১৪ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
শনিবার | রাত ২:৫৮
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.
উপমহাদেশের সবচেয়ে উঁচু মঠ মুন্সীগঞ্জে
খবরটি শেয়ার করুন:

সে এক চমত্কার ঘটনা। একটি স্বপ্নীল আদেশ। সন্তানের প্রতি স্বপ্নযোগে পিতার নির্দেশ। হ্যাঁ, ঘটনাটি ঘটেছিল ১৭৫৮ শতকের কোন এক রাতে। অর্থাত্ ১৭৭ বছর আগে। গ্রামের নাম শ্যামসিদ্ধি। মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার একটি গ্রাম। এই গ্রামে বাস করতেন বিক্রয়পুরের ধনাঢ্য ব্যক্তি শম্ভুনাথ মজুমদার। এক রাতে শ্রী শম্ভুনাথ ঘুমিয়েছিলেন। স্বপ্নে দেখলেন তার স্বর্গীয় পিতা আর চিতার উপরে একটি মঠ নির্মাণের নির্দেশ দিচ্ছেন। সেই মতো কাজ শুরু। কথাগুলোর সত্যতা কতটা তা বলা মুশকিল। তবে শ্রী শম্ভুনাথ বাবুর তৈরি মঠটি যে ভারতীয় উপমহাদেশের একটি শ্রেষ্ঠ ইতিহাস হয়ে থাকবে সে কথা অন্তত তার জানা ছিল না। বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানার শ্যামসিদ্ধি গ্রামে ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বোচ্চ মঠ অবস্থিত। বিশাল এই মঠটির উচ্চতা ২৪১ ফুট। মঠের আয়তন দৈর্ঘ্যে ২১ ফুট ও প্রন্থে ২১ ফুট। বৃহত্তর এই মঠের গঠন খুবই সুন্দর। অষ্টভুজাকৃতির মঠটি না দেখলে এর সৌন্দর্যের কথা বলে শেষ করা যাবে না। মঠটির ভেতরের সুড়ং-এর উচ্চতা প্রায় ৮০ ফুট। মঠের ভিতরে ঢুকতে দরজার উচ্চতা ২৭ ফুটেরও বেশি। প্রাচীনকালে তৈরি ইট সুরকির এই মঠের ভিত খুবই মজবুত। ঐতিহাসিকদের মতে শ্যামসিদ্ধির এই মঠ উপমহাদেশের সর্বোচ্চ স্মৃতিস্তম্ভ। প্রসঙ্গ উল্লেখ্য যে, ভারতের কুতুব মিনারের উচ্চতা ২৩৬ ফুট। মঠের ভিতরে ও বাইরে কারুকাজে পরিপূর্ণ ছিল। খুব সুন্দর সুন্দর কাঠের নকশী করা ছিল এর দরজায় ও জানালায়। মঠের মূল অংশের চেয়ে বাড়তি বারান্দা আছে। বারান্দার কাঠের দরজা ও মঠের মূল ফটকের কাঠের গেট অনেক আগেই চুরি হয়ে গেছে। মঠের গায়ে ছিল মূল্যবান পাথর ও পিতলের কলসী যার কোন অস্তিত্ব এখন আর দেখা যায় না। মঠটির ভিতরে কষ্টি পাথরের শিব লিঙ্গটি স্থাপিত ছিল, যার উচ্চতা ছিল ৩ ফুট। ১৯৯৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে শিব লিঙ্গটি চুরি হয়ে যায়। ২ অক্টোবর ১৯৯৫ সালে শ্রীনগর থানায় একটি মামলা হয়। মঠটি হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের জন্য তীর্থস্থান। In Sun and Shower গ্রন্থে দিল্লির লেখক “বারড়ী” শ্যামসিদ্ধির এ মঠের বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। দক্ষিণ দিকের দরজার ঠিক উপরে মার্বেল পাথরের ১র্৮র্ -২৪র্ র্ বর্গাকৃতির নামফলক আছে। সেখানে লেখা রয়েছে—

“শম্ভুনাথের বাসার্থ মঠ

শকাব্দ ১৭৫৮, সন ১২৪৩

শম্ভুনাথ মজুমদার মহাশয় অত্র মঠ স্থাপন করেন।

তস্য পৌত্র শ্রীযুত কুমুদিনীকান্ত মজুমদার ওয়ারিশ সূত্রে মালিক

হয়ে পূজার কার্যাদি পরিচালনা করিতেছেন।

শ্রী উপেন্দ্রনাথ মজুমদার ওরফে কালু

সন ১৩৩৬, ১৯ আষাঢ়।”

তথ্য সমৃদ্ধ এই পাথরটিতে ফাটল দেখা দিয়েছে। যে কোন সময় এই মূল্যবান পাথরটি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। মঠটির চূড়ার মধ্যে অসংখ্য ছিদ্র রয়েছে। এই ছিদ্রগুলোতে বর্তমানে অসংখ্য পাখির বাস।

হিন্দু সম্প্রদায় বছরের বিশেষ দিনে মঠে শিব পূজা করে। শিব রাত্রিতে পূজা উপলক্ষে মঠের চারপাশ ধোয়া-মোছা করা হয়। নানা রঙ্গের মোমবাতি দিয়ে সাজানো হয় মঠের আঙ্গিনা। দুধ, কলা, বাঙ্গিসহ নানা রকমের পিঠা ও ফলমূলের স্তূপ হয়ে যায় মঠের ভিতর ও দরজার সম্মুখ। পূজা উপলক্ষে শ্যামসিদ্ধি হয়ে ওঠে মুন্সীগঞ্জের মিলন মেলা। হিন্দু-মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃস্টান সবাই মিলিত হয়। মুন্সীগঞ্জের ৬টি থানার নামকরা ব্যক্তিবর্গ দল-মত, ধর্ম, বর্ণ ভুলে গিয়ে উপস্থিত হন। বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের কুমারী মেয়েরা ভিড় করে এই মঠে, কুমারী মেয়েরা সারিবদ্ধভাবে মঠের চারদিকে সাতবার করে ঘুরে আসে এবং সর্বশেষে শিবমূর্তিতে পূজা দেয়। এ পূজাতে শুধু মুন্সীগঞ্জ জেলার লোকই নয় আশেপাশের জেলা থেকেও হিন্দু লোকজন শ্যামসিদ্ধিতে জামায়েত হন। মঠের সামনে রয়েছে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও একটি বিরাট মাঠ। এ মঠকে কেন্দ্র করে প্রতি বৈশাখ মাসের দুই তারিখে বসে বৈশাখী মেলা। যা মুন্সীগঞ্জ জেলার আঞ্চলিক ভাষায় ‘গলইয়্যা’ নামে পরিচিত। এই গলইয়্যা উপলক্ষে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

১৭৭ বছরের পুরানো এই মঠটির সংস্কার করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। মঠে ফাটল দেখা দিয়েছে। যে কোন সময় ভেঙ্গে পড়তে পারে। এই স্মৃতিমঠটি রক্ষার জন্য জাতীয়ভাবে সকলের সাহায্য একান্তভাবে কামনা করেন এলাকাবাসী। মঠটি ইতিহাস হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে; এ প্রত্যাশা শ্যামসিদ্ধি এলাকাবাসীদের। মঠটি বাংলাদেশ ও তার অতীত ঐতিহ্যের কথা তুলে ধরবে আগামী প্রজন্মের কাছে

error: দুঃখিত!