মুন্সিগঞ্জ, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, সুমন খান (আমার বিক্রমপুর)
মুন্সিগঞ্জ জেলা শহরের একমাত্র সরকারী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল।
স্বল্প খরচে ভালো চিকিৎসা পাওয়ার আশায় দূর-দূরান্ত থেকে হাজারো মানুষ ছুটে আসে এখানে। দীর্ঘদিন ধরে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সংকট, তৃতীয় শ্রেনীর জনবল সংকট, ভর্তি রোগীদের বিছানা সংকট, বহিরাগত দালাল সিন্ডিকেটসহ বিভিন্ন বেসরকারী ক্লিনিকে প্রাইভেট চেম্বার করা মুনাফালোভী ডাক্তারদের উদাশীনতায় সু- চিকিৎসা বঞ্চিত হচ্ছে সাধারন মানুষ।
এমনটাই অভিযোগ হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী এবং রোগীর স্বজনদের।
জেলা সিভিল সার্জন অফিসের দেয়া তথ্য মতে, মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালটি ২০০৬ সালে ৫০ শয্যা থেকে ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। কিন্তু জনবল ৫০ শয্যারই থাকে। এই ৫০ শয্যার জনবল দিয়েই বর্তমান ১০০ শয্যার হাসপাতালটিতে চলছে চিকিৎসাসেবা।
দীর্ঘ ৩ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে চক্ষু ও নাক কান গলা বিভাগ। সার্জারী বিভাগে কনসালটেন্ট পদে ১ জন খালি রয়েছে, নেই রেডিওলজী কনসালটেন্ট, মেডিসিন বিভাগও চলছে বিভিন্ন উপজেলা থেকে প্রেয়শনে আসা ডাক্তারদের দিয়ে। লোকবল সংকট রয়েছে ৩য় এবং ৪র্থ শ্রেনীরও।
সরেজমিনে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সকাল থেকে নিচ তলার বহি:বিভাগে এবং ২য় তলায় মেডিসিন, শিশু, অর্থপেডিক্স বিভাগে রোগীদের উপচে পড়া ভিড়।
চিকিৎসক সংকটের কারনে দায়িত্বরত চিকিৎসকরা দায়সারা সেবা দিলেও সেটা রোগীদের জন্য কাংখিত নয় বলেও রয়েছে রোগীদের নানা অভিযোগ।
কতিপয় চিকিৎসকদের রুমের সামনে রোগীদের পাশাপাশি দেখা যায় দালালদের। এরা ডাক্তারদের রুমেই এবং বাইরে দায়িত্ব পালন করে। রোগীরা ডাক্তারদের রুম থেকে বের হলেই তাদেরকে ফুঁসলিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
মুন্সীগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে প্যাথলজি বিভাগে রোগীদের প্রয়োজনীয় পরিক্ষা – নিরিক্ষার সকল ব্যবস্থা থাকলেও কতিপয় চিকিৎসক হাসপাতালের প্যাথলজিতে বিশ্বাসী না হয়ে রোগীদেরকে দালালদের মাধ্যমে তাদের নির্ধারিত ক্লিনিক ও ডায়াগনোষ্টিক সেন্টারে যেতে বাধ্য করে।
অন্যদিকে রোগীরা ডাক্তারদের কথার বাইরে সরকারী বা অন্য কোথাও পরিক্ষা নিরিক্ষা করালেও সেই রিপোর্ট দেখতে ডাক্তাররা অনিহা প্রকাশ করে।
বহি:বিভাগে সরকারী ঔষধ ডেলিভারী রুম থেকে রোগীদের দেয়া হয় প্যারাসিটামল, ওমিপ্রাজল, ঠান্ডার সিরাপসহ স্বল্প মূল্যের সামান্য ঔষধ। তবে শতকরা ৬০ ভাগ রোগীর চিকিৎসাপত্রে লিখা থাকে বাইরের ঔষধ। ৪০ ভাগ রোগীদের ক্ষেত্রে দু-একটা আইটেম হাসপাতালের ভিতর থেকে সর্বরাহ করা হয়।
বহি: বিভাগের অধিকাংশ চিকিৎসক দৈনিক গড়ে ১২০-১৫০ জন রোগী দেখে থাকেন । এতে করে কাংক্ষিত সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জেলার সাধারন মানুষ ।
ভর্তি রোগীদের ওয়ার্ডগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, বিছানা সংকটের কারনে ভর্তি রোগীদের ঠাঁই মিলেছে ফ্লোরে, হাসপাতালের করিডর এবং বারান্দার মেঝেতে। রোগীর সংখ্যা কম থাকলে বিছানাগুলো বিড়ালদের আবাসস্থল হয়ে যায়। ভর্তি রোগীদের বিছানা, বালিশ নোংরা, মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ময়লা আবর্জনা। টয়লেটগুলোর অবস্থা নাজুক। হাসপাতাল থেকে দেয়া ভর্তি রোগীদের তিনবেলা খাবারেও রয়েছে অনিয়ম।
ভর্তি রোগী এবং তাদের স্বজনরা জানান, সকালবেলা ২পিচ পাউরুটি, ১টি কলা। মাঝে মধ্যে ১ গ্লাস গাভীর পাতলা দুধ। দুপুরে মোটা চালের ভাত, ডাল আর নামমাত্র মাছ তরকারী। সাপ্তাহে ২ দিন দেয়া হয় ফার্মের মুরগী। তবে অধিকাংশ রোগী হাসপাতাল থেকে নেয়া খাবার গ্রহন করে না। স্বচ্ছল রোগীরা বাসাবাড়ী কিংবা হোটেল থেকে খাবার কিনে খেলেও গরীব রোগীরা বাধ্য হয়ে নিম্নমানের খাবার খায়।
ভর্তি রোগী মো: শফিকুল ইসলাম জানান, সকালের খাবার হিসাবে পাউরুটি আর কলা দিয়েছে । দুপুরে মোটা চালের ভাত আর নামমাত্র তরকারী এগুলো খাবার উপযোগী নয়। তবুও বাধ্য হয়েই খেতে হচ্ছে। টয়লেটগুলোও অপরিস্কার। বিছানার নিচে ময়লা আবর্জনা থাকে সব সময়। এতে করে অনেক বিড়ালের আশ্রয় কেন্দ্র হয়েছে হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলো। দিনে রাতে রোগীদের বিছানায় বিড়াল ছোটাছুটি আর ঘুমিয়ে থাকতে দেখা যায়।
চিকিৎসা বঞ্চিত রোগী মাসুদা বেগম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে চক্ষু বিভাগের ডাক্তার নেই। আমি বাইরে থেকে বেসরকারী হাসপাতালে চক্ষু চিকিৎসা করে এখন আমার মাকে নিয়ে আসছি নাক, কান গলার ডাক্তার দেখাতে। নিচতলায় সাধারন ডাক্তার দেখাতে হলো কারন নাক কান গলা বিভাগে ডাক্তার নেই। তাছাড়া হাসপাতাল থেকে সর্বরাহ করা ঔষধ রোগের উপসম উপযোগী নয়।
বহি: বিভাগের চিকিৎসা নিতে আসা রোগী লতিফ বেপারী জানান, ডাক্তার সংকটে রোগীর ভিড়। দায়িত্বরত ডাক্তার রোগীর টিকেট হাতে নিয়েই লিখা শুরু করে। রোগীর মুখে রোগের বর্ননা ভালভাবে না শুনেই চিকিৎসাপত্র দেয়। পাশাপাশি পরিক্ষা-নিরিক্ষা তো আছেই। তাছাড়া রুম থেকে বের হলেই বিভিন্ন বেসরকারী ক্লিনিক ও ডায়াগনোষ্টিক সেন্টারের নিয়োজিত দালালদের খপ্পরে পড়তে হয়। আবার ডাক্তারের কথা মত তার নির্ধারিত ক্লিনিকে পরিক্ষা-নিরিক্ষা না করালে সেটা দেখেন না ডাক্তাররা।
ভারপ্রাপ্ত জেলা সিভিল সার্জন ডা: মো: আবুল কালাম আজাদ বলেন, ৫০ শয্যার জনবল দিয়ে ১০০ শয্যার চিকিৎসাসেবা দেয়া হচ্ছে। এই জনবল দিয়ে আরো ভালো সেবা দেয়া সম্ভব না।
হাসপাতালের নানা অনিয়মের বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি আরো বলেন, জনবল সংকট ছাড়া সব কিছুই ভালো ভাবেই চলছে । তবে হাসপাতালে এখন দু”একজন দালাল থাকতে পারে । ক্লিনিকমুখী ডাক্তার এবং বহিরাগত দালালদের বিরুদ্ধে প্রমানসহ অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।