যেভাবে বিক্রমপুরের সন্তানরা জন্ম দিয়েছিল বাংলা সিনেমার যুবরাজকে
মুন্সিগঞ্জ, ২৭ অক্টোবর ২০২৫, (আমার বিক্রমপুর)
লেখক: রমজান মাহমুদ, শিক্ষক ও গবেষক।
‘সালমান শাহ তাঁর নিজস্ব মেধা, অভিনয় দক্ষতা ও ফ্যাশন সচেতনতার কারণে স্বল্পসময়ে বিপুল দর্শকপ্রিয়তা পেলেও তাঁর গড়ে উঠার পেছনে বিক্রমপুরের সন্তানদের ভূমিকা সর্বাধিক।’
সালমান শাহ (১৯৭১-১৯৯৬) নব্বই দশকের তুমুল জনপ্রিয় একজন অভিনেতা। বেঁচে থাকলে সালমানের বয়স হতো ৫৫ বছর। মৃত্যুর এত বছর পরও তাঁর জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি।
বরং দিন যত যাচ্ছে তাঁর জনপ্রিয়তাও বাড়ছে প্রতিনিয়ত! বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এমন ঘটনা একমাত্র সালমানের ক্ষেত্রেই হয়েছে। বাংলা চলচ্চিত্রে তাঁর বিচরণ ছিল মাত্র সাড়ে তিন বছর। অথচ এ স্বল্প সময়েই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলেন বাংলা সিনেমার যুবরাজ হিসেবে।
অবশ্য, এক্ষেত্রে তাঁর সুনিপুণ অভিনয়ের পাশাপাশি ছিল প্রচলিত ধারার বিপরীতে পোশাক-আশাকে আধুনিকতার ছোঁয়া নিয়ে আসা। কখনো হ্যাট ও লম্বা কোটে পশ্চিমা লুক কিংবা টি-শার্ট বা লং শার্টের সঙ্গে নানা রকমের পশ্চিমা কোট থেকে শুরু করে স্যুট-টাই পরা। কখনো শার্টের কলার উঠিয়ে কিংবা হাফ হাতা গেঞ্জি, জিনস ওপরের দিকে ভাঁজ, হুডি-শার্ট কখনো ইন করে আবার ওপেনে রেখে বিচিত্র লুকে আবার কাউবয় বা জমিদারি পোশাকে, কবি-সাহিত্যিকের প্রতীকী পাঞ্জাবি পরে—পর্দায় হাজির হতে দেখা গেছে সালমানকে। হাফহাতা পলো টি-শার্টের হাতা ভাঁজ করে পরা সালমান শিখিয়েছেন। আর ডান হাতে ঘড়ি পরার আলাদা স্টাইল তো ছিলোই।
ব্যাকব্রাশ করা চুল, কানে দুল পরা, মাথায় রংবেরঙের টুপি, চোখে সানগ্লাস, ফেড জিনস, মাথায় স্কার্ফ—কত স্টাইল যোগ করলেন সালমান। লাল কিংবা কালো নকশায় মধ্যপ্রাচ্যের প্রচলিত স্কার্ফের ব্যবহার ছিল সালমানের। আকারে বড় শার্ট গুঁজে রেখেছিলেন প্যান্টের এক পাশে। মাঝে চুল কিছুটা বড় রেখেছিলেন, ছোট ঝুঁটি বাঁধা সেই চুল কি এখনকার তরুণদের মধ্যে দেখা যায়? তাঁর এ ফ্যাশন স্টাইল নব্বইয়ের তরুণদের আকৃষ্ট করেছিল। যার ফলে নব্বই দশক মানেই ছিল সালমান শাহ।
শোনা যায়, যেকোনো ছবিতেই পরিচালক পোশাক নির্বাচনের ব্যাপারটা সালমানের ওপর ছেড়ে দিতেন। ফরমাল পোশাক পরবেন, নাকি ক্যাজুয়াল লুক নেবেন, সে সিদ্ধান্ত সালমানই নিতেন। যা সে সময় অন্য কোন অভিনেতার ক্ষেত্রে ঘটেনি।
বড় পর্দায় তাঁর ক্যারিয়ার মাত্র তিন থেকে চার বছর। করেছেন মাত্র ২৭টি ছবি।
অথচ প্রদর্শকদের দেওয়া তথ্য বলছে, বাংলাদেশে সর্বকালের সর্বাধিক ব্যবসাসফল ১০টি ছবির মধ্যে ৩টি সালমানের। এযাবৎ বাংলাদেশে সবচেয়ে ব্যবসাসফল ছবি ‘বেদের মেয়ে জোসনা’। সারা দেশে ১ হাজার ২০০ প্রেক্ষাগৃহে চলা এ ছবি ২০ কোটির মাইলফলক ছুঁয়েছিল। এরপর দ্বিতীয় অবস্থানে আছে সালমান শাহ অভিনীত ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ ছবিটি। আয় করেছিল ১৯ কোটি টাকা। তৃতীয় অবস্থানেও আছে সালমানের ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ ছবিটি। আয় করে ১১ কোটি ৫০ লাখ টাকা।
সালমান অভিনীত প্রথম ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ আছে সর্বাধিক ব্যবসাসফল ছবির চতুর্থ স্থানে, আয় করেছিল ৮ কোটি ২০ লাখ টাকা। উচ্চতা বলতে তেমন কিছু ছিল না, ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি। গল্প-উপন্যাসে বেশি বর্ণিত নায়কদের মতো নয়। ফরসা, অনেকটা গোলগাল চেহারার সালমানকে প্রথম ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ দেখে অনেকে ভেবেছিলেন, পর্দায় সুন্দরী নায়িকাদের সঙ্গে প্রেম আর নাচানাচি করার মধ্যেই সীমিত থাকবেন এ তরুণ। কিন্তু বাস্তবে এ নায়ক ঘটালেন ভিন্ন চিত্র! পাল্টে দিলেন অতীত সব রেকর্ড!
সালমান শাহ তাঁর নিজস্ব মেধা, অভিনয় দক্ষতা ও ফ্যাশন সচেতনতার কারণে স্বল্পসময়ে বিপুল দর্শকপ্রিয়তা পেলেও তাঁর গড়ে উঠার পেছনে বিক্রমপুরের সন্তানদের ভূমিকা সর্বাধিক। কাকতালীয়ভাবে সালমানের শুরু এবং শেষটা ঘটেছে এ অঞ্চলের মানুষের হাত ধরেই। সালমান অভিনীত সিনেমাগুলো একটু বিশ্লেষণ করলেই আমরা সহজেই বুঝতে পারবো, একজন সালমান শাহ তৈরিতে বিক্রমপুরের অবদান কতোটুকু ছিল।
কেয়ামত থেকে কেয়ামত। চলচ্চিত্রটির প্রযোজক শ্রীনগরের সুকুমার রঞ্জন ঘোষ (মুন্সিগঞ্জ ১ আসনের সাবেক এমপি) ও বেজগাঁও সিরাজুল ইসলাম এবং প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আনন্দমেলা সিনেমা লিমিটেড। ভারত থেকে তিনটি হিন্দি সিনেমার রিমেক নিয়ে আসে আনন্দ মেলা সিনেমা লিমিটেড। পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান নতুন নায়ক-নায়িকা নিয়ে সিনেমা করার প্রস্তাবে আনন্দ মেলা সিনেমা লিমিটেড কোন দ্বিমত করেনি। বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে সালমান শাহ ও মৌসুমিকে নিয়ে আনন্দ মেলা সিনেমা লিমিটেড সিনেমা নির্মাণের ঝুঁকি নেয়। এ সিনেমায় শিল্পী আগুন প্রথমবার সিনেমার গানে প্লেব্যাক করেন। হিন্দি কেয়ামত সে কেয়ামত তক এর বাংলা রিমেক কেয়ামত থেকে কেয়ামত। ৮ কোটি ২০ লক্ষ টাকা আয় করে। এ সিনেমাটি ২৫ মার্চ ১৯৯৩ সালে মুক্তি পায়। কেয়ামত থেকে কেয়ামত-ই ইমন চৌধুরী থেকে বাংলা চলচ্চিত্রে সালমান শাহ সৃষ্টি করে।
১৯৯৪ সালে মুক্তি পায় তুমি আমার সিনেমা। এ সিনেমায় প্রথমবারের মতো সালমান শাহ ও শাবনুর অভিনয় করেন। এটি প্রযোজনা করেন মুন্সিগঞ্জ সদরের হাতিমাড়া এলাকার সন্তান শমশের আহমেদ। আদৃতা চলচ্চিত্র নামে তাঁর প্রডাকশন হাউজ ছিল। এ ছবির গল্প ও সংলাপ রচনায় বিক্রমপুরের পানহাটার ছটকু আহমেদ জড়িত ছিলেন। শাবনুর ছিলেন সালমান শাহ অভিনীত ১৪ টি সিনেমার নায়িকা। এ জুটিকে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সেরা জুটি বলা হয়। পরবর্তীতে নব্বই দশকে এ জুটির অনেক ব্যবসায় সফল সিনেমা নির্মিত হয়।
‘দেনমোহর’ সিনেমাটি পরিচালনা করেন বিক্রমপুর শ্রীনগর সেলামতির শফি বিক্রমপুরী (১৯৪৩-২০২৩)। এ ছবির প্রযোজনা সংস্থা যমুনা ফিল্ম কর্পোরেশন লিমিটেড। যমুনা ফিল্ম কর্পোরেশন লিমিটেড স্বত্বাধিকারীও শফি বিক্রমপুরী। এ সিনেমার সংলাপ রচয়িতা পানহাটার ছটকু আহমেদ ও চিত্রনাট্যকার শফি বিক্রমপুরী। ছবিটি ৩ মার্চ ১৯৯৫ সালে মুক্তি পায়। অভিনয় করেন সালমান শাহ ও মৌসুমি।
স্বপ্নের ঠিকানা ছবি এ্যাটলাস মুভিজ প্রযোজনা সংস্থার ব্যানারে প্রযোজনা করেন মো. নূরুল ইসলাম পারভেজ। ছবিটি পরিচালনা করেন এমএ খালেক। ছবিটি ১১ মে ১৯৯৫ সালে মুক্তি পায়। এ ছবিটির চিত্রনাট্যকার পানহাটার ছটকু আহমেদ ও নীতিশ সাহা। এ সিনেমায় সালমান শাহ, শাবনুর ও সোনিয়া অভিনয় করেন। ১৯ কোটি টাকা আয় করে।
‘আঞ্জুমান’ সিনেমাটি ১৮ আগস্ট ১৯৯৫ মুক্তি পায়। এ ছবির কাহিনীকার পানহাটার ছটকু আহমেদ। সংলাপ রচয়িতা ছটকু আহমেদ। সালমান শাহ্ ও শাবনাজ অভিনয় করেন।
‘আশা ভালোবাসা’ এ সিনেমাটি ১ ডিসেম্বর ১৯৯৫ মুক্তি পায়। সংলাপ রচয়িতা পানহাটার ছটকু আহমেদ। এ সিনেমাটিও আদৃতা চলচ্চিত্রের। এ সিনেমার কাহিনী ও চিত্রনাট্য রচনাও ছটকু আহমেদের অবদান রয়েছে। এ সিনেমায় সালমান শাহ, শাবনাজ ও সাবরিনা অভিনয় করেন।
‘সত্যের মৃত্যু নেই’ সিনেমাটি ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ সালে মুক্তি পায়। সালমান শাহ্ মৃত্যুর পর এ সিনেমাটিই প্রথম মুক্তি পায়। পরিচালক, সংলাপ রচয়িতা ও চিত্রনাট্যকার ছটকু আহমেদ। কাহিনীকার চট্টগ্রামের পানাউল্লাহ আহমেদ ও পানহাটার ছটকু আহমেদ। ১১ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা আয় করে।
৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ সালে মুক্তি পায় ‘বুকের ভেতর আগুন’। সালমান শাহ অভিনীত মুক্তিপ্রাপ্ত সর্বশেষ ছবি এটি। পরিচালনা করেন ছটকু আহমেদ। বুকের ভেতর আগুন সিনেমার চিত্রনাট্যকার ও কাহিনীকারও ছটকু আহমেদ। সিনেমাটি প্রযোজনা করেন মাহফুজা মুর্শেদ ও মসরুরাহ আহমেদ। এ ছবিতে সালমান পারিশ্রমিক নেন ২ লক্ষ টাকা। এটি ছিল সে সময় কোন নায়কের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক।
সালমান শাহ অভিনীত ২৭ টি সিনেমার মধ্যে ৮ টি সিনেমার সাথে জড়িত ছিলেন বিক্রমপুরের ব্যক্তিবর্গ। এছাড়াও সালমান অভিনীত আরো একাধিক ছবিতে বিক্রমপুরের মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে ছিলেন।
সালমান অভিনীত সিনেমাগুলোর মধ্যে-১৯৯৩ সালে মুক্তি পায় কেয়ামত থেকে কেয়ামত। ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায় তুমি আমার, অন্তরে অন্তরে, সুজন সখি, বিক্ষোভ, স্নেহ ও প্রেমযুদ্ধ ৬ টি সিনেমা।
১৯৯৫ সালে মুক্তি পায় দেনমোহর, কন্যাদান, স্বপ্নের ঠিকানা, আঞ্জুমান, মহামিলন ও আশা ভালোবাসা ৬ টি সিনেমা।
১৯৯৬ সালে মুক্তি পায় বিচার হবে, এই ঘর এই সংসার, প্রিয়জন, তোমাকে চাই, স্বপ্নের পৃথিবী, সত্যের মৃত্যু নাই, জীবন সংসার, মায়ের অধিকার ও চাওয়া থেকে পাওয়া ৯ টি ছবি। এ বছরের ৬ সেপ্টেম্বর সালমান শাহ মারা যান।
এছাড়াও সালমান শাহ’র বিচার হবে সিনেমার পরিবেশক ছিল হাসনাবাদ কথাচিত্র। এটিও বৃহত্তর বিক্রমপুরের কেরানীগঞ্জ থানার শেখ মুজিবুর রহমান প্রতিষ্ঠা করেন।
জীবন সংসার নির্মাণ করেন বৃহত্তর বিক্রমপুরের সন্তান মাদারীপুর কালকিনি খুনেরচরের জাকির হোসেন রাজু। এ ছবিটি ১৮ অক্টোবর ১৯৯৬ সালে মুক্তি পায়।
১৯৯৭ সালে মুক্তি পায় প্রেম পিয়াসী, স্বপ্নের নায়ক, শুধু তুমি, আনন্দ অশ্রু, বুকের ভেতর আগুন এ ৫ টি ছবি।
সালমান শাহ’র জীবনে আশ্চর্যজনকভাবে বিক্রমপুরে মানুষ জড়িয়ে ছিলেন। তাঁর প্রথম ছবি কেয়ামত থেকে কেয়ামত ও শেষ ছবি বুকের ভেতর আগুন। এ দুটি ছবিই বিক্রমপুরের শ্রীনগরের সুকুমার রঞ্জন ঘোষ ও পানহাটার ছটকু আহমেদ জড়িত ছিলেন। তাঁদের মাধ্যমে সালমান শাহ’র চলচ্চিত্র জীবন শুরু ও শেষ হয়।
একজন সালমান শাহ গড়ে উঠার ক্ষেত্রে মুন্সিগঞ্জের মানুষ যে অবদান রেখেছেন তা বাংলা সিনেমার ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদি সুকুমার রঞ্জন ঘোষ তাঁর আনন্দ মেলা সিনেমা লিমিটেড প্রযোজনা সংস্থার মাধ্যমে কেয়ামত থেকে কেয়ামত সিনেমা প্রযোজনা না করতেন হয়তো বাংলা সিনেমায় সালমান শাহ’র জন্মই হতো না। সালমান শাহ সৃষ্টি ও বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বিক্রমপুরের সন্তানদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ।
বিক্রমপুর লৌহজংয়ের মশদগাঁওয়ের সন্তান আব্দুল জব্বার খান (১৯১৬-১৯৯৩) যেমন প্রথম সবাক চলচ্চিত্র মুখ ও মুখোশ তৈরির মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসই পাল্টে দিলেন। তেমনি চলচ্চিত্রের বরপুত্র সালমান শাহকে তৈরির মাধ্যমে বিক্রমপুরের সন্তানরা এদেশের চলচ্চিত্র শিল্পকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সালমান শাহকে বাংলা চলচ্চিত্রে গল্প, সংলাপ ও চিত্রায়ণের মাধ্যমে যারা শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম পানহাটার ছটকু আহমেদ।
গুণী এ পরিচালক সালমান শাহ’র জীবন ভিত্তিক চলচ্চিত্র স্বপ্নের রাজকুমার নামে একটি ছবি নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সালমানের পরিবারের অনিচ্ছায় তিনি সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।
প্রাচীন বিক্রমপুর তথা মুন্সিগঞ্জ তার কৃতি সন্তানদের কর্মে যেমন ভারতবর্ষে খ্যাতি অর্জন করেছিল, তেমনি বাংলাদেশেও সেই ঐতিহ্য অটুট রয়েছে। বিক্রমপুরবাসীর বিশ্বাস— ভবিষ্যতেও এই গৌরব ও ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন থাকবে।


