১৪ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
মঙ্গলবার | সকাল ১১:০০
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণে বড় বাঁধা যোগ্যতাহীন প্রধান শিক্ষক ও নামসর্বস্ব শিক্ষক সংগঠন
খবরটি শেয়ার করুন:

মুন্সিগঞ্জ, ১৩ আগস্ট ২০২৫ (আমার বিক্রমপুর)

লেখক: রমজান মাহমুদ, সহকারি শিক্ষক, ব্রাহ্মণগাঁও বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়, লৌহজং, মুন্সিগঞ্জ

ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল মূলত বেসরকারী উদ্যোগে। বিভিন্ন স্থানে জমিদার, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী ও শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের প্রচেষ্টায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠা থেকে শুরু করে শিক্ষকদের বেতনও তাঁরাই প্রদান করতেন। শিক্ষকতা পেশায় পূর্বে যারা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী তাঁরাই আসতেন। ফলে নীতি ও নৈতিকতার দিক থেকে তাঁরা থাকতেন সমাজের অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের অধিকারী।

১৮৩৫ সালের পর মূলত ইংরেজ সরকার এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার দিকে দৃষ্টি দেন। আর ১৮৫৭ সালে কলকাতা, বোম্বে ও মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইংরেজরা এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ হাতে নেয়। বাংলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এইডেড স্কুল নামে তারা সামান্য আর্থিক অনুদান দিয়ে নিজেদের কর্জায় নিয়ে নেয়। আর প্রতিষ্ঠাতার পরিবারগুলো হয়ে যায় গৌণ!

যারা এতদিন নিজেদের কষ্টার্জিত অর্থে এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেন, তাদের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠানে ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে! সরকার বাহাদুর এভাবেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে।

এক সময় নিজেদের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সন্তানের পড়াশোনা করার জন্য শিক্ষকদের শতভাগ বেতন প্রদানের মাধ্যমে জেলা শহরগুলোতে গড়ে তুলে ‘জেলা স্কুল’। মূলত ‘জেলা স্কুল’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এদেশে সরকারি-বেসরকারি স্কুল ধারণার সৃষ্টি হয়।

জেলা স্কুলগুলোতে কর্মরতরা পেতেন সরকারি কোষাগার হতে শতভাগ বেতন-বোনাস আর এ-ই ডেড স্কুলগুলো পেতো সামান্য অনুদান। পাকিস্তান সময়কালেও ইংরেজদের দেখানো পথ ধরেই কিছু স্কুল সরকারিকরণ করে শিক্ষকদের শতভাগ বেতন ও বোনাস সরকারি কোষাগার হতে প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়, অপরদিকে অধিকাংশ স্কুল বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় রেখে সামান্য অনুদানের ব্যবস্থা করা হয়। এ অনুদানের অর্থে শিক্ষকদের বেতন ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যয় করা হয়।

বাংলাদেশ সময়কালে ইংরেজ ও পাকিস্তান সময়কালের সে ধারণা এখনো চলমান। স্বাধীনতার পর শিক্ষকদের বেতনের নামে অনুদান প্রদান করা হলেও ১৯৮০ সালের পর থেকে তা মানথলি পে অর্ডার (এমপিও) বিল নামে প্রদান করা হচ্ছে। এখানে বেতনের পাশাপাশি বাড়িভাড়া ১ হাজার টাকা ও চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা প্রদান করা হচ্ছে বহুকাল যাবৎ। যা দ্বারা এ দুটি মৌলিক চাহিদার কোনটিই পূরণ সম্ভব নয়। অথচ একই কর্মঘন্টা হারে পাঠদান করে সরকারি শিক্ষকরা দুটিখাতে পাচ্ছেন বিপুল সুবিধা। যা বিরাট বৈষম্যের সৃষ্টি করছে। তাছাড়া অন্যান্য সুযোগ সুবিধাতো রয়েছেই।

স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও যখন একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ হয়না, তখন বিষয়টি সত্যিই বেদনাদায়ক। একই দেশে দুই রকম শিক্ষা ব্যবস্থা হতে পারে না! যা চরম বৈষম্য! শিক্ষকরা কেনো তাদের ন্যায্য প্রাপ্তির জন্য বারবার রাস্তায় নামবে? এটি কেবল শিক্ষকদের দাবী নয়। এ দাবি আজ সবার…

কারণ শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ হলে এর সুফল ভোগ করবে শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ গোটা রাষ্ট্র। তাই সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষক নামে শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য দূর করে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থা সরকারিকরণ করা হোক।

অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান চাননা শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ হোক। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ হলে প্রতিষ্ঠানের বিপুল পরিমাণ অর্থ তারা নিজেদের মতো করে ব্যয় করতে পারবেন না, ভুয়া বিল ভাউচার প্রদান করতে পারবেন না, নিজেদের ইচ্ছেমতো এমপিও বিলের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান হতে বেতন উত্তোলন করতে পারবেন না, সর্বোপরি স্বৈরাচারী মনমানসিকতা নিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় বড় বাঁধা জাতীয়করণ। এজন্য এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ প্রত্যাশীজোটের ১৩ তারিখের কর্মসূচিতে অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান শিক্ষকদের ঐ কর্মসূচিতে যেতে বাঁধা প্রদান করছেন। এখানে তাদের অযোগ্যতাই বারবার প্রমাণ করছেন। আন্দোলন করেই কিন্তু উৎসব ভাতা ৫০% করা হয়েছে। এদেশে যা কিছু ভালো অর্জন হয়েছে তার পিছনে আন্দোলন ছিল সবার আগে। অথচ এ আন্দোলনে প্রতিষ্ঠান প্রধানরা বাঁধা দিয়েছেন নানাভাবে। তাদের কী আন্দোলনের সুফল ভোগে কোন লজ্জা কিংবা অনুতপ্তবোধ কাজ করে?

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণে বড় বাঁধা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের দ্বারা গঠিত কোন সংগঠন। অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ আসলে কতোটুকু আন্তরিক জাতীয়করণে তা উপলব্ধির বিষয়। এছাড়াও কিছু নামসর্বস্ব সংগঠন রয়েছে যেখানে ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধার জন্য সাধারণ শিক্ষকদের ব্যবহার করেন। এতে শিক্ষক নেতারা লাভবান হলেও সাধারণ শিক্ষকরা থেকে যান আগের মতোই। তাই শিক্ষক সংগঠনের নেতা হবেন নিয়মিত শিক্ষকদের মধ্য থেকে। এতে শিক্ষকরা লাভবান হবেন যেকোন আন্দোলন সংগ্রামে। আর তরুণ শিক্ষকদের অগ্রাধিকার দিতে হবে এক্ষেত্রে। তরুণ শিক্ষকরা অপ্রতিরোধ্য। তাঁরা অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেন না। তাঁদের হাত ধরেই বদলে যাবে আগামীর শিক্ষা ব্যবস্থা।

আসুন সবাই একইস্বরে বলি-‘দাবি একটাই শিক্ষাব্যবস্থার জাতীয়করণ।’ যেসকল শিক্ষক সকল বাঁধা অতিক্রম করে জাতীয় প্রেসক্লাবে আন্দোলনে শরিক হয়েছেন তাদেরকে জানাই বিপ্লবী অভিনন্দন!

বিপ্লব জয় হোক, জাতীয়করণ জয় হোক।