মুন্সিগঞ্জ, ২১ জানুয়ারি, ২০২০, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)
সাড়ে তিন শ বছরের পুরোনো মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার ‘ইদ্রাকপুর কেল্লা’ মুন্সিগঞ্জের মানুষের দৃশ্যপট থেকে ক্রমেই দুরে সরে যাচ্ছে।
অথচ একসময় মুন্সিগঞ্জ বলতেই প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি ‘ইদ্রাকপুর কেল্লা’র দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠতো। মুন্সিগঞ্জ জেলা ব্রান্ডিং লোগোতেও সেভাবেই ফুটে আছে ‘ইদ্রাকপুর কেল্লা’র ছবি। কিন্তু বাস্তবিক অবস্থা ভিন্ন।
নতুন প্রজন্ম ‘ইদ্রাকপুর কেল্লা’র প্রতি আর আকর্ষিত হতে পারছে না। এটি এখন আশেপাশের এলাকাগুলোর মাদকসেবীদের ব্যবহারের জন্য সুবিধাজনক স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদেরও ‘ইদ্রাকপুর কেল্লা’ নিয়ে বিশেষ কোন আগ্রহ দেখা যায় না। সবাই যেন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে ঐতিহাসিক এই প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ থেকে।
এর আগে ২০১৩ সালে ‘ইদ্রাকপুর কেল্লা’ কে সংস্কার করে জাদুঘর করার সিদ্ধান্ত নেয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। এরপর ৩০ লাখ টাকা ব্যায়ে কিছু সংস্কার কাজও করা হয়। কিন্তু জাদুঘর আর নির্মাণ হয়নি।
মুন্সিগঞ্জের আইকনিক প্রাচীন স্থাপনাগুলোর মাঝে প্রধানতম স্থাপনা মনে করা হয় মুসলিম শাসন আমলের এই ‘ইদ্রাকপুর কেল্লা’ কে। এই জেলার মানুষ এই স্থাপনাটিকে বুকে ধারণ করার পাশাপাশি তাদের সভ্যতার পরিচায়ক মনে করে।
বর্তমানে এই কেল্লাটি তার জৌলুস হারিয়ে ফেলেছে। মানুষ এটি দেখতে এসে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছে। অনেক সময় মাদকসেবীদের দাপটে ভেতরে ঢুকে বের হয়ে যেতে হচ্ছে। অথচ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারলে আর সঠিকভাবে সংস্কার করা গেলে পর্যটকরা এখানে ভিড় জমাতো।
মুন্সিগঞ্জ জেলার বর্তমান ব্রান্ডিং ট্যাগ ‘প্রত্ননগরী মুন্সিগঞ্জ’ হলেও জেলার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর সঠিক সংরক্ষণ ব্যবস্থা ও রক্ষণাবেক্ষণে দৃশ্যমান কাজ না হওয়ায় এর স্বার্থকতা নিয়ে সমালোচনা করেন অনেকেই।
প্রায় ৩৬০ বছরের বেশি পুরনো স্থাপনাটি মূলত একটি জলদুর্গ। ২০০৩ সালে প্রকাশিত ‘মুন্সিগঞ্জের ইতিহাস’ গ্রন্থের তথ্যানুযায়ী, বারভূঁইয়াদের দমন ও জলদস্যুদের কবল থেকে ঢাকাকে রক্ষার জন্য তৈরি হয় ইদ্রাকপুর দুর্গ। ইটের এই স্থাপনা থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূরে ইদ্রাকপুর নামে একটি এলাকাও আছে।
বাংলার সুবাদার ও সেনাপতি মীর জুমলা ১৬৬০ খ্রীস্টাব্দে বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ জেলা সদরে তদানীন্তন ইছামতি নদীর পশ্চিম তীরে ইদ্রাকপুর নামক স্থানে এই দুর্গটি নির্মাণ করেন।
দুর্গটি নারায়নগন্জের হাজীগঞ্জ ও সোনাকান্দা দুর্গের চেয়ে আয়তনে কিছুটা ছোট। ৮২ মি. * ৭২ মি. আয়তাকার নির্মিত ইটের তৈরি এই দুর্গটি তৎকালীন মগ জলদস্যু ও পর্তুগিজ আক্রমণের হাত থেকে ঢাকা ও নারায়নগঞ্জসহ সমগ্র এলাকাকে রক্ষা করার জন্য নির্মিত হয়।
সুরঙ্গপথে ঢাকার লালবাগ দুর্গের সাথে এই দুর্গের যোগাযোগ ছিল বলে একটি জনশ্রুতি প্রচলিত আছে।
সুউচ্চ প্রাচীরবিশিষ্ট এই দুর্গের প্রত্যেক কোনায় রয়েছে একটি বৃত্তাকার বেষ্টনী। দুর্গাভ্যন্তর থেকে শত্রুর প্রতি গোলা নিক্ষেপের জন্য প্রাচীরের মধ্যে অসংখ্য চতুষ্কোনাকার ফোঁকর রয়েছে একমাত্র খিলানাকার দরজাটির অবস্থান উত্তর দিকে। মূল প্রাচীরের পূর্ব দেয়ালের মাঝামাঝি অংশে ৩৩ মিটার ব্যাসের একটি গোলাকার উঁচু মঞ্চ রয়েছে। দূর থেকে শত্রুর চলাচল পর্যবেক্ষণের জন্য প্রায় প্রতি দুর্গে এই ব্যবস্থা ছিল। এই মঞ্চকে ঘিরে আর একটি অতিরিক্ত প্রাচীর মূল দেয়ালের সাথে মিলিত হয়েছে। দুর্গের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সূদৃঢ় করার জন্য এটি নির্মিত হয়েছিল।
কেল্লাটির তিন কিলোমিটারের মধ্যেই ইছামতী, ধলেশ্বরী, মেঘনা এবং শীতলক্ষা নদীর অবস্থান। মোঘল স্থাপত্যের একটি অনন্য কীর্তি হিসেবে ইদ্রাকপুর দুর্গটি ১৯০৯ সালে সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষিত হয়।