মুন্সিগঞ্জ, ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)
কাজ শেষ না করেই ‘শেখ হাসিনার উপহার’ হিসাবে ১৩ মাস আগে তড়িঘড়ি করে উদ্বোধন হয়েছে মুন্সিগঞ্জের টংগিবাড়ী উপজেলার রংমেহার উচ্চ বিদ্যালয়ের ৪তলা একাডেমিক ভবন।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া কাজটি পরের বছর আগস্টেই শেষ করে বুঝিয়ে দেয়ার কথা ছিলো ঠিকাদারের। কিন্তু ২০২৫ সালে এসেও ভবনের কাজ শেষ হয়নি- চালু করা যায়নি শিক্ষা কার্যক্রম।
অভিযোগ, কাজ শেষ না হলেও মুন্সিগঞ্জ শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রায় শতভাগ টাকা তুলে নিয়ে গেছে ঠিকাদার। এরপর থেকে লাপাত্তা প্রতিষ্ঠানটি।
আমার বিক্রমপুরের অনুসন্ধানে বেড়িয়ে এসেছে এসব তথ্য।
জেলা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি দুই কোটি ৮২ লাখ ৯৮ হাজার টাকা ব্যায়ে রংমেহার উচ্চ বিদ্যালয়ের ৪ তলা একাডেমিক ভবন নির্মাণ কাজ পায় রকি এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ৫৪০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ২০২০ সালের আগস্টে ভবনটি পূর্নাঙ্গরুপে বুঝিয়ে দেয়ার কথা থাকলেও সেটি দিতে পারেনি তারা। এর মধ্যে কাজের মেয়াদ বৃদ্ধির আবেদন করলে ২০২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দেয় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। কিন্তু সেইসময়ও অতিক্রম করে রকি এন্টারপ্রাইজ। পরে কয়েক দফায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ শেষ করার জন্য চিঠি দেয়া হলেও তাতে সাড়া মেলেনি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে- ২০২১ সালের পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সময় বৃদ্ধির আর আবেদন না করেনি। কিন্তু ৩০ শতাংশ কাজ বাকি থাকা সত্ত্বেও ২০২২ সালের ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত ১২ দফায় ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে জেলা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর।
অভিযোগ উঠেছে, জেলা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ সহকারী প্রকৌশলী শাহজাহান বাদশা ও জেলা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মৌরিন আক্তার মৌ ঠিকাদারের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা নিয়ে প্রায় শতভাগ বিল পরিশোধ করেছেন।
গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে বিদ্যালয়টিতে গিয়ে দেখা গেল- প্রায় ৩ কোটি টাকার ওই বিদ্যালয় ভবনের সড়ক থেকে সামনের অংশ চাকচিক্য। কিন্তু সামনের অংশে পড়েনি কোন রংয়ের প্রলেপ। নিচতলায় এক কোনায় দেয়ালে খোদাই করে উদ্বোধনী ফলক লাগানো হয়েছে।
এসময় দেখা হয় স্কুলের প্রধান শিক্ষকের সাথে। তিনি জানান- ২০২৩ সালের ৩ অক্টোবর তৎকালীন মুন্সিগঞ্জ ২ আসনের সংসদ সদস্য সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি উপস্থিত হয়ে ভবনটি উদ্বোধন করেন। সেই উদ্বোধনের ১৩ মাস পেরিয়ে গেলেও একদিনের জন্যও ব্যবহৃত হয়নি ভবনটি। ভবনে এখনো দেয়া হয়নি বিদ্যুৎ সংযোগ। প্রতি ফ্লোরের টয়লেটগুলোও কাটাছেড়া করে ফেলে রাখা। দরজা লাগানো হয়নি কোন কক্ষেই, জানালায় গ্রিল দেয়া হলেও মান নিম্নমানের।
দেয়াল থেকে শুরু করে ১২ টি শ্রেনীকক্ষ দেখে কোনভাবেই বোঝার উপায় নেই ভবনটি নবনির্মিত- অনাড়ম্বর উদ্বোধনও হয়েছে এটির।
রংমেহার যুবসংঘ নামে ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটি ছাড়াও ওই বিদ্যালয় লাগোয়া রয়েছে বিক্রমপুর-টংগিবাড়ী কলেজ ও রংমেহার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. হানিফুল ইসলাম বলেন, ‘যখন ভবনের কাজ অপুর্ণ রেখেই উদ্বোধন করা হচ্ছিলো তখনই এমপিকে বলেছিলাম কাজ শেষ হয়নি, উদ্বোধন করা ঠিক হবে না। কিন্তু তিনি উত্তরে বলেছিলেন- যতটুকু হয়েছে, ততটুকুতে উদ্বোধন করে ফেলি।’
তিনি বলেন, ‘এখনও প্রায় ৩০ শতাংশ কাজ বাকি। আমাকে ভবন বুঝিয়েই দেয়া হয়নি। ভবনে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করার মতো পরিবেশ নেই। নতুন ভবন মাথার উপর রেখেই ৪০০ শিক্ষার্থীর পাঠদান পুরোনো ভবনেই চলছে। পাশে টিনের বেড়া দিয়ে টয়লেট বানিয়ে দিয়েছি।’
অভিযোগের বিষয়ে জেলা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের উপ সহকারী প্রকৌশলী শাহজাহান বাদশা বলেন, ‘ঠিকাদার অসুস্থতার কথা বলে কাজ নিয়ে গাফিলতি করছে।’ কাজ শেষ করার আগেই বিল ছাড়ের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বিগত সরকারের পক্ষ থেকে বিল ছাড়ের চাপ ছিলো। তাছাড়া আমাদের কাছে ঠিকাদারের ১৫ লাখ টাকা জামানত রয়েছে।’
ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান রকি এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. রওশন বলেন, ‘আমি শিগগিরই কাজ শুরু করবো। আগামী ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যে কাজ শেষ করে বিদ্যালয় ভবন বুঝিয়ে দিবো।’
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মৌরিন আক্তার মৌ তার অফিসে গিয়ে দেখা করার অনুরোধ করেন। পরে কয়েক দফায় অফিসে গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে ফোন দিলেও তিনি ধরেননি।
কাজ শেষ না করেই লোকদেখানো উদ্বোধনের বিষয়টি জানতে মুন্সিগঞ্জ-২ আসনের (টংগিবাড়ী-লৌহজং) সাবেক সংসদ সদস্য সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলির সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।