মুন্সিগঞ্জ, ১২ এপ্রিল, ২০২২, সাজ্জাদ হোসেন (আমার বিক্রমপুর)
মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মন্ডল ১৯ দিন যাবত কারাগারে ছিলেন। এ সময়ে পরিবারের সদস্যরা ভয়ে ছিলেন। ১৯ দিন স্কুলে যাওয়াও বন্ধ ছিল হৃদয় মন্ডলের ছেলে শ্রেষ্ঠ মন্ডলের।
শিক্ষক হৃদয় মন্ডল যে স্কুলে পড়ান, সে স্কুলেই পড়েন তার ছেলে। গতকাল সোমবার আবার স্কুলে যাওয়া শুরু হয়েছে শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের ছেলের।
শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের ছেলে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র শ্রেষ্ঠ মন্ডল জানান, ‘১৯ দিন যাবত স্কুলে যাওয়া বন্ধ ছিল। ঘটনার পরদিন স্কুলে গিয়েছিলাম কিন্তু আমাকে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ছাত্ররা আসামির ছেলে ডাকা শুরু করেছিল। এরপর বাসায় এসে জানানোর পর মা আমাকে স্কুল যেতে দেয়নি আর। এরপর থেকে সারাদিন বাসার ভিতরেই ছিলাম। স্কুলে যেতে না পেরে অনেক খারাপ লাগছিল। আর আমার বাবাও ছিল তখন কারাগারে। গত রোববার আমার বাবা কারামুক্ত হয়েছেন। স্কুলে যেতে এখন আর অসুবিধা হচ্ছেনা। কেউ আমাকে আসামির ছেলে বলে ডাকছেও না। ঐ প্রসঙ্গে কেউই আমার বন্ধুরাও কোন প্রশ্ন করেনি। সকাল ৮টা থেকে ১১ টা ১০ মিনিট পর্যন্ত তিনটি বিষয়ে ক্লাস করেছি। স্কুল সংলগ্ন আমার বাসা যার জন্য ফিরতেও কোন সমস্যা হয়নি।’
হৃদয় মন্ডলের স্ত্রীর বড় ভাই বাদল হাওলাদার জানান, ‘দুইদিন দুইটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। গতকাল বাসার গৃহকর্মীর সাথে আরেকটি আজ ভোরে হৃদয় মন্ডলের শাশুড়ির সাথে। এ অবস্থায় বাহিরে গিয়ে পরিচয় দিতেও ভয় লাগে।’
শ্রেষ্ঠ মন্ডলের প্রথমদিনের ক্লাস করা প্রসঙ্গে স্কুলের প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘পঞ্চম শ্রেণির খ শাখার ফাস্ট বয় হলো শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের ছেলে শ্রেষ্ঠ। সে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। ঐ ঘটনার পর থেকে বাসা থেকেও বের হতে ভয় পাচ্ছিল তার পরিবারের সদস্যরা। তারজন্য স্কুলে যাওয়া বন্ধ ছিল। এখন স্কুলের একজন শিক্ষককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ঐ শিক্ষক শ্রেষ্ঠকে বাসা থেকে নিয়ে আসা ও স্কুল শেষে বাসায় পৌঁছে দেওয়া নিশ্চিত করবেন।’
হৃদয় মন্ডলের শাশুড়ি রেনুকা হাওলাদার জানান, ‘ভোর ৬টায় বাসার ছাদে গিয়ে হাটাহাটি করছিলাম। এসময় একজন যুবক ইট হাতে নিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন- বাসার বাহিরে যেন না আসি। তারপর গালিও দেয়। এরপর আমি ভয়ে বাসার ভিতর চলে যাই।’
হৃদয় মন্ডলের বাসার গৃহকর্মী অনিতা সাহা জানান, ‘গত রোববার দুপুর ১টায় শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের বাসার কাছে ছিলাম। তখন ৪-৫ জন যুবক আমার দিকে চোখ বড় বড় করে ধমক দেয়। আমি ভয়ে বাসার ভিতর চলে যাই।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুমন দেব বলেন, ‘শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের পরিবারের নিরাপত্তা সামান্যতম বিঘ্নিত হওয়ার সুযোগ নেই। আমরা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করছি। তার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তাহীনতার মতো কোন ঘটনা ঘটার সুযোগ পুলিশ হতে দিবে না। তাকে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য যদি আবেদন করা হয় তাহলে তা বিবেচনা করা হবে। তবে, সে আবেদন না করলেও পুলিশ নিজের মত করে তার নিরাপত্তা দেবে।’
প্রসঙ্গত, গত ২০ মার্চ স্কুলে বিজ্ঞান নিয়ে ছাত্রদের সাথে কথা হচ্ছিল হৃদয় মন্ডলের। সেখানে বিজ্ঞান ও ধর্ম নিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে কথোপকথন হয়। ক্লাস শেষে কয়েকজন শিক্ষার্থী প্রধান শিক্ষকের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দেন। যেখানে ধর্ম অবমাননা ও মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর বিরুদ্ধে কটুক্তি করার অভিযোগ আনা হয়। তার দুইদিন পর শিক্ষার্থীরা স্কুলে বিক্ষোভ করলে পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ আসে। এরপর শিক্ষক হৃদয় মন্ডলকে পুলিশ থানায় নিয়ে যায়। ঐদিন ২২ মার্চ রাত সাড়ে ১০ টা’র দিকে তার বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার মামলা দায়ের হয়। শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের বিরুদ্ধে ২৯৫ ও ২৯৫ (ক) ধারায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে মামলা করেন একই স্কুলের অফিস সহকারি (ইলেক্ট্রিশিয়ান) আসাদ মিয়া।
এ মামলায় গত রোববার দুপুরে জামিন শুনানি শেষে বিচারক তার জামিন মঞ্জুর করেন। বিকালে কারামুক্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য তিনি ঢাকায় চলে যান।
হৃদয় মন্ডল স্যারকে মিস করছে শিক্ষার্থীরা
মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মন্ডল স্কুলে নেই ২০ দিন যাবত। ১৯ দিন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলায় কারাগারে ছিলেন তিনি।
কারামুক্ত হওয়ার পর নিরাপত্তাজনিত কারণে ও চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আছেন তিনি। তবে তার অনুপস্থিতিতে স্কুল তাকে মিস করছে। তার বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ের ছাত্ররাও পড়া থেকে পিছিয়ে যাচ্ছে।
বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন আহমেদ জানান, ‘হৃদয় মন্ডল স্যার একজন ভালো শিক্ষক। তিনি ছাত্রদের খুবই চমৎকার ভাবে পড়ান। তার ক্লাসে অনুপস্থিতির জন্য গণিত বিষয়ে ছাত্ররাও পিছিয়ে আছে। শিক্ষক হৃদয় মন্ডল স্যার তার ইচ্ছেমত স্কুলে আবার ফিরতে পারেন। এরজন্য কোন বাধা নেই। তিনি চাইলে ছুটিও নিতে পারেন। আমাদের স্কুল কর্তৃপক্ষেরও কোন সমস্যা নেই। তিনি জানান, স্কুলে মোবাইল ফোন আনা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। তার জন্য কড়া শাস্তির বিধানও আছে। শিক্ষক হৃদয় মন্ডলকে ফাঁসাতে ছাত্ররা খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে মোবাইল নিয়ে এসে রেকর্ড করেছিল। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে শিক্ষক হৃদয় মন্ডলকে ফাঁসাতে ফোন নিয়ে শ্রেণিকক্ষে আসে। ফোন নিয়ে যারা এসেছিল এর জন্য তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।’
ঐদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে প্রধান শিক্ষক জানান, ‘ছাত্রদের লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে শিক্ষক হৃদয় মন্ডলকে যখন আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। ঘটনার দিন স্কুলের শিক্ষার্থীরা কথা শুনলেও বহিরাগত লোকজন উত্তেজনা বাড়ায়। শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের বাড়িতে হামলা করে। ছাত্র ও বহিরাগতরা মিলে মিশে গিয়েছিল। অনেক গণ্ডগোল হয়েছিল।’
তিনি জানান, ‘২০ মার্চ স্কুলের শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের সাথে ছাত্রদের কথোপকথন হয়। ঐদিন বিকাল সাড়ে ৪টায় স্কুল ছুটি হওয়ার পর ৭-৮ জন ছাত্র এসে দরখাস্ত দিয়েছিল। তারা স্কুলের বাহিরে গিয়ে লিখে নিয়ে এসেছিল দরখাস্তটি। এ ঘটনায় স্কুলের ভিতরের লোকজন জড়িত আছে কিনা সে বিষয়ে তদন্ত করছে পুলিশ।’
দশম শ্রেণির ছাত্র রহমত উল্লাহ জানান, ‘গণিত বিষয়ে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। আমাদের পড়াশুনাও ঠিকমতো হচ্ছে না। আমরা নিজেরাও স্যার আসার অপেক্ষায় আছি। তার সাথে যা হয়েছে এর জন্য আমরা সবাই ক্ষমাপ্রার্থী। আমরা চাই স্যার পূর্বের মতো নিয়মিত ক্লাসে ফিরে আসুক।’
স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র রিফাত হোসেন জানান, ‘হৃদয় মন্ডল স্যারের সাথে এরকম ঘটনার জন্য আমরা ছাত্ররাও অনেক লজ্জিত। আমরাও চাইনি আমাদের স্যারকে কারাগারে রাখা হোক। কিছু কিছু ছাত্রের উশৃঙ্খল আচরণের কারণে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। আমরা চাই হৃদয় মন্ডল স্যার আবার ক্লাসে ফিরে আসুক।’
দশম শ্রেণির ছাত্র আকাশ জানান, ‘কিছু কিছু ছাত্রের জন্য আমাদের স্কুলের বদনাম হয়েছে। আমরাও চাই এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হোক। আমরা চেয়েছিলাম স্কুলের সমস্যা বাহিরে যেন না যায়। কিন্তু বহিরাগত লোকজন স্যারকে ফাঁসিয়েছে। আমরা চাই স্যার যেন আবার ক্লাসে ফিরে আমাদেরকে পড়ান। আমরা ভুল করলে শাসন করুক। আমরা স্যারের জন্য অপেক্ষায় আছি।’
হৃদয় মন্ডলের স্ত্রী ববিতা হাওলাদার জানান, ‘কারাগারে দীর্ঘদিন যাবত থাকায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন আমার স্বামী। তাছাড়া তিনি ডায়াবেটিস রোগী। গত রোবিবার বিকালে চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি ৪-৫ দিন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে আবার স্কুলের কোয়াটারে আসবেন। স্কুলের পরিবেশ ও নিজ এলাকার পরিবেশ এখনো স্বাভাবিক হয়নি। পুলিশ প্রশাসন যদি এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ নেয় তাহলে একটি ভালো পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।’
হৃদয় মন্ডলের স্ত্রীর ভাই বাদল হাওলাদার জানান, ‘আমাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে বহিরাগত লোকজন নানা কটুক্তি করছেন। কারাগারে থাকাকালীন সময় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত নানা ঘটনা ঘটেছে যা নির্দেশ করে পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। ৪-৫ দিন পর হৃদয় মন্ডল নিজ বাসায় আসবেন। তখন পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’