‘ভূমিকথা’: ভূমিসচেতন নাগরিক গড়তে মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসনের ব্যতিক্রমী উদ্যোগ
মুন্সিগঞ্জ, ১৬ নভেম্বর ২০২৫, নিজস্ব প্রতিবেদক (আমার বিক্রমপুর)
দেশের অসংখ্য দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার প্রধান উৎস-ভূমি সংক্রান্ত জটিলতা। এই সমস্যা নিরসনে আইনি কাঠামোর পাশাপাশি প্রয়োজন একটি সচেতন প্রজন্ম। এই ভাবনা থেকেই মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসন এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছে: স্কুলের পাঠ্যক্রমে নয়, বরং একটি নিজস্ব পুস্তিকা ‘ভূমিকথা’-র মাধ্যমে ভবিষ্যতের নাগরিকদের ভূমিসচেতন করে তোলার কাজ শুরু করেছে তারা।
সম্প্রতি এই কর্মসূচি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এবং দেশের অন্যান্য প্রান্তের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে মডেল কার্যক্রম হিসাবে অনুসরণীয় হয়ে উঠেছে। ভূমি বিষয়ক মৌলিক জ্ঞান, আইন ও সেবা সম্পর্কে নাগরিকদের সচেতনতা বৃদ্ধির উপর জোর দেওয়া পুস্তিকাটি সাধারণ নাগরিক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের কাছে অত্যন্ত সহজ ও প্রাঞ্জল ভাষায় ভূমি বিষয়ক মৌলিক ধারণাগুলো তুলে ধরছে।
জানা যায়, মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ফাতেমা তুল জান্নাতের ঐকান্তিক ইচ্ছা, পরিকল্পনা ও সঠিক দিক-নির্দেশনায় এই প্রকল্পটি আলোর মুখ দেখেছে। ভূমি ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও নাগরিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই ছিল এই পুস্তিকা প্রকাশের মূল লক্ষ্য। বর্তমানে ভূমি বিষয়ক সেবা গ্রহণ পদ্ধতির ডিজিটাল পদ্ধতি চালু থাকলেও সে সম্পর্কে ব্যাপক অজ্ঞতা রয়েছে। অনেকে জানেন না কোন সেবা কোথায় পাওয়া যায়, কীভাবে দলিল তৈরি করতে হয় বা নামজারি করতে হয়। এই অজ্ঞতার কারণে সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হন এবং প্রতারিত হন। এই প্রেক্ষাপটে ‘ভূমিকথা’ সাধারণ নাগরিককে ভূমি বিষয়ক মৌলিক ধারণা, প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস এবং আধুনিক ডিজিটাল সেবাসমূহ সম্পর্কে সচেতন করতে সহায়ক হবে। এটি ভূমি সম্পর্কিত ভুল ধারণা দূর করে ভোগান্তি কমাতে সাহায্য করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
‘ভূমিকথা’ নামক ৯৪ পৃষ্ঠার পুস্তিকাটি ভূমি সংক্রান্ত মৌলিক জ্ঞান ও সেবা সম্পর্কিত তথ্যসমৃদ্ধ একটি সহায়িকা হিসেবে কাজ করছে। এটি ভূমি সংক্রান্ত বিদ্যমান ও প্রচলিত সরকারি আইন/বিধিমালা/নীতিমালা/পরিপত্র অনুসরণ করে প্রণীত। পুস্তিকাটিতে ভূমি কেনার আগে কী কী যাচাই করতে হয়, ভূমি রেজিস্ট্রেশনের সময় কী কী কাগজপত্র লাগে, নামজারি কীভাবে করতে হয়, ভূমি উন্নয়ন কর কীভাবে ও কেন পরিশোধ করতে হয়, ভূমি সেবা সংক্রান্ত অফিসসমূহ ও প্রদেয় সেবাসমূহ, ভূমি বিরোধ/মামলা কীভাবে ও কোথায় নিষ্পত্তি হয়, ভূমি অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার আইন, ২০২০ এবং অনলাইন/ডিজিটাল ভূমি সেবাসমূহ এর মতো গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল জিজ্ঞাসিত বিষয়গুলো সহজ ও বাস্তবধর্মী ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে।
‘ভূমিকথা’র সম্পাদক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শরীফ উল্যাহ জানান, উত্তরাধিকার আইন, হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের সারসংক্ষেপসহ ভূমি সংক্রান্ত ব্যবহারিক শব্দাবলির (ইংরেজি থেকে বাংলা) পরিচিতিও এই বইয়ে তুলে ধরা হয়েছে। ভূমি বিষয়ক এই জ্ঞান নিয়ে কেউ পেশা গড়তে চাইলে তার জন্যও এটি একটি মূল্যবান পুস্তিকা। জেলা প্রশাসনের পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রাথমিকভাবে জেলার সকল স্কুল-কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে এটি বিতরণ করা হচ্ছে এবং এটি নিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেমিনার ও কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। উদ্যোক্তারা আশা করছেন, পর্যায়ক্রমে এই পুস্তিকাটি বাংলাদেশের সকল নাগরিক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের হাতে পৌঁছাতে পারলে ভূমি বিষয়ক কার্যক্রম আরও বেশি ফলপ্রসূ হবে। তিনি বলেন, ‘জেলা প্রশাসকের এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ ভবিষ্যতে ভূমি ব্যবস্থাপনায় সুদূরপ্রসারী ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে বলে মনে করছেন স্থানীয় সুধী সমাজ।’
এদিকে, গতকাল শনিবার জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে জমকালো আয়োজনে এই কর্মসূচির চূড়ান্ত কুইজ প্রতিযোগিতা ও সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ১১টায় লিখিত কুইজ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে চূড়ান্ত পর্ব শুরু হয়। পরে দুপুর ১২টায় দলগত কুইজ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী, ভূমি বিষয়ক নাটিকা ও অতিথিদের বক্তব্যের মাধ্যমে অনুষ্ঠান প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।
একক কুইজে টংগিবাড়ী উপজেলার জুবাইদা খাতুন অর্পা প্রথম স্থান অধিকার করেন এবং দলগত প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয় লৌহজং উপজেলার হলদিয়া সরকারি বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়।
জানা যায়, মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ফাতেমা তুল জান্নাত চলতি বছরের মে মাসে ‘ভূমিকথা’ নামক ছোট এই পুস্তিকাটি প্রকাশের পরিকল্পনা করেন। ভূমি বিষয়ক মৌলিক জ্ঞান ও ভূমি সেবার গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসমৃদ্ধ এই বইটি প্রকাশের পর জেলার ছয়টি উপজেলার প্রায় ১০ হাজার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। শিক্ষার্থীদের ভূমিসচেতন করার লক্ষ্যে বইটি পড়ার সময় দিয়ে প্রতিটি উপজেলায় একক ও দলগত কুইজ প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় উপজেলা পর্যায়ের সেরা শিক্ষার্থীদের নিয়ে জেলা পর্যায়ে চূড়ান্ত প্রতিযোগিতা ও সেমিনার অনুষ্ঠিত হলো।
কুইজে বিজয়ী শিক্ষার্থীদের মেধার যথাযথ মূল্যায়ন করে আকর্ষণীয় পুরস্কার বিতরণ করা হয়। একক কুইজে সর্বোচ্চ ৪৭ নম্বর পেয়ে প্রথম হওয়া জুবাইদা খাতুন অর্পাকে ২৫ হাজার টাকার প্রাইজবন্ড ও ক্রেস্ট প্রদান করে জেলা প্রশাসন। দ্বিতীয় স্থান অর্জনকারী লৌহজং পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের তৌছিফ আহমেদ পান ১৫ হাজার টাকা এবং তৃতীয় স্থান অধিকারী লৌহজং পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের হাবিবা আক্তার পান ১০ হাজার টাকার প্রাইজবন্ড। এছাড়া, চতুর্থ থেকে দশম স্থান অর্জনকারী প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ৫ হাজার টাকা করে প্রাইজবন্ড দেওয়া হয়।
দলগত চ্যাম্পিয়ন হলদিয়া সরকারি বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়কে ১৫ হাজার টাকার প্রাইজবন্ড ও ক্রেস্ট দেওয়া হয়। দ্বিতীয় স্থান অধিকার করা টংগিবাড়ী উপজেলার বালিগাঁও উচ্চ বিদ্যালয় পায় ১০ হাজার টাকা এবং তৃতীয় স্থান অধিকারী সিরাজদিখান উপজেলার মালখানগর হাই স্কুল পায় ৫ হাজার টাকার প্রাইজবন্ড ও ক্রেস্ট।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক ফাতেমা তুল জান্নাত বলেন, ‘ভূমিতে আমাদের অসংখ্য মানুষ সমস্যায় জর্জরিত। এই বিষয়গুলোকে মাথায় রেখেই মূলত আমরা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভূমিসচেতন করার উদ্যোগ নিয়েছি, যা আগামীতে একটি সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন। আশা করি, দেশের সর্বস্তরে এরূপ ভূমিসচেতনতামূলক কার্যক্রম আরও বিস্তৃত আকারে গ্রহণ করা হবে।’
প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা জানায়, ‘ভূমিকথা’ পড়ার আগে ভূমি বিষয়ে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না। এই উদ্যোগের ফলে তারা এমন জ্ঞান লাভ করেছে, যা তাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে অনেক কাজে লাগবে। এই ধরনের কার্যক্রম আরও বেশি বেশি আয়োজনের প্রত্যাশা ব্যক্ত করে তারা জেলা প্রশাসককে আন্তরিক ধন্যবাদ জানায়।


