২০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
রবিবার | রাত ৩:১২
আজ বাংলাদেশের সাফ-মিশন শুরু
খবরটি শেয়ার করুন:

সামনে ফোয়ারাটার অবিশ্রান্ত জলকল্লোল। চারপাশে শান্ত, সিগ্ধতা। তবু ত্রিবান্দ্রাম শহরের পাঁচ তারকা হোটেলের জীবনটা মামুনুলদের কাছে একটু অসহনীয়ই হয়ে উঠেছে। সময়টা উপভোগ করতে পারছেন না। শৃঙ্খলাবদ্ধ মন নিয়েও সারাক্ষণ একটা অদৃশ্য চাপের সঙ্গেই যেন বসবাস। কারও সঙ্গে কথা বলবেন, অমনি নিঃশব্দে সামনে এসে দাঁড়ায় ছয় অক্ষরের একটা দেশের নাম—আফগানিস্তান।
হোটেলের চার দেয়ালের বাইরে খেলোয়াড়দের মনোজগৎ আফগানিস্তানে এমনভাবে আচ্ছন্ন যে, ম্যাচটা হারলে যেন পৃথিবী শেষ হয়ে যাবে! আসলে তো তা নয়। আফগানিস্তানের পরও মালদ্বীপ ও ভুটানের সঙ্গে আরও দুটি ম্যাচ থাকবে। কিন্তু এই ম্যাচটিই যেন লড়াইয়ের বারুদ জ্বালিয়ে দিচ্ছে মনের মধ্যে। আফগানিস্তানের কাছে হারলে পরের দুটি ম্যাচ জিতে বাংলাদেশ সাফের সেমিফাইনালে উঠবে সেই নিশ্চয়তা তো নেই।
এ জন্যই আফগানিস্তান অন্তহীন এক চাপের নাম। আজ বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৭টায় শুরু ম্যাচে জানা যাবে মামুনুলরা চাপটা উতরে গেলেন নাকি চ্যাপ্টা হয়ে পড়লেন। গোটা বাংলাদেশ চাইবে প্রথমটাই হোক। কেরালায় বসেও লিখে দেওয়া যাচ্ছে, আজ বাংলাদেশ দলের দিকে তাকিয়ে থাকবে আমজনতা। কারণ সাফটা তো শুধু একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মঞ্চ নয়। এটি এই অঞ্চলের ‘বিশ্বকাপ’ এবং বাংলাদেশ এই কাপটা ২০০৩ সালে ঘরের মাঠে জেতার পর আর হাতে তোলার অধিকার পায়নি।
এবার তা ফিরিয়ে নিতে সেই কবে থেকেই দেশের ফুটবলে একটা আশার ফুলকি উড়ছে—সাফ শ্রেষ্ঠত্বটা আবার পাবে বাংলাদেশ। গত চারটি সাফের তিনটিতেই গ্রুপ থেকে বিদায়ের হতাশা মুছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফুটবলারই আকাঙ্ক্ষাটা জাগিয়ে দিয়েছেন নতুন করে। এ কারণেই কংগ্রেসের ঘাঁটি কেরালায় বাংলাদেশ শিবিরে যেন জ্বলছে সাফল্যের নীরব মশাল। তাই আফগানিস্তান ম্যাচটা সবুজ ঘাসে রুদ্ধশ্বাস লড়াই ছাপিয়ে হয়ে উঠতে পারে সাফল্যের প্রথম বীজ!
কোচ মারফুল হক বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব নিয়ে সময় পেয়েছেন মাত্র ২১ দিন। তবে তিনি এটিকে বড় করে না দেখে আফগান-বাধা পেরোনো সম্ভবই শুধু নয়, সাফের বিজয়মঞ্চে ওঠার স্বপ্নটাও দেখিয়েছেন দলকে। সেই যাত্রার প্রথমেই আফগানিস্তান নামের বড় পরীক্ষা। এই আফগানিস্তান আজ রক্তমাংসের মানুষদের একটা দল নয়, একটা দেয়াল।
তাই ড্র হলেও বাংলাদেশের জন্য হবে জয়েরই সমান। বাংলাদেশ দল সেটি অনুচ্চারেই বুঝিয়ে দিচ্ছে। এবং ড্র করা সম্ভব এই কারণে যে, আফগানদের কাছে কখনো হারেনি বাংলাদেশ। পাঁচ সাক্ষাতে চার ড্রয়ের বিপরীতে এক জয়। ঢাকায় গত জুনে দুই দলের প্রীতি ম্যাচটা ছিল ১-১। তবে পরিসংখ্যান কচলে সরলীকরণ করা ভুল। আফগানিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবলে মুকুটধারীই শুধু নয়, মানের দিক থেকে এক ধাপ ওপরের সিঁড়িতেই পা রেখেছে।
ইউরোপে খেলা ১৮ জন যোদ্ধা নিয়ে এখন অনেক বেশি পরাক্রমশালী একসময়ের যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি। তবে সবুজ কেরালায় এসে আফগানদের মেজাজ যেমন তিরিক্ষি হয়ে আছে সেটির ছাপ মাঠে পড়লে বাংলাদেশ কিন্তু সুবিধা নিতে পারে। এখানে যে হোটেলে দলটি থাকতে চেয়েছিল, সেখানে জায়গা না পেয়ে টুর্নামেন্ট ‘বয়কটে’রই হুমকি দিয়ে বসেছিল! হোটেল সমস্যার আপাতসমাধানের পর অনুশীলন-সুবিধা নেই, মাঠে যেতে গাড়ি পায় না ইত্যাদি নিয়ে দলটির কোচ পিটার সিগ্রাত পরশু সংবাদ সম্মেলনে বোমাই ফাটিয়েছেন। দৃশ্যত আফগানদের মন মাঠের বাইরের বিষয়েই বেশি নিবদ্ধ। বাংলাদেশ দলের কারও কারও ভাষায়, চলনবলনে একটু নাক-উঁচু ভাবও দেখাচ্ছে ওরা।
কাল সকালে বাংলাদেশ দলের টিম হোটেলে দর্শন মিলল আফগান কোচের। খুবই ব্যস্ত মানুষ। কথা বলার ফুরসতই নেই। তবু ম্যাচটা নিয়ে জানতে চাইলে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, ‘জেন্টলম্যান, অনেক কিছু বলা যাবে না।’ যতটুকু বলা যায় সেই রাস্তায় হেঁটে সংবাদ সম্মেলনের মতো এদিনও দেখালেন সম্মান, ‘আমরা তো বাংলাদেশকে হালকা করে দেখছি না। এখানে সবাই সমান।’
তবে মুখে এটা বললেও অন্তরে বাংলাদেশকে অতটা শক্ত প্রতিপক্ষ ভাবছে না আফগানিস্তান। এটাও বাংলাদেশের জন্য বাড়তি রসদ। ১১ খেলোয়াড়ের সঙ্গে কোচ মারুফের মস্তিষ্কও তো আছে। তবে মারুফ মনে করিয়ে দিতে ভোলেননি, ‘আমি যা-ই পরিকল্পনা করি না কেন খেলতে হবে ফুটবলারদেরই।’
বিকেলে ঘণ্টা খানেক দূরত্বের অনুশীলন মাঠে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে নিজের রুমে বসে মারুফুলকে আত্মবিশ্বাসীই লাগল। কয়েক দিন ধরে যেমন নিরন্তর নিজের ড্রয়িং বোর্ডে আফগানদের নিয়ে কাটাছেঁড়া করেছেন, শেষবেলায় সারমর্ম টানলেন এভাবে, ‘এটি অনেকটা ফাইনাল আমাদের কাছে। আফগানরা হয়তো এগিয়ে। তবে অজেয় নয়।’
লবিতে এসে বাসে ওঠার জন্য অপেক্ষমাণ মামুনুলদের ভিড়ে কথাটা ছেড়ে দিতেই সমস্বরে আওয়াজ এল, অবশ্যই আফগানিস্তান বাইরের জগৎ থেকে আসেনি। সংকল্পবদ্ধ খেলোয়াড়দের শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। অধিনায়ক নিজেই বললেন, ‘সময় এসেছে মাঠে কিছু করে দেখানোর। অবশ্যই জিততে চাই। এ জন্য অগ্রণী ভূমিকাটা আমি নিজেই নেব।’
মাঠেও এর ছোঁয়া থাকলে শুভসূচনাই হতে পারে সাফে।

error: দুঃখিত!