মুন্সিগঞ্জ, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২০, ডেস্ক রিপোর্ট (আমার বিক্রমপুর)
ইউনূছ ভাণ্ডারী ১৯২৮ সালের ১৪ ই এপ্রিল মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং উপজেলার পয়শা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আছর আলী মুন্সী।
মেধা, সততা আর কঠোর পরিশ্রম করে তিনি অল্প দিনেই দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। দরিদ্রতার কষাঘাতে তৈরি হওয়া নিজের ভেতর থেকে চিরতরে দারিদ্রতাকে দূর করেন। কঠোর পরিশ্রম করে যে, জীবনের লক্ষ্য স্পর্শ করা যায় তিনি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তিনি ঢাকার সদরঘাট সংলগ্ন চিত্তরঞ্জন এভিনিউতে পুরাতন মালের ব্যবসা শুরু করেন। তার সততা,কৌশল আর কঠোর পরিশ্রমের ফলে ধীরে ধীরে তিনি উন্নতি করতে থাকেন।
এক সময় তিনি নিজেই এলসি দিয়ে বিদেশে থেকে মাল আনা শুরু করেন এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী হিসেবে গন্য হন।সদরঘাটের “শাহ মোঃ ইউনূছ ম্যানসন”, বিক্রমপুরের সূবচনীর “আলেয়া হোসেন কোল্ড ষ্টোরেজ” তার অনন্য অবদান।+
তিনি কখনো একা ধনী হতে চাননি। তাই নিজের এলাকাবাসী এবং আত্মীয় স্বজন -যারা কৃষিকার্য অথবা দিনমজুরী করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তাদেরকে ঢাকায় এনে আগে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে তারপর নিজের গদির মালপত্র দিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ করে দিতেন।এমনি করে এলাকার হতদরিদ্র মানুষদের তিনি ঢাকামূখী করেন।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে জাপান যখন বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি আমদানি শুরু করে তখন এলাকার তরুনদের জাপানে পাঠানোর উদ্যোগ নেন তিনি।
তখন জাপান যেতে ৫০/৬০ হাজার টাকা লাগতো। কিন্তু এত টাকা জোগাড় করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। অনেকের পক্ষে পাসপোর্ট করার টাকাটা জোগাড় করা কঠিন ছিল।
তিনি নূর আলী, মালেক সারেং কিংবা দুলাল শিকদারের মত নামজাদা আদম বেপারীদের ডেকে বলতেন, অগো জাপান পাঠাইয়া দ্যাও, কোন সমস্যা যেন না হয়। ট্যাকা আমি দিমু।
তখন যারা জাপান গেছেন পরবর্তীতে দেখা গেছে কয়েক মাসের মধ্যে তাদের ভাই, ভাতিজা, কিংবা ভাগিনাকে ও নিয়ে গেছেন। এমনি করেই একটা সময় সেই গ্রামের চেহেরা বদলে যায়। সবাই বিত্তশালী হয়ে যায়। সেই পয়সা গ্রাম আজ নামের সাথে তাৎপর্যপূর্ন।
পয়সা গ্রামকে কেউ কেউ “জাপানী গ্রাম” নামে ও চিনে। আর যিনি এ মহান কাজটি করেছেন তাকে সবাই আদর করে “কর্তা” নামে ডাকতেন।
তিনি নিজে লেখাপড়া জানতেন না। কিন্তু লেখাপড়ার ব্যাপারে ছিলেন ভীষন অনুরাগী। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে আমাদের এলাকায় কোন হাই স্কুল ছিল না। ফলে এই এলাকার ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া বন্ধ হবার উপক্রম হয়। একটি হাই স্কুল করার পরিকল্পনা করেন তিনি।
আব্দুুস ছামাদ মোল্লা, এমদাদ হোসেন খান, শেখ আঃ কাদের, আঃ কাদের মাষ্টার, নূর হোসেন শিকদার, জামাল শিকদার, মোহর খানসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করলেন পয়শা উচ্চ বিদ্যালয় নামক ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ।
স্কুলটি তৈরি করার পর যাতায়াতে ভীষন সমস্যা দেখা দিলে তিনি পয়শা স্কুল থেকে ঘোলতলী বাজার পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার ওয়াটার লেভেল রাস্তা করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু জমির মালিকেরা কেউ কেউ তাদের জমি দিতে অস্বীকৃতি জানালে ইউনুছ ভান্ডারী নিজ খরচে জমি কিনে মাটি ভরাট করে রাস্তাটি করে দেন-যেটি এখন “ইউনুছ ভান্ডারী সড়ক” নামে পরিচিত।
প্রচুর দান করতেন তিনি। দানের মধ্য দিয়ে যে আত্মতৃপ্তি লাভ করা যায়, তা আর কোনোটার মধ্যেই নেই। তাই নিজের আত্মতৃপ্তি, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও অকৃত্রিম ভালোবাসা নিয়ে বহু মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
রাস্তাঘাট, মসজিদ মাদ্রাসা,কবরস্থান নির্মানে তিনি ছিলেন অগ্রপথিক। পয়শা প্রাইমারি স্কুল,মাদ্রাসা,মসজিদ সহ দেশের অনেক শিক্ষা এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গুলোতে তার বিরাট অনুদান রয়েছে। কেউ তার কাছে গিয়ে কখনো নিরাশ হয়নি।
কন্যাদায়গ্রস্হ, অসুস্হ্য কিংবা যে কোন সমস্যা নিয়ে কেউ তার কাছে গেলে তিনি সেটা সমাধানের চেষ্টা করতেন। এজন্য সবাই তাকে দানবীর হিসেবেই চিনেন।
তিনি খুব সাদাসিদে, পরোপকারী এবং নিরহংকারী মানুষ ছিলেন। তিনি মাইজভান্ডারীর মুরিদ ছিলেন। পীরকেবলা শফিউল বশর মাইজভান্ডারী। গর্ব করে বলেন, আমার সব মুরিদান এক পাল্লায় আর অন্য পাল্লায় যদি আমার ইউনুছকে রাখি তাহলে ইউনুছের পাল্লাই বেশি ভারি হবে। পীর সাহেব খুশি হয়ে তাকে খেলাফত প্রদান করেন এবং তার অনন্য গুনে মুগ্ধ হয়ে “খলিফায়ে আজম” খেতাবে ভূষিত করেন।
এই মহামনিষী ১৯৯৪ সালের ১২ই ডিসেম্বর (২৮ অগ্রহায়ণ) এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অসংখ্য ভক্তদের কাঁদিয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন। নিজ বাড়ীতেই তাকে দাফন করা হয়। প্রতি বছর তার ওফাৎ দিবসে স্মরণসভা ও বাৎসরিক মাহফিল হয়। তাঁর জীবনের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করা হয়। তার জন্য দোয়া করা হয় এবং কাঙালি ভোজের আয়োজন করা হয়। হাজার হাজার আশেকান,জাকেরান, ভক্ত এবং দর্শনার্থীরা এখানে সমবেত হন।