মুন্সিগঞ্জ, ১৫ জানুয়ারি, ২০২৩, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)
মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার সীমানাঘেষা ঢাকার দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ উপজেলার তেঘরিয়া-মোল্লাবাজার সেতু। সেতুটির উত্তর পাড়ে কেরানীগঞ্জের দক্ষিণ থানার মোল্লারহাট। অপর পাড়ে কেরানীগঞ্জের কোন্ডা ইউনিয়নের সামান্য অংশ। এরপর থেকেই শুরু মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখানের বালুচর ইউনিয়নের চরসাংহারদি (চসিমদ্দিন চর)।
সেতুটি নির্মাণ হলে এই পথে নিয়মিত চলাচলকারী কয়েক লাখ মানুষের ঢাকায় যাতায়াতে সময় কমবে। এতে যেমন দুর্ভোগ কমবে পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে দুইপারের মানুষ।
তেঘরিয়া-মোল্লাবাজার সেতু সেতু নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার পর দুই বছরে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও দীর্ঘ ৪ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু এখনো শেষ হয়নি কাজ। এরই মধ্যে দুই দফায় বাড়ানো হয়েছে সময়। তৃতীয় দফায়ও কাজের তেমন গতি নেই। এমন অবস্থায় তৃতীয় মেয়াদের মধ্যে সেতু নির্মাণ নিয়ে সাধারণ মানুষসহ সর্বমহলে প্রশ্ন উঠেছে। কবে শেষ হবে এই সেতু নির্মাণ কাজ তা নিয়ে প্রশ্ন সর্বত্র।
সম্প্রতি নির্মিতব্য সেতু এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, কোনরকমে ঢিমেতালে কাজ করছেন হাতেগোনা কয়েকজন শ্রমিক। সেতুটি আটটি পিলারের উপর ৭টি স্প্যান নিয়ে নির্মাণ হওয়ার কথা থাকলেও দুই পারে তিনটি করে ছয়টি পিলার নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। দক্ষিণ পারে বসানো হয়েছে দুইটি স্প্যান। বাকি রয়ে গেছে আরও দুইটি পিলার নির্মাণ ও ৬টি স্প্যান বসানো। নদীর উপর দুইটি পাইলিং করা হলেও সেখানে পিলার নির্মাণের কোন কাজই এখনো শুরু হয়নি।
সেতুর ধলেশ্বরী শাখা নদীর দক্ষিণ পারে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড জড়ানো ভগ্নদশাগ্রস্ত একটি অফিস দেখা গেলেও সেখানে কেউ নেই। রুমগুলোও দেখা গেছে তালাবদ্ধ।
সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ না হওয়ায় ১০ বছর আগে নির্মিত মুন্সিগঞ্জের টংগিবাড়ী উপজেলার বেতকা থেকে সিরাজদিখান উপজেলার বালুরচর ইউনিয়নের চরসাংহারদি গ্রাম হয়ে দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জের কোন্ডা ইউনিয়নের উপর দিয়ে পোস্তগোলায় বঙ্গবন্ধু মহাসড়ক (ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে) সংযুক্ত সড়কের কোনো সুফলই পাচ্ছেনা মুন্সিগঞ্জবাসী।
এই পথে নিয়মিত চলাচলকারী টংগিবাড়ীর বেতকা এলাকার শহিদুল্লাহ বলেন, মোল্লাবাজার সেতু নির্মিত হলে এর মাধ্যমে ঢাকার কেরাণীগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান, টংগিবাড়ী, লৌহজং উপজেলাসহ মুন্সিগঞ্জ সদরের সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হবে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এভাবে কেন নির্মাণ কাজ সম্পন্ন না করেই ফেলে রাখা হয়েছে তা আমাদের কারোরই বোধগম্য নয়। এই পথে আসলে এখন সেতুটির অবস্থা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়। সবসময়ই মাথায় প্রশ্ন ঘুরপাক খায় কবে সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হবে।
স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. শাকিল বলেন, সেতুটি নির্মাণ হলে মুন্সিগঞ্জের টংগিবাড়ী হয়ে ৪৫ মিনিটের কম সময়ে ঢাকা যাওয়া যাবে। এই পথে যাতায়াতে যানজটেও পড়তে হবে না। অথচ সেতুর কাজ শেষ না করে ফেলে রাখা হয়েছে। সেতু নির্মাণে সরকারি টাকায় কেনা অনেক গুরুত্বপূর্ণ সরঞ্জাম খোলা আকাশের নিচে অযত্নে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। অনেক মালামাল চুরি হয়ে গিয়েছে। এরপরও কতৃপক্ষের টনক নড়ছে না। দ্রুত কাজ শেষ করায় তাদের আগ্রহ একেবারেই নেই। এর পেছনে কি রহস্য থাকতে পারে তাও আমাদের মত সাধারণ মানুষের জানা সম্ভব হচ্ছে না।
মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার বালুরচর এলাকার বাসিন্দা রোকসানা আক্তার বলেন, মুন্সিগঞ্জ সদর হয়ে বা অন্য পথে ঢাকায় যাওয়ার চেয়ে এই পথে আমরা খুব সহজে ও কমসময়ে ঢাকায় যেতে পারি। মোল্লাবাজার সেতুটি হলে আমরা নদীতে না নেমে আরও সহজে যাতায়াত করতে পারতাম। এখন আমাদের নদীতে ফেরির মত দেখতে ছোট নৌযান দিয়ে টাকার বিনিময়ে ঝুঁকি নিয়ে পার হতে হয়। অনেকসময় রাতে জরুরী রোগী নিয়ে এই পথে যাওয়াটা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। সেতুটি নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিলো ৪বছর আগে। এখনো কেন কাজ শেষ হচ্ছে না তা আমরা খালি চোখে দেখে বুঝতে পারিনা। সংশ্লিষ্টদের উচিৎ দ্রুত সময়ের মধ্যে সেতুর কাজ শেষ করে যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করা।
ঢাকার কেরানীগঞ্জ এলাকার সংসদ সদস্য (ঢাকা-৩) ও বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু সেতু নির্মাণে ধীরগতিতে অসন্তোষের কথা জানিয়ে বলেন, সেতুটি এলজিআরডি নির্মাণ করছে। বারবার তাদের বলার পরও কাজ শেষ করেনি। সবচেয়ে বড় দুর্গতি হলো, এটার হাইট (উচ্চতা) এত নিচু করছে যে নিচ দিয়ে অন্য কোন নৌযান চলাচল করতে পারবে না। ভবিষ্যতে এটা নিয়ে আরও বিপদে পড়তে হবে।
তেঘরিয়া-মোল্লাবাজার সেতু নির্মাণে ধীরগতি ও সার্বিক অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে কেরাণীগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী কাজী মাহমুদুল্লাহ সেতু নির্মাণে ধীরগতির কথা অস্বীকার করে জানান, প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় করোনা পরিস্থিতি, নকশা পরিবর্তন ও জমি অধিগ্রহণে জটিলতা দেখা দেওয়ায় নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করা যায়নি। তবে বর্তমানে কাজ চলমান রয়েছে। ৭টি স্প্যানের মধ্যে দুইটি স্প্যান কমপ্লিট। আশা করি, আগামী ১ মাসের মধ্যে আরও দুইটি স্প্যানের কাজ শেষ হয়ে যাবে। আর বাকি থাকবে ৩টি স্প্যান। আশা করি, বর্তমান মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সেগুলোর কাজ শেষ করে সেতুর কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবে। তিনি জানান, নদীর দুই পাশে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে এখনো কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। আমরা সাধারণ মানুষকে অনুরোধ করে কাজ করাচ্ছি।
দ্বিতীয় দফায়ও হয়নি কাজ, চলছে তৃতীয় দফায়
প্রকল্প সূত্র ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০১৭ সালে একনেকে পাশ হওয়ার পর ২৫২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১০ মিটার দূরত্ব নিয়ে ৮টি পিলারের উপর ৭টি স্প্যানের তেঘরিয়া-মোল্লাবাজার সেতু নির্মাণে ৩৩ কোটি ২৭ লাখ টাকায় এম এস সুরমা এন্টারপ্রাইজের সাথে চুক্তি করে স্থানীয় প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)।
প্রথম দফায় ২০১৮ সালের জুনে কাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও শুরু হয় ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। যেটি শেষ করার কথা ছিলো ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। এরপর নকশা পরিবর্তন ও জমি অধিগ্রহণ নিয়ে জটিলতা দেখা দিলে অসম্পুর্ণ অবস্থায় প্রথম দফার মেয়াদ শেষ হয়।
দ্বিতীয় দফায় ২০২২ সালের ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত পুনরায় নির্মাণ কাজের সময় বৃদ্ধি করা হয়।
সেটির মেয়াদও ইতিমধ্যে শেষ হয়ে যাওয়ায় তৃতীয় দফায় ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বৃদ্ধি করে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে একই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
সুফল মিলবে না বেতকার ইলেক্ট্রনিক শিল্পনগরীর
দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জ উপজেলার তেঘরিয়া-মোল্লাবাজার সেতু নির্মাণ কাজ শেষ না হলে সুফল পাবে না মুন্সিগঞ্জের টংগিবাড়ী উপজেলার বেতকা এলাকায় গড়ে উঠা ইলেক্ট্রনিক শিল্পনগরীর উদ্যোক্তারা। ইতিমধ্যে এই শিল্পনগরীর কাজ শেষ হয়েছে। প্লট বরাদ্দও চলছে পুরোদমে। যে কোন সময় বিদ্যুৎ সংযোগ কাজ শেষ করে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হবে বিসিকের তত্ত্বাবধানে ৩১৭ কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত বেতকা ইলেক্ট্রনিক শিল্পনগরী।
কিন্তু তেঘরিয়া-মোল্লাবাজার সেতু নির্মাণ কাজ শেষ না হলে এই শিল্পনগরীর উদ্যোক্তারা সহজ যাতায়াতের সুফল ভোগ করতে পারবে না। এর কারণ হচ্ছে, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পদ্মা সেতু হয়ে খুব সহজে ৩০ মিনিট সময়ে তেঘরিয়া-মোল্লাবাজার সেতু হয়ে বেতকা ইলেক্ট্রনিক শিল্পনগরীতে পণ্য আনা-নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। একইভাবে এই পথে ঢাকায়ও অল্প সময়ে যাতায়াত করা যাবে। কিন্তু তেঘরিয়া-মোল্লারহাট সেতু নির্মাণ কাজ শেষ না হলে এই সুফল এখনই মিলবে না।
রাজধানীতে ছড়িয়ে থাকা বৈদ্যুতিক পণ্য ও হাল্কা প্রকৌশল শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থানান্তরের লক্ষ্যে মুন্সিগঞ্জের টংগিবাড়ী উপজেলার বেতকা এলাকায় ইছামতী নদীর তীরে ৫০ একর জমির উপর ২০১৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ইলেকট্রনিক শিল্পনগরী গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়। এই কাজ শুরু করার পরই প্রথমেই এই শিল্পনগরীর সাথে ঢাকায় যাতায়াত আরও সহজতর করার লক্ষ্যে তেঘরিয়া-মোল্লাবাজার সেতু নির্মাণ প্রকল্পে আরও বেশি জোর দেয়া হয়। কিন্তু শিল্পনগরী নির্মাণ শেষের পথে থাকলেও তেঘরিয়া-মোল্লাবাজার সেতু নির্মাণ কাজ কবে শেষ হবে তার কোন কুলকিনারা নেই।
মানুষ বাধ্য হয়ে পার হচ্ছে ‘দেশি ফেরি’তে
সম্প্রতি সেতু এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, অনেকটা বাধ্য হয়েই স্থানীয়ভাবে তৈরি করা ফেরিসদৃশ নৌযান দিয়ে নদী পার হচ্ছেন এই পথে যাতায়াতকারীরা। নির্মিতব্য সেতু এলাকার ঠিক পাশেই মোল্লারহাট ঘাট ইজারা নিয়ে স্থানীয় বেলায়েত মাঝি ৮লাখ টাকা ব্যায়ে ৬০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১২ ফুট প্রস্থের ‘দেশি ফেরি’ নির্মাণ করে যাত্রী ও যানবাহন পারাপার করছেন।
ট্রলারের শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে পরিচালিত ফেরিসদৃশ এই ক্ষুদ্র আকৃতির নৌযান দশ মিনিট পরপরই দুইটি সিএনজি, পাঁচ-ছয়টি মোটরসাইকেল ও অর্ধশতাধিক যাত্রীদের পারাপার করছে। দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি এই লক্করঝক্কর নৌযান দিয়েই নিয়মিত দিন ও রাতে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে কয়েক হাজার মানুষ।
বেলায়েত মাঝির দেশি ফেরিতে যাত্রীর টোল জনপ্রতি পাঁচ টাকা। আগে নৌকাতেও তাই ছিল। বাইসাইকেলের জন্য টোল নেয়া হচ্ছে, ১০ টাকা, মোটরসাইকেলের জন্য ২০ টাকা অটোরিকশা-সিএনজির টোল যাত্রীসহ ১০০ টাকা।