টু উইমেন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতায় কুঁকড়ে যাওয়া মানবতার করুণ গাঁথা সবচেয়ে ভালভাবে তুলে এনেছিলেন ইতালিয় নির্মাতা ভিত্তোরিও ডি সিকা। আলবার্তো মোরাভিয়ার লেখা ‘টু উইমেন’ উপন্যাসকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন যুদ্ধের করাল গ্রাসে হারিয়ে যাওয়া এক মা-মেয়ের করুণ গল্প বলবার জন্য।
নাৎসিবাহিনীর আক্রমণে দিশাহারা হয়ে অন্যান্য রোমবাসীর সঙ্গে লাতসিওতে পালিয়ে আসে সেসিরা তার ১২ বছর বয়সী মেয়ে রোসেত্তাকে নিয়ে। একদিকে প্রাণ হারাবার ভয়, আর অন্যদিকে শত্রুশিবিরের লালসা থেকে নিজের মেয়েকে বাঁচাতে মায়ের সংগ্রাম- এর সবকিছুই ‘টু উইমেন’-এ উঠে আসে ডি সিকার নান্দনিকতায় ।
কিংবদন্তী অভিনেত্রী সোফিয়া লোরেন অভিনয় করেছিলেন এই সিনেমায় মা সেসিরার ভূমিকায়। এই চরিত্রে তার দুর্দান্ত অভিনয় তাকে এনে দিয়েছিল অস্কারসহ মোট ২২টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার। আজও সেলুলয়েডে সন্তানকে বাঁচাতে মায়ের সংগ্রামের অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে অমর হয়ে আছে ১৯৬০ সালের এই সিনেমাটি।
উত্তর ফাল্গুনী
‘উত্তর ফাল্গুনী’র একটি দৃশ্যে সুচিত্রা সেন
শ্রেণি বৈষম্য এবং সংগ্রামের এক করুণ চালচিত্র হিসেবেই নির্মাতা অসিত রায় বানিয়েছিলেন তার ‘উত্তর ফাল্গুনি’ সিনেমাটি। নিজের ক্যারিয়ারের সবচাইতে চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে এই সিনেমাতেই অভিনয় করেছিলেন মহিানায়িকা সুচিত্রা সেন। দ্বৈত চরিত্রে ওই সিনেমায় তিনি ছিলেন একজন মা, আবার একই সঙ্গে সেই মায়ের সন্তান্ও।
দারিদ্র নিপীড়িনের হাত থেকে শুধু মেয়ের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন মদ্যপ স্বামীর আশ্রয় থেকে। হয়ে যান পরপুরুষের বিনোদনের খোরাক এক বাঈজী। শুধু মেয়ে সুপর্নার ভরণপোষণ করার চিন্তা করেই দেবযানি লক্ষ্ণৌতে কাজ্ করেন পান্নাবাই নামে এক বাঈজী হিসেবে। ষাটের দশকের কলকাতার প্রেক্ষাপটে এমন এক গল্প সাড়া ফেলে দিয়েছিল সর্বত্র।
ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা বাংলা সিনেমার সাফল্য অর্জন করেছিল ১৯৬৩ সালে নির্মিত এই সিনেমা। পরবর্তীতে তিন বছর পর অসিত রায় হিন্দিতে সিনেমাটি পুননির্মাণ করেন ‘মামতা’ নামে, যেখানে আরও একবার দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা।মাতৃত্বের সংগ্রামের এক দৃষ্টান্ত হিসেবে এই সিনেমাটি এখনও অনবদ্য।
হাজার চৌরাসি কা মা
‘হাজার চৌরাসি কা মা’-এর একটি দৃশ্য
চারু মজুমদারের ইশতেহারের ডাকে নকশালবাড়ি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল অসংখ্য শিক্ষিত তরুণ। কলকাতায় তখন সময়টা সত্তরের দশক। অন্যান্য অনেক তরুণের মত কলেজপড়ুয়া ব্রতিও গিয়েছিল সে আন্দোলনে। কিন্তু বাড়িতে খবর এলো, সে ফিরেছে লাশ হয়ে। লেখাপড়ায় ভাল, আদরের সন্তান ব্রতী নয় বরং হাজার চুরাশি নাম্বার লাশের দায়িত্ব বুঝে নিতে বলা হয় তার মা, সুজাতাকে।
নকশালবাড়ি আন্দোলনে ছেলে হারানো এক মায়ের মর্মস্পর্শী এই গল্প লিখেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী, তার ‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসে। সেই গল্প থেকেই ভারতে ১৯৯৮ সালে নির্মিত হয় ‘হাজার চৌরাসি কা মা’। প্রায় ১৮ বছর পর সেলুলয়েডের জগতে ফিরে শোকাহত সেই মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন জয়া বচ্চন। কলকাতায় ষাট থেকে আশির দশকের মধ্যে বামপন্থী নকশালদের আন্দোলনে পুলিশি অত্যাচার এবং গুলিবর্ষণে নিহত হয়েছিল এরকম অসংখ্য তরুণ। গুমোট এই পরিস্থিতির বেদনাবহুল প্রেক্ষাপট পরিষ্কারভাবেই ধরা পড়েছিল জয়া বচ্চনের সুজাতা চ্যাটার্জি চরিত্রটিতে। গোভিন্দ নিহালানি নির্মিত ‘হাজার চৌরাশি কা মা’ সেবার পেয়েছিল সেরা ভারতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
টার্মস অফ এনডিয়ারমেন্ট
‘টার্মস অফ এনডিয়ারমেন্ট’-এর একটি দৃশ্য
বাবাহীন এমাকে আগলে রেখে অরোরা খুঁজে ফেরে সত্যিকারের ভালোবাসা। এদিকে এমাও বড় হয়ে জড়িয়ে পড়ে জটিল এক সম্পর্কে, নিজেও অর্জন করে মাতৃত্বের স্বাদ। তাদের চারপাশের পরিস্থিতি পরিবর্তন হতে শুরু করলেও একান্ত গুরুত্বপূর্ণ মূহুর্তে এই মা-মেয়ে দুজনেই এগিয়ে আসে একে অপরের সাহায্যে। মা-মেয়ের ত্রিশ বছরের এই গল্প নিয়েই ১৯৮৩ সালে মুক্তি পায় ‘টার্মস অফ এনডিয়ারমেন্ট’।
জেমস এল. ব্রুকস এর পরিচালনায় সিনেমাটি সেবার অস্কার আসর করে নিয়েছিল নিজেদের। এগারটি মনোনয়নের মাঝে জিতেছিল সেরা সিনেমার পুরস্কারসহ পাঁচটিতে। মা অরোরার চরিত্রে অভিনয় করা শার্লি ম্যাকলেইন জিতেছিলেন সেরা অভিনেত্রীর অস্কার।
দ্য ব্লাইন্ড সাইড
‘দ্য ব্লাউন্ড সাইড’-এর একটি দৃশ্য
ছোটবেলা থেকেই মাইকেল ওহারের স্বপ্ন ছিল, বড় হয়ে নামকরা ফুটবলার হবে সে। কিন্তু তার গায়ের কাল রঙই যে তার স্বপ্নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা! তার ওপর মাত্র ৭ বছর বয়সেই মাদকাসক্ত মায়ের কাছ থেকে পরিত্যাক্ত হয় সে। এভাবেই শিশু ওহারের স্বপ্ন সাদা মানুষদের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে হারিয়েই যেত, যদি না কৈশরে আরেক শেতাঙ্গ নারী মাতৃস্নেহে বুকে টেনে না নিতেন তাকে।
মার্কিন ফুটবল তারকা মাইকেল ওহার আর তার ‘মা’ লেই অ্যান টুওহির গল্প নিয়েই তৈরি হয়েছে ‘দ্য ব্লাইনইড সাইড’। রক্ত সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও দিশেহারা কৃষ্ণাঙ্গ এক কিশোরকে নিজের ছেলের মত আগলে রাখা এক শ্বেতাঙ্গ নারীর এই গল্প সেলুলয়েডের পর্দায় অনন্য। তাইতো, ২০০৯ সালে জন লি হ্যানক নির্মিত এই সিনেমাটিতে লেই অ্যান এর ভূমিকায় অভিনয় স্যান্ড্রা বুলককে এনে দিয়েছিল সেরা অভিনেত্রীর অস্কার।