মুন্সিগঞ্জ, ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)
প্রায় ২০০ বছর আগে বিক্রমপুরের সিরাজদিখান অঞ্চলে পুলিনবিহারী দেব তার স্ত্রীকে নিয়ে সর্বপ্রথম নিজ বাড়িতে পাতক্ষীর তৈরি শুরু করেন। এরপর ধীরে ধীরে সেটি বাজারে বিক্রি শুরু করেন তিনি। পুলিনবিহারী দেব পরলোকগমন করলেও তার পরবর্তী প্রজন্ম এরপর তারও পরবর্তী প্রজন্ম এখনো ধরে রেখেছেন পাতক্ষীরের সুনাম আর ধরে রেখেছেন এর ঐতিহ্য। বিক্রমপুর তথা মুন্সিগঞ্জের বিখ্যাত খাবারের কথা উঠলেই সবার আগে আসে এই পাতক্ষীরের কথা।
কোন সিক্রেট রেসিপি নয়- খাটি দুধের সাথে হালকা হলুদ আর চিনি মিশিয়ে খুব সহজেই মাটির চুলার জালে বানানো হয় এই পাতক্ষীর। ইউরোপ-আমেরিকার বাঙালি কমিউনিটির অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত মিষ্টিপণ্যের দোকান বা সুপার শপেও বিক্রি হয় বিক্রমপুরের বিখ্যাত পাতক্ষীর।
কলাপাতায় মোড়ানো এই মিষ্টান্ন মূলত সাধারণ ক্ষীরের একটি বিশেষ সংস্করণ। দুধ জাল দিয়ে ক্ষীর তৈরি করার পর পাতায় মুড়িয়ে পরিবেশন করা হয় বলে প্রথম দিকে এর নামকরণ করা হয় পাতাক্ষীর নামে। পরে এটি পরিচিতি পায় পাতক্ষীর হিসেবে।
সিঙ্গাপুর, ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পাতক্ষীরের অর্ডার আসে। বিশেষ করে সেসব দেশে প্রচুর প্রবাসী বাঙালি যারা রয়েছেন শীতের মৌসুমে তারা পিঠা-পুলির আয়োজনে ঝামেলা কমাতে দেশে থাকা আত্মীয়-স্বজনের মাধ্যমে বিক্রমপুর থেকে এই পাতক্ষীর নিয়ে যান।
সারাবছরই পাতক্ষীরের চাহিদা থাকে। তবে শীত আসলে এর চাহিদা বেড়ে যায় অনেক বেশি। নতুন জামাইয়ের সামনে পিঠা-পুলির সঙ্গে এ ক্ষীর ব্যবহার না করা যেন বেমানান।
মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান বাজারে ৭-৮টি মিষ্টির দোকানে বর্তমানে বিক্রি হয় পাতক্ষীর। কয়েক প্রজন্ম পেরিয়ে পাতক্ষীরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন তারা।
আদর্শ মিষ্টান্ন ভান্ডারের স্বত্ত্বাধিকারী বাবুল শেখ বলেন, আমাদের এই এলাকায় পাতক্ষীরের প্রথম উৎপত্তি হয়। এরপর থেকে এখনো অত্যন্ত সুনামের সাথে পাতক্ষীর বিক্রি করে আসছি। বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পাতক্ষীর তৈরি হয় তবে বিক্রমপুরের মত হয় না।
মহাগুরু মিষ্টান্ন ভান্ডারের স্বত্ত্বাধিকারী সুশান্ত ঘোষ বলেন, বিক্রমপুরের পাতক্ষীরের আলাদা সুনাম রয়েছে। এই ব্যবসা আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য। আমাদের নিজস্ব কারিগররা নিজেদের ফ্যাক্টরিতে এই পাতক্ষীর বানিয়ে থাকে। সারাবছরই এই পাতক্ষীরের চাহিদা থাকে। প্রতিটি দোকানে প্রতিদিনই বিক্রি হয় পঞ্চাশ-একশো কেজি পাতক্ষীর।
পাতক্ষীরের কারিগররা জানান, খামার থেকে খাটি দুধ আনার পর সেগুলো প্রথমে সামান্য আচে গরম করে ঢালা হয় বড় পাত্রে। যাকে কারিগররা তাফাল বলে থাকেন। এরপর ১ ঘন্টা ধরে এই দুধ জাল দিয়ে কিছুটা ঘন হয়ে এলে দেয়া হয় সামান্য হলুদ গুড়া। এরপর জাল দেয়া হয় আরও আধা ঘন্টা ধরে। পরে ঢালা হয় চিনি। দুধ হলুদ আর চিনির মিশ্রণ গাঢ় হয়ে এলে অনবরত নাড়তে নাড়তে প্রস্তুত করা হয় পাতক্ষীর। এরপর তাফাল থেকে সুবিধাজনক পাত্রে ঢেলে মাটির পাতিলে মেপে উঠিয়ে রাখা হয় গরম পাতক্ষীর। ঘণ্টাখানেক পর ঠাণ্ডা হলে পাতক্ষীরের পাতিলগুলো চলে যায় দোকানে। সেখানে পাতক্ষীরকে পেঁচানো হয় কলা পাতায়।
কলাপাতায় মোড়ানো এই প্রতিটি পাতক্ষীরের ওজন প্রায় আধা কেজি। বর্তমানে এর দাম ৩০০-৩৫০ টাকা। তবে বাজারে দুধের দাম বাড়লে বেড়ে যায় পাতক্ষীরের দামও।
বর্তমান বাজারে দুধ ও চিনির দাম উর্ধ্বমুখী হওয়ায় খুবই সীমিত লাভে বিক্রি হয় এই পাতক্ষীর। দোকানে বিক্রি ছাড়াও বাড়িতে এসে অর্ডার দিয়ে থাকে অনেক ক্রেতা। বছরের পর বছর ধরে সুনাম আর ঐতিহ্যের সাথে মন্ত্রমুগ্ধের মত দেশসহ বিশ্ববাসীর মন জয় করে রেখেছে বিক্রমপুর তথা মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান বাজারের স্বাদ ও মনমাতানো সুগন্ধের অতুলনীয় এই পাতক্ষীর।