মুন্সিগঞ্জ, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ডেস্ক রিপোর্ট (আমার বিক্রমপুর)
মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর গ্রামে আদিলুর রহমান খানদের বাড়ি। বাড়িটি ঘিরে অনেক ঘটনা ও ঐতিহাসিক স্মৃতিও আছে।
১৯৭১ সনের ১২ই মে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী এই গ্রামে প্রবেশ করে। তিনজন পাকিস্তানী সৈন্য কাছেরই ধোপাবাড়ীর ২০/২১ বছরের দুইটি হিন্দু মেয়েকে তাড়া করে। মেয়ে দুইটি দৌঁড়ে এই বাড়ীতে এসে আশ্রয় চায়। তাদেরকে এই দক্ষিণের ঘরে আশ্রয় দেয়া হয়। দক্ষিণের ঘরটির পূর্বাংশে ছিলো রান্নাঘর এবং পশ্চিমাংশে খাবার ঘর। মাঝখানে পার্টিশন। প্রায় সাথে সাথে স্টেনগান রাইফেল হাতে নিয়ে তিনজন পাকিস্তানী সৈন্য বাড়ীতে প্রবেশ করে। তাদের একজন আদিলুর রহমান খানের এক চাচার বুকে চাইনিজ রাইফেল ঠেকিয়ে মেয়ে দুইটি কোথায় জানতে চায়। চাচা দূরে বাহিরবাড়ীর বৈঠকখানা দেখিয়ে দেয়।
সৈন্যরা সেখানে গিয়ে কাউকে না পেয়ে ফিরে আসে এবং সবাইকে বের করে এই উত্তরঘরের সামনে লাইন করে দাঁড় করায়। ২২ জন ছোটবড় পুরুষ দাঁড়িয়ে ছিলেন। এঁদের অধিকাংশ ছাত্র এবং বড়দের মধ্যে ছিলেন আদিলুর রহমান খানের ছোট দাদাভাই অবসরপ্রাপ্ত জেলা মেজিস্ট্রেট, চাচা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ও অন্যান্য।
সৈন্য তিনজন রাইফেল ও স্টেনগান উঁচিয়ে শেষবারের মতো ওয়ার্নিং দেয় যে হিন্দু মেয়ে দুইটি কোথায় এখনই জানাতে হবে, নইলে গুলি করে সবাইকে হত্যা করা হবে। ছোটবড় সবাই জানতো ঠিক উল্টো দিকে ২০ ফুট দূরে দক্ষিণের ঘরে মেয়ে দুইটি আছে। কিন্তু মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও বড়ছোট কেউ একটি কথাও বলেনি। হিন্দু মেয়ে দুইটিকে রক্ষা করা নিজেদের জীবনের বিনিময়ে হলেও শ্রেয় বলে তাঁরা মনে করেছে। এ
রই মধ্যে হঠাৎ করে লাইনে থাকা আদিলের এক কাজিন বিশুদ্ধ উর্দুতে সৈন্যদের সাথে কথা বলতে থাকে। ১৩/১৪ বছরের এই কাজিন তাঁর বাবার সাথে পশ্চিম পাকিস্তানে থেকেছে। তাই উর্দু ভাল শিখেছে। ধীরে ধীরে পাকিস্তানী সৈন্যদের মধ্যে পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। তারা বন্ধুক নামিয়ে ফেলে এবং মেয়ে দুইটির খোঁজ পেলে তাদের যেন খবর দেয়া হয় বলে এই বাড়ী ত্যাগ করে। এই ভাবে নিশ্চিত মৃত্যু থেকে ২২ জন মানুষ বেঁচে যায়। এই উত্তরের ঘরের সামনে এই ঘটনাটি ঘটেছিল।
এক সময় এই বাড়ীটি অতি পরিপাটি ছিল। এমন ভগ্নদশা ছিলো না। লোকজনে গম গম করতো। প্রতি বৃহস্পতিবার বৃহস্পতিবারের সিন্নি হতো, রোজার সময় রোজাদার খাওয়ানোর ব্যবস্থা হতো। মহররমের সিন্নি হতো, কোরবানী হতো। ধান মাড়ানো, পাট তোলা প্রভৃতি কর্মকান্ডে বাড়িটি সব সময় প্রাণবন্ত থাকতো। সিন্নিসলাত ও রান্না তৈরীর জন্য ডেকোরেটরদের মতো বড় বড় ডেকচি, লোহার হাতল ওয়ালা বড় বড় চামচ থাকতো। এসবের কত্রী ছিলেন আদিলুর রহমান খানের দাদী জমরদননেসা খাতুন। তাঁরই নির্দেশ ও পরিকল্পনায় এসব কর্ম সাধিত হতো।
দাদী ছিলেন এই গ্রামেরই অত্যন্ত প্রভাবশালী পরিবার ষোলঘর কাজীবাড়ীর জ্যেষ্ঠ কন্যা। তাঁর পরিবার ছিলেন ভূস্বামী এবং বিস্তর জমিজমার মালিক। ঢাকা কালেক্টরীতে তাঁদের নামে বিভিন্ন তৌজী আছে। তাঁদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে দুইজন ‘কাজী’ বা বিচারক ছিলেন। সেই সূত্রে পরিবারটি ‘কাজী’ উপাধি বহন করে।
প্রায় চারশত বছর পূর্বে দিল্লী থেকে কাজীদের পূর্বপুরুষ ষোলঘর এসে বসবাস করেন। তাঁদের বসতির স্থান ‘জালালের ভিটি’ এখনও খৈয়াগাঁও অঞ্চলে বিদ্যমান আছে। দাদীর বড়ভাই কাজী শামসুল হুদা বৃটিশ আমলে ত্রিশ বছর ষোলঘর ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
আদিলুর রহমান খানের বড় দাদাভাই আজিজুর রহমান খান কলকাতায় সরকারী চাকুরী করতেন। তিনি অত্যন্ত ধার্মিক ও পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন। বাংলা ইংরেজী ছাড়াও আরবী ফার্সী ও উর্দুভাষায় তিনি বিশেষ পারদর্শী ছিলেন।
পরিবারের ছেলেমেয়েদের জন্য তিনি এই বাড়ীতে অতি মূল্যবান একটি পারিবারিক গ্রন্থাগার তৈরী করে দিয়েছিলেন। বাংলা ও ইংরেজী ভাষার সাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়ের নামকরা পুস্তকাদি এই পারিবারিক গ্রন্থাগারটিতে ছিল।
এছাড়া মাসিক মোহাম্মদ, প্রবাসী, বঙ্গবাণী, সওগাত, রংমশাল, কৈশোরক, মৌচাক, প্রভৃতি মাসিক সাময়িকীগুলি নিয়মিত এই বাড়ীতে আসতো। সংবাদপত্র দৈনিক আজাদও নিয়মিত আসতো। আজিজুর রহমান খান সাহেবের ব্যক্তিগত সংগ্রহে অতি মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য আরবী ফার্সি ও উর্দু বই ছিল। ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বইও তাঁর সংগ্রহে ছিল। এই পারিবারিক গ্রন্থগারটি সবসময় পরিবারের সন্তানদের জ্ঞানচর্চ্চায় উদ্বুদ্ধ করেছে।
আদিলুর রহমান খানের বড় ফুফু ১৯৩০ দশকে এই বাড়ী থেকে রংমশাল পত্রিকায় গল্প লেখা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দ্বিতীয় হয়েছিলেন। তাঁর গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল এবং তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বই পুরস্কার পেয়েছিলেন। একশত বছর পূর্বে ১৯২৫ সনে আদিলুর রহমান খানের ছোটদাদাভাই আলতাফুর রহমান খান বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়েছিলেন এবং ডেপুটী ম্যাজিস্ট্রেট হয়েছিলেন। সেই থেকে লোকজন এই বাড়িটিকে ডেপুটিবাড়ী বলে ডেকে থাকে।
আদিলুর রহমান খানের পিতা ডা. আশেকুর রহমান খান ঢাকা মেডিকেল কলেজ (১৯৪৬) এর প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। তিনি পি-জি হাসপাতাল (বর্তমানের বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি) এর মেডিকেল সুপারইন্টেন্ডেন্ট ছিলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডাইরেক্টর ছিলেন। ১৯৭১ সনে তিনি সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন। সেই সময় নদীর পাড়ে অবস্থিত এই হাসপাতালে গুরুতর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি চিকিৎসার ব্যবস্থা করতেন।
মাতা আখতার জাহান ফরিদা বানু ঢাকা কলেজ এবং পরে ইডেন গার্লস কলেজে বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ছিলেন। আদিলুর রহমান খানের স্ত্রী ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের অধ্যাপক। জ্যেষ্ঠপুত্র আইনজীবী এবং ইংল্যান্ড থেকে আইনে উচ্চতর ডিগ্রি প্রাপ্ত।
আদিলুর রহমান খানের আত্মীয়স্বজন সবাই উচ্চ শিক্ষিত। তাঁর এক চাচা ড. আনোয়ারুর রহমান খান (ড. এ.আর. খান) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ছিলেন। আরেক চাচা ড. আতাউর রহমান খান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস ও পরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন।
অন্যান্য চাচাদের মধ্যে আশফাকুর রহমান খান ১৯৭১ সনে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত। আরেক চাচা ডা. আমানুর রহমান খান ১৯৭১ সনে ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীর নেতৃত্বে ঢাকা-মানিকগঞ্জ অঞ্চলে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য সেখানে ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দিয়েছেন। আদিলুর রহমানের এক বোন ডাক্তার ও বারডেমে কনসালটেন্ট। আরেকজন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী। আরেক বোন লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্স (LSE) থেকে পরিবেশ অর্থনীতিতে ডিগ্রি প্রাপ্ত। আদিলুর রহমান খানের আত্মীয়স্বজনের সংখ্যা বড় ও বিস্তৃত। তাঁদের মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দও আছেন। আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে সবসময় সুসম্পর্ক ও সৌহার্দ্যের সম্পর্ক বহাল ও বজায় থেকেছে এবং রয়েছে।
উপদেষ্টা হওয়ার চেয়ে আদিলুর রহমান খানের প্রধান এবং বড় পরিচয় একজন মানবাধিকার কর্মী হিসাবে। বাংলাদেশে তাঁর মানবাধিকার কর্মের জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ এবং এশিয়ার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন দেশ থেকে তাঁকে মানবাধিকার পুরষ্কার দিয়ে সম্মানিত করা হয়েছে।
প্রায় পাঁচশত বছর পূর্বে একজন সাহসী ইসলাম ধর্ম প্রচারক রনম খান আফগানিস্তান থেকে বাংলাদেশে এসে পাবনা জেলার চৌহালীর অন্তর্গত ফুলহারা অঞ্চলে বসবাস ও ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু করেন। তাঁরই পরিবারের একটি প্রশাখা ষোলঘরের এই বাড়ীতে বসতি স্থাপন করেন। আদিলুর রহমান খান তাঁর প্রজন্ম।
সম্ভবত; সেই কারনে তিনি পূর্বপুরুষদের সাহস ও চারিত্রিক দৃঢ়তা ও অন্যান্য বিশিষ্ট গুণগুলি অর্জন করেছেন।