রাত তখন পৌনে ন’টা। আগারগাঁও রেডিও স্টেশন থেকে ফিরছি। মানিক মিয়া এভিনিউ থেকে ফার্মগেটের দিকে যাচ্ছি। তীব্র যানজটে খামারবাড়ীর পাশের রাস্তায় আটকে আছি। একই সিগন্যালে পৌনে এক ঘণ্টা। এটা এখন স্বাভাবিক ব্যাপার। কেউ যদি ভুল করে ওই রাস্তায় ঢুকে পড়ে তাহলে আর রক্ষা নেই। কাফফারা তাকে দিতেই হবে। ঘণ্টা খানেক সিগন্যালে আটকে থাকা এ যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
ভাবতে অবাক লাগে এই ডিজিটাল যুগে ট্রাফিক সিগন্যাল চলছে এনালগ পদ্ধতিতেই। ট্রাফিক হাতের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করছেন যানবাহন। তিনি তার মর্জিমাফিক কোনো এক দিকের গাড়ি ছাড়ছেন আর অন্য দিকের গাড়ি আটকে দিচ্ছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। দীর্ঘক্ষণ আটকে থাকার কারণে ওই রাস্তায় যে দেড়-দুই কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে সেদিকে তার ভ্রূক্ষেপ নেই। মজার ব্যাপার হলো, রাস্তা পারাপারে কোন নিয়মকানুন নেই, যে যেদিক দিয়ে পারছে রাস্তা পার হচ্ছে আর পুলিশ তাদের সহায়তা করছে। গাড়ি আটকে দিয়ে যত্রতত্র পার করছে পথচারী।
পৌনে নয়টা থেকে পৌনে দশটা; গাড়িতে বসে থেকে মেজাজ যখন তিরিক্ষি হঠাৎ চোখে পড়লো নয়-দশ বছরের একটি ছেলে আমার গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। ছেলেটিকে ভিখারি মনে হলো না। সিগন্যালে গাড়ি থামা মানেই ভিখারির যন্ত্রণা। প্রতি মুহূর্তে একজন এসে হাজির হচ্ছে, ভিক্ষা চাইছে। বলতে কষ্ট হচ্ছে এই ঢাকা শহর যেন অভিভাবকহীন এক নগরী, দেখার কেউ নেই।
ছেলেটি এগিয়ে এসে বললো, ‘দুইটা টাকা দিবেন?’ যানজটে বসে বসে এতই বিরক্ত লাগছিল যে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না, কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে রইলাম। আমাকে নির্বিকার বসে থাকতে দেখে ছেলেটি হয়তোবা ভাবলো, আমি বাংলা বুঝি না। তাই সে ইংরেজিতে বললো, ‘গিভ মি সাম মানি।’ ছেলেটির কথা শুনে হাসি চেপে রাখতে পারলাম না, ফিক করে হেসে ফেললাম। দেখলাম, আমার ড্রাইভারও হাসছে। ছেলেটি লজ্জা পেয়ে পালিয়ে গেল। যে বয়সে ওর হাতে বই থাকার কথা, সে বয়সে ও ভিক্ষা করছে। ভিক্ষা করার জন্য সে ইংরেজি শিখেছে। বিদেশীদের কাছে ভিক্ষা চাইতে গেলে ইংরেজি তো বলতেই হবে। বড় কষ্ট হলো ছেলেটির জন্য, ওর মতো হাজারও পথশিশু বেছে নিয়েছে এই ভিক্ষাবৃত্তি। ওদের জন্য কি আমাদের কিছুই করার নেই? আমরা কি পারি না একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবনের নিশ্চয়তা দিতে। ওদের জন্য কি কিছুই করণীয় নেই সরকারের?