৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
রবিবার | দুপুর ১২:৫৪
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.
আর কবে সুস্থ হবে মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল?
খবরটি শেয়ার করুন:

মুন্সিগঞ্জ, ৮ আগস্ট ২০২৪, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)

মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল- নামটি শোনার পর আপনার কেমন অনুভূতি হচ্ছে? নিশ্চয়ই নেতিবাচক? আসলেই- জেলা সদরের এই একমাত্র হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে গিয়ে ঠিকমত সেবা পেয়েছেন এমন মানুষ খুঁজে পেতে ‘অনুসন্ধান কমিটি’ বানাতে হবে।

দিনের পর দিন রোগী নিয়ে বাণিজ্য করা, হাসপাতালে পরীক্ষার সুযোগ থাকলেও রোগীকে বাইরের ক্লিনিক-ডায়াগনোষ্টিক সেন্টারে পাঠানো, প্রত্যেক চিকিৎসকের রুমে দালালদের ঢুকিয়ে রাখা এর সবই চলছে সরাসরি হাসপাতাল কতৃপক্ষের প্রশ্রয়ে। প্রতি মাসে কয়েক লাখ টাকা ক্লিনিক-ডায়াগনোষ্টিক সেন্টার থেকে ভাগ পান তারা।

হাসপাতাল আশপাশসহ মানিকপুর পর্যন্ত অন্তত ২০ টি ক্লিনিক-ডায়াগনোষ্টিক সেন্টার এর সাথে জড়িত। প্রশাসন-আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় এসব চললেও কখনো এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। তাই প্রশ্ন উঠেছে আর কবে সুস্থ হবে মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল?

আমার বিক্রমপুরের অনুসন্ধানে জানা গেছে- মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে বহির্বিভাগ ও জরুরী বিভাগ মিলিয়ে মাসে গড়ে অন্তত ৬০ হাজার মানুষ চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন। এর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশেরই রোগ পরীক্ষা করতে হয়।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুধুমাত্র মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের রোগীদের কাছ থেকেই হাসপাতালের আশপাশের অন্তত ২০টি ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের আয় মাসে কোটি টাকার উপরে। সরকারি এই হাসপাতালে উন্নত মানের মেশিন এবং দক্ষ টেকনিশিয়ান ও চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকেন। এরই মধ্যে হাসপাতালের ল্যাবে যুক্ত হয়েছে হেমোটোলজি অটো অ্যানালাইজার সিস ম্যাক্স এক্সএন-৫৫০ ভার্সন মেশিন। এই মেশিনে সিবিসিসহ ১২ ধরনের পরীক্ষা একসাথে করা যায়। এই অত্যাধুনিক মেশিন মুন্সিগঞ্জে আর কোথাও নেই। এছাড়াও ডিজিটাল এক্স-রে, ইসিজি এবং আল্ট্রাসনোগ্রাফ রয়েছে। হাসপাতালে নির্দিষ্ট সরকারি ফি দিয়ে উন্নতমানের পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ডাক্তাররা বেশিরভাগ রোগীকে পরীক্ষা করতে বাইরের ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠান এবং তাদের আয় থেকে নিয়মিত কমিশন পান তারা।

অন্যদিকে, প্রায় ৯০ শতাংশ রোগীকেই অ্যান্টোবায়োটিক লিখে দেন ডাক্তাররা। মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে বিভিন্ন রোগের ১১টি অ্যান্টিবায়োটিকের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও বেশিরভাগ রোগীকে বাইরের বেসরকারি ঔষধ কোম্পানির অ্যান্টিবায়োটিক কিনতে বাধ্য করেন ডাক্তাররা। সাধারণ ঔষধের তুলনায় অ্যান্টিবায়োটিকের দাম বেশি হওয়ায় সাধারণ রোগীদের বেগ পেতে হয়। হাসপাতালে বিনামুল্যে থাকা অ্যান্টিবায়োটিকও বাধ্য হয়ে বাইরের ফার্মেসি থেকে কেনেন রোগীরা। এছাড়া প্রয়োজনের ‍তুলনায় বেশি অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দেয়ার ব্যাপারেও কথা উঠেছে।

সম্প্রতি সরেজমিন মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি ডাক্তারের কক্ষেই একাধিক ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রতিনিধি বা দালালরা রয়েছেন। তারা হাসপাতাল থেকে ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী আনা নেয়া করছেন। হাসপাতালে কম মূল্যে বিভিন্ন রোগ পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও প্রকাশ্যেই এসব প্রতিনিধি বা দালালের মাধ্যমে রোগীদের বাইরের ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠাচ্ছেন ডাক্তাররা।

অভিযোগ রয়েছে, ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের কাছ থেকে নিয়মিত কমিশন নিয়ে রোগীদের জিম্মি করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছেন ডাক্তাররা।

প্রতিটি ডাক্তারের কক্ষেই দালাল

মুন্সিগঞ্জ সদর হাসপাতাল সড়কের সুপারমার্কেট থেকে শুরু করে মানিকপুর পর্যন্ত দুইপাশে অন্তত ২০টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার-ক্লিনিক রয়েছে। এর সবকয়টিই গড়ে উঠেছে সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের টার্গেট করে। সদর হাসপাতাল থেকে প্রতিদিন রোগী নিয়ে আসার জন্য এদের আলাদা লোকবল নিয়োগ দেয়া রয়েছে।

ডাক্তারদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলে রোগীদের নানা কথায় মন ভুলিয়ে নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টার-ক্লিনিকে নিয়ে যান তারা। গতকাল মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল ঘুরে ও বিভিন্ন সেবাপ্রার্থীর সাথে কথা বলে পাওয়া গেছে এমন চিত্র।

বৃহস্পতিবার দুপুরে কোমরের ব্যাথা নিয়ে মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের সহকারি সার্জন ডা. তানভিন হাসান মাহমুদ অপুকে দেখাতে আসেন মুন্সিগঞ্জ সদরের আব্দুল হান্নান। ডাক্তারের পাশের কক্ষেই সরকারি এক্স-রের ব্যবস্থা থাকলেও ডাক্তার তাকে পাঠান বাইরের ফেমাস ক্লিনিকে। নিরুপায় হয়ে আব্দুল হান্নান ১হাজার টাকায় বাইরে থেকে শোল্ডারের দুইটি এক্স-রে পরীক্ষা করান। অথচ হাসপাতালে করলে তার খরচ হতো ৬০০ টাকা।

এসময় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ডাক্তাররা সরাসরি রোগীদের ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠাচ্ছেন। দালালরা ডাক্তারের রুমের ভেতরে তাদের পাশে দাড়িয়ে থাকে। আমরা কোন প্রতিবাদ করতে পারিনা।

এসময় একই ধরনের অভিযোগ করেন মুন্সিগঞ্জ সদরের রহিমা বেগম। তিনি বলেন, ডাক্তার আমাকে মেডিল্যাব ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এক্স-রে করতে পাঠায়। সেখানে আমার ৪০০ টাকা খরচ হয়েছে। অথচ হাসপাতালে করলে খরচ হতো ১০০ টাকা।

হাসপাতালের জরুরী বিভাগের সামনে গিয়ে দেখা যায় সেখানে প্রকাশ্যে রোগীদের সাথে দেনদরবার করছেন ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালরা।

একটু সামনে এগোতেই ঔষধ বিতরণ কক্ষের সামনে দেখা হয় মুন্সিগঞ্জ সদরের হাছনা বেগমের সাথে। তিনি অভিযোগ করে জানান, আমার ৮বছর বয়সী মেয়ে তাকওয়ার কানে ব্যাথার জন্য ডাক্তারের কাছে আসলে তিনি কানের এক্স-রে করতে দিয়েছেন। আমি ডাক্তারের কক্ষ থেকে বের হয়ে আসার সময় অপরিচিত এক মহিলা আমাকে ডেকে বলে আমার সাথে চলেন আমি ১০০ টাকা কমে করে দিবো। পরে আমি তার পরিচয় জানতে চাইলে তার নাম শারমিন এবং তিনি স্থানীয় সুরক্ষা ডায়াগনস্টিকে কাজ করেন বলে জানান। এসময় তার সাথে কথা কাটাকাটি হলে তিনি ডাক্তারের রুমের ভেতর থেকে রিপন নামের আরও একজনকে ডেকে নিয়ে আসেন। সেও ঐখানে কাজ করেন বলে জানান।

ময়না আক্তার বলেন, আমি সদর হাসপাতালে সেবা নিতে এসেছি। আমার যেখানে ইচ্ছা পরীক্ষা করাবো। ডাক্তারের রুমে এভাবে ক্লিনিক- ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালরা বসে থাকলে সাধারণ মানুষ বুঝবে কি করে এরা দালাল না সাধারণ মানুষ।

মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আবু হেনা মোহাম্মদ জামাল বলেন, ‘রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অনেকেই ক্লিনিক- ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালাল হাসপাতালের অভ্যন্তরে নিয়োগ করেছিলেন। এসবকে আর প্রশ্রয় দেয়া হবে না।’

তিনি জানান, ‘হাসপাতালে এখন ২৬-২৭ জন চিকিৎসক সেবা দিচ্ছেন। দুই একজন ছুটিতে রয়েছেন। তাছাড়া কোথায় কি সমস্যা আছে সেগুলোও দ্রুত ঠিক করা হবে।’

এই বিভাগের সর্বশেষ
ফেইসবুকে আমরা
ইউটিউবে আমরা
error: দুঃখিত!