মুন্সিগঞ্জ, ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, শিহাব আহমেদ, সেন্টমার্টিন থেকে ফিরে (আমার বিক্রমপুর)
সেন্টমার্টিন- চারিদিকে নীল জলরাশি বেষ্টিত জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ।
নারিকেল গাছের আধিক্য থাকায় দ্বীপটিকে নারিকেল জিঞ্জিরা নামেও ডাকা হয়। বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ এই দ্বীপ নিয়ে দারুচিনি দ্বীপ ও রুপালী দ্বীপ নামে দুটি উপন্যাস লিখেছিলেন।
ভিডিও প্রতিবেদন:
প্রশাসনিকভাবে দ্বীপটি সেন্টমার্টিন নামেই পরিচিত। সেন্টমার্টিন দ্বীপ বাংলাদেশের চট্রগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলার টেকনাফ হতে প্রায় ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে ও মায়ানমার উপকূল হতে ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে নাফ নদীর মোহনায় অবস্থিত। এর দৈর্ঘ্য ৮ বর্গকিলোমিটার।
বাংলাদেশের জনপ্রিয় পর্যটন এলাকাগুলোর মধ্যে সেন্টমার্টিন অন্যতম। চারিদিকে নীল পানি, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা প্রাকৃতিক জীববৈচিত্র্য পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।
প্রতিবছর শীত মৌসুমে অসংখ্য পর্যটক ছুটে আসে সেন্টমার্টিনে। টেকনাফ থেকে সাগরপথে সেন্টমার্টিনে যাওয়ার পথে জাহাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে উড়ে বেড়ানো ঝাঁকে ঝাঁকে গাঙচিল যে কাউকে মুগ্ধ করবে। মনে হবে গাঙচিলগুলো আপনাকে সেন্টমার্টিনে স্বাগত জানাচ্ছে।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, সেন্ট মার্টিন দ্বীপে প্রায় ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১শ ৮৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ১শ ৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১শ ৫৭ প্রজাতির গুপ্তজীবী উদ্ভিদ, ২শ ৪০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, চার প্রজাতির উভচর ও ১শ ২০ প্রজাতির পাখি দেখা যায়।
প্রতিবছর নভেম্বর থেকে পরবর্তী ৪ মাস সেন্ট মার্টিন দ্বীপ উন্মুক্ত থাকে। এই ৪ মাসে দৈনিক গড়ে ৩-৪ হাজার পর্যটক সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে আসে। ছোট ছোট পর্যটকবাহী জাহাজ, লঞ্চ, ক্যাটামারান ও বিআইডব্লিউটিসির সি ট্রাক টেকনাফ দমদমিয়া ঘাট থেকে ছেড়ে আসে সেন্টমার্টিনের জেটিঘাটে। একেকটি নৌযানে গড়ে ২০০ থেকে ৪০০ আসন রয়েছে। কমপক্ষে ৭-৯ টি নৌ যান এই রুটে নিয়মিত চলাচল করে।
সেন্টমার্টিনে রাতযাপনের জন্য নানা ক্যাটেগরির হোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে। প্রকারভেদে ১ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ করে এখানে প্রতিরাত থাকা যায়।
পছন্দ অনুযায়ী খাবার খেতে পারেন। সেন্টমার্টিনজুড়েই রয়েছে বাংলাদেশী নানা রকমের খাবারের হোটেল। পর্যটকদের কাছে চাহিদা বেশি সামুদ্রিক মাছের। মুরগির মাংস বা গরুর মাংস খুব একটা পাওয়া যায় না। সপ্তাহে একদিন একটি মাত্র গরু জবাই দেয়া হয় পর্যটকদের খাওয়ানোর জন্য। তাই গরুর মাংসের দাম চড়া।
সেন্টমার্টিনে সব খাবারের দাম সাধারণ খাবারের দোকানের চেয়ে সবসময়ের জন্য একটু বেশি।
সেন্টমার্টিনে পর্যটকরা ‘ডাব’ খেতে পছন্দ করেন। এখানকার স্থানীয় ডাব খুবই মিষ্টি। বর্তমানে সেন্টমার্টিনে যে ডাব দেখা যায় সেগুলো বাইরের জেলার।
পর্যটকরা সামুদ্রিক কাকড়া, লবস্টার ও রুপচাঁদা বেশি খেয়ে থাকেন। তাজা মাছ কিনে, ভেজে, রান্না করে বা বারবিকিউ করে খেয়ে থাকেন পর্যটকরা। মাছের দাম খুব একটা বেশি নয়।
সেন্ট মার্টিনের স্থায়ী বাসিন্দাদের জীবন ব্যবস্থা খুবই সাধারণ ও রক্ষণশীল। ৯ টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত সেন্টমার্টিন ইউনিয়নে প্রায় ৭ হাজার লোকের বসবাস। যার প্রায় শতভাগই মুসলিম। সেন্টমার্টিনে বছরের যে ৪ মাস পর্যটক আসে তখন স্থানীয় লোকজন পর্যটক সেবা দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। বছরের বাকি ৮ মাস এরা সমুদ্রে মাছ ধরা ও শুটকি প্রক্রিয়াকরণ করেন। কৃষিকাজও করেন কেউ কেউ। সেটা খুবই সামান্য।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়নে সাক্ষরতার হার ১৫.১৩%। ইউনিয়নটিতে ১ টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৩ টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়া রয়েছে একটি মাদ্রাসা। দ্বীপের বাসিন্দাদের জন্য রয়েছে ১০ শয্যা বিশিষ্ট একটি হাসপাতাল। এছাড়া রয়েছে সরকারি ডাকবাংলো ও একটি পুলিশ ফাড়ি।
অনিয়ন্ত্রিত জাহাজ ও ইঞ্জিনচালিত নৌকার চলাচল, মাত্রাতিরিক্ত মৎস্য সম্পদ আহরণ, সমুদ্রে বর্জ্য ও ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ নিক্ষেপ, প্রবাল উপনিবেশ ধ্বংস, জীববৈচিত্র্য হ্রাস ও জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সম্প্রতি সেন্টমার্টিন দ্বীপ সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরের ১ হাজার ৭৪৩ বর্গ কিমি এলাকাকে ‘সেন্টমার্টিন মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া’ ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ সরকার। সরকারের সহযোগি হিসেবে কাজ করছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা (এনজিও)।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও চেষ্টা করছেন সকল উদ্যোগের সাথে সংহতি জানিয়ে স্থানীয়ভাবে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সেন্টমার্টিন দ্বীপটিকে প্রকৃতির স্বর্গ হিসেবে গড়ে তুলতে।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলছেন, সেন্টমার্টিনের পরিবেশ ও প্রতিবেশ সংরক্ষণে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের উদ্যোগে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে বেশ কয়েক দফা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সেন্টমার্টিনের যারা বাসিন্দা তাদের পাশাপাশি আগত পর্যটকদের কিভাবে আরও সচেতন করা যায় সে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে আমরা কাজ করছি। শীঘ্রই আমাদের নিজস্ব মাঠকর্মী নিয়োগ করবো।
বাংলাদেশ সরকার, বিভিন্ন এনজিও ও স্থানীয় প্রশাসনের এসব উদ্যোগকে স্বাগত জানাচ্ছেন পর্যটকরাও।
জনপ্রিয় ব্যান্ড অ্যাশেসের সঙ্গীতশিল্পী জুনায়েদ ইভান বলছেন, সেন্টমার্টিন একটি আন্তর্জাতিক মানের জায়গা। আমরা যারা এখানে পর্যটনে আসছি তাদের যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলা থেকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
ফ্যাশন মডেল মৌরিন মৌ বলছেন, সেন্টমার্টিনের সাগরপাড় ময়লার স্তুপে পরিণত হচ্ছে। প্রতিটি দোকানের সামনে ডাষ্টবিন দেয়া থাকলেও পর্যটকরা চিপস, চানাচুরের প্যাকেট, সিগারেটের ফেলে দেয়া অংশ ইত্যাদি ইত্যাদি অসচেতনভাবে যেখানে সেখানে ফেলছে। এটা মোটেই ঠিক নয়। আমাদের সেন্টমার্টিন আমাদের নিজেদেরই পরিস্কার রাখতে হবে।
মানুষকে সচেতন করতে পারলেই সেন্টমার্টিন দূষণ রোধ করা যাবে এমন ধারণা থেকে সম্প্রতি কুড়িয়ে পাওয়া প্লাষ্টিক দিয়ে পশ্চিম সৈকতের বালুচরে তৈরি করা হয়েছে মাছের ভাস্কর্য।
সেন্টমার্টিনে আসা পর্যটকদের পছন্দের আরেকটি জায়গা হলো ছেঁড়া দ্বীপ। সেন্টমার্টিনের মূল ভূখন্ড থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দক্ষিণে ১০০ থেকে ৫০০ বর্গমিটার আয়তনের ছোট এই দ্বীপটি ছেড়াদিয়া বা ছেঁড়া দ্বীপ নামে পরিচিত।
সেন্টমার্টিন জেটিঘাট থেকে দিনের যে কোন সময় ট্রলার, লাইভবোট বা স্পিডবোট নিয়ে যাওয়া যাবে ছেঁড়া দ্বীপে। খরচ পরবে প্রতিজন ২০০-৩০০ টাকা। অল্প সময়ের জন্য সেখানে গিয়ে আবার ফেরত আসতে হবে। সাইকেল বা মোটরসাইকেল ভাড়া নিয়েও যাওয়া যায় ছেড়াদ্বীপে। সেন্টমার্টিন বাজারে ঘন্টা প্রতি ভাড়ায় সাইকেল ও মোটরসাইকেল পাওয়া যায়।
ছেঁড়াদ্বীপে থাকা বা খাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। তাই সাথে করে শুকনা খাবার ও পানি নিতে পারেন। তবে এসব খাবারের বর্জ্য কোনভাবেই ছেড়াদ্বীপে ফেলে আসা ঠিক হবে না।
ঢাকা থেকে সেন্টমার্টিনে যেতে হলে প্রথমে টেকনাফ যেতে হবে। সময় লাগবে প্রায় ৮ ঘন্টা। খরচ হবে ১ হাজার থেকে ১৫০০ টাকা। টেকনাফ জেটি ঘাট থেকে নৌযানে করে যেতে হবে সেন্টমার্টিন দ্বীপে। শিপের টিকেট ঘাটেই নির্দিষ্ট কাউন্টারে পাওয়া যায়। তবে অনলাইনে আগে কেটে রাখলে ঝামেলা কমে আসবে। টেকনাফ জেটিঘাট থেকে সেন্টমার্টিন জেটিঘাটে নৌপথে পৌছাতে সময় লাগবে আড়াই থেকে ৩ ঘন্টা৷
এছাড়া চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার রাত ১১টায় ছেড়ে পরদিন সকাল ৭টায় সেন্টমার্টিন পৌঁছায় বিলাসবহুল জাহাজ বে ওয়ান ক্রুজ।
বাংলাদেশের সেরা দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে শীর্ষ সেন্টমার্টিন দ্বীপ সামনের বছরগুলোতে আরও পর্যটক আকৃষ্ট করতে পারবে সেই প্রত্যাশা সংশ্লিষ্ট সকলের।