদনের পরিবর্তে গত ১০ বছর মেহমানদারিতে (চৌধুরী কমিউনিটি সেন্টার) নিয়োজিত হয়ে ভঙ্গুর অবকাঠামো টিকিয়ে রেখেছে।
বন্ধ হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে চমকপ্রদ নামের সদরের রামপালের আঁখি, কমলাঘাটের মিনার্ভা ও শাপলা, টঙ্গীবাড়ীর পপী, আলদির শিতল, ও বেতকার স্বপ্নপুরী গজারিয়ার আনন্দ মেলা, সিরাজদীখানের নিমতলায় সৈকত সিনেমা হল ও তালতলায় ছবি ছন্দা।
অন্যদিকে সদরের পান্না, শ্রীনগরের ঝুমুর, স্বপ্নপুরী ও হাসাড়ার স্বপ্নছায়া, লৌহজংয়ের পদ্মা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চললেও মুক্তারপুরের পান্না সিনেমা হলটি যে কোনো সময়ই বন্ধ হয়ে যাবে বলে হতাশা কণ্ঠে জানান স্বত্বাধিকারী মো. আজগর হোসেন।
দেশের সিনেমা হলগুলোর হারানো জৌলুস ফিরিয়ে আনা প্রসঙ্গে মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল হাসান বাদল বলেন, মানসম্পন্ন ছবি নির্মাণ, অবকাঠামোর পরিবর্তন, পাশাপাশি হলগুলোর পরিবেশ আরও উন্নত করলে দর্শক হলমুখী হবে।
১৯৫০-’৫২তে নির্মিত দর্পণার ওপেনিং শোতে ‘মা ও ছেলে’ ছবিটি একটানা তিন মাস প্রদর্শিত হয়। কথা প্রসঙ্গে দর্পণা হলের সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক শহীদুল্লা কাউসার পাভেল জানান, মানসম্পন্ন ছবির অভাব ও আকাশ সাংস্কৃতির প্রভাবই দেশের হলগুলো বন্ধের অন্যতম কারণ।
দেশের চলচ্চিত্রশিল্প পরিপক্ব হয়ে ওঠার আগেই ভারতীয় আকাশ সংস্কৃতির আগ্রাসনে এ শিল্পটি এখন মৃত্যুপথযাত্রী বলে মুন্সীগঞ্জের ক্যাবল ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম ঝিন্টু মনে করেন।
এ প্রজন্মকে হলমুখী করতে হলে সিনেকমপ্লেক্স নির্মাণের বিকল্প নেই বলে প্রায়ত কৌতুক অভিনেতা জলি কাদিরের ছেলে তরুণ নাট্যকর্মী অপূর্ব সূচনা মনে করেন।
এদিকে শতবর্ষী ছবিঘর হলের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মুন্সীগঞ্জের প্রভাবশালী জমিদার বংশের রাধাগোবিন্দ উনিশ শতকের গোড়ার দিকে নিজ পরিবারের চিত্তবিনোদনার্থে (১৯১৫-১৬) নিজ নামে আরজি ছবিঘর হলটি স্থাপন করেন। নাটক, গান, যাত্রা প্রদর্শন, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বিচারকার্য পরিচালনা, নির্বাক চলচ্চিত্র প্রদর্শন, ব্রিটিশবিরোধী সভা-সমাবেশের পাশাপাশি ১৯৪০ সালের পর পরই সবাক চলচ্চিত্র প্রদর্শন শুরু হলে মুন্সীগঞ্জের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে ছবিঘরের খ্যাতি।
এখানে বক্তব্য রাখেন ভারতীয় উপমহাদেশের অবিসংবাদিত নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং অবিভক্ত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলে প্রতিহিংসার আক্রোশে ফুঁসে ওঠে ব্রিটিশ সরকার। অনুমতি না নিয়ে ছবি প্রদর্শনের অভিযোগে ১৯৪২ সালে মেশিনারিজ, আসবাবপত্রসহ হলের অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের আদেশ জারি করে ব্রিটিশরা। ব্রিটিশ আদেশ চ্যালেঞ্জ করে রুখে দাঁড়ান মুন্সীগঞ্জ শহরের জগধাত্রীপাড়া নিবাসী সর্বজন শ্রদ্ধেয় আইনজীবী প্রয়াত চিন্ত হরণ চৌধুরী। তার পরামর্শেই ক্রোক পরোয়ানা পৌঁছার আগেই স্থানীয় জনতার পাশাপাশি শতাধিক রাজমিস্ত্রি ও শ্রমিক মিলে এক রাতেই ফ্লোরসহ ছবি প্রদর্শনের মেশিন, আসবাবপত্র ঢালাই করে স্থাবর সম্পত্তিতে পরিণত করে ব্রিটিশ কোপানল থেকে রক্ষা পায় রাধাগোবিন্দ ছবিঘর হলটি।
কথা হয় নয়াগাঁও নিবাসী ৮৪ বছরের বৃদ্ধ হাজি শামসুল হকের সঙ্গে। মুন্সীগঞ্জ প্রশাসনের অবসরপ্রাপ্ত জেপি শামসুল হক সিনেমা বিনোদন প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণে বলেন, মাদ্রাসায় পড়াকালীন দুই আঁটি পাটখড়ি বিক্রি করে পাওয়া দুইআনা ও মায়ের কাছ থেকে নেওয়া একআনা মোট তিনআনা দিয়ে ৪৮ সালে প্রয়াত বন্ধু বোরহানউদ্দিনকে সঙ্গী করে ছবিঘর হলে প্রদর্শিত বোম্বে টকিজের ‘মিরা’ আমার দেখা প্রথম বায়োস্কোপ। এ ছাড়া শরৎচন্দ্র চট্টপাধ্যায় পরিচালিত ও ছবি বিশ্বাস অভিনীত ‘নিষ্কৃৃতি’ ছবিটি একাধিকবার দেখেন এবং দেশীয় আদি সংস্কৃতি চর্চা হলে নতুন নতুন দর্শক তৈরি হবে বলে শামসুল হক জানান। মুন্সীগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সদর থানা কমান্ডার এমএ কাদের মোল্লা স্মৃতিচারণকালে বলেন, উর্দু ‘তালাস’ও ‘ফিরিঙ্গি’, বাংলা ‘পথে হলো দেখা’, ‘মায়ামৃগ’, ‘সাগরিকা’, ‘ছবিঘর’ হলে বসে দেখার স্মৃতি এখনো নিজ মানষপটে প্রোজ্জ্বল।
বিদ্যুৎহীন মুন্সীগঞ্জে ছবি প্রদর্শন সহজতর করতে এগিয়ে আসেন নারায়ণগঞ্জের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী প্রয়াত কানাই বাবু। মুন্সীগঞ্জ লঞ্চঘাটসংলগ্ন নিজ মালিকানাধীন বরফকলের জেনারেটর বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো ছবিঘর ও দর্পণায়। এ জেনারেটরের বিদ্যুতেই আলোকিত ছিল শহরের রাস্তা।
ব্রিটিশ-পরবর্তী ভারত ভাগের পর রাধাগোবিন্দ ছবিঘরের মালিকানা বদল হয়। মুন্সীগঞ্জের প্রভাবশালী কফিলউদ্দিন, হরিপদ মল্লিক, জগদীশ মল্লিকসহ ১২ জন সংস্কৃতিমনা ব্যক্তি হলটির মালিকানায় এসে রাধাগোবিন্দ বাদ দিয়ে ছবিঘর হল নামকরণ করেন। মালিকানা দ্বন্দ্ব ও লসের অল্পদিনেই নিলামে ওঠে ছবিঘর। নারায়ণগঞ্জ টানবাজারের শিল্পপতি বাদল সেন নিলাম ডাকে হলটি ক্রয় করলে হারানো জৌলুস ফিরে পায় ছবিঘর। পঞ্চাশের দশকে এ হলেই ছয় আনা, আট আনা ও ১২ আনার টিকিটে দিলিপ কুমারের ‘আজাদ’ ছবিটি একটানা ছয় মাস দেখেছিল মুন্সীগঞ্জবাসী।
নাটক, গান, সিনেমার পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান মুসলিম লীগের সভা করেছিলেন ছবিঘর হলে। মোনায়েম খানের সভায় মো. আব্দুল বাকিম বিক্রমপুরী, মোতাহার আলী মোক্তার, সৈয়দ ফজলুল হক, দেওভোগের মো. ইদ্রিস আলী, নয়াগাঁওয়ের আবুল হোসেন, পঞ্চসারের আব্দুল আজিজ, হাফিজউদ্দিন ব্যাপারী, রামপালের শফিকুল হক ভূঁইয়া, এমএ আউয়াল, রিকাবী বাজারের আজিজ মাস্টার, নুরুল হক ব্যাপারী, মোল্লাকান্দির আব্দুল মতি, শিলইয়ের শাহ নুরুদ্দীন, চরকেওয়ারের আব্দুল বারেক, বজ্রযোগিনীর আব্দুস সোবহান, টঙ্গীবাড়ীর সিরাজুল ইসলাম মল্লিক, আবদুল্লাপুরের সামাদ ব্যাপারী, দীঘিরপারের আরব আলী হালদার, বালিগাঁওয়ের নুরুল ইসলাম প্রমুখ মুসলিম লীগের এলিট শ্রেণির নেতাকর্মীরা উপস্থিত। আবারও মালিকানা বদল হলে ছবিঘর হল ক্রয় করেন আবদুল্লাপুর ইউনিয়ন চেয়ারম্যান রশিদ ব্যাপারী। তার মৃত্যুর পর হলটি বিক্রি করে দেওয়া হয় সদরের রিকাবী বাজারের ঘোষ্ট সাহা, শওকত আলী, আক্রাম আলী, রওশন আলী গংদের কাছে।