দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকির ভয়াবহ বোমা হামলার ৭০ বছর পূর্ণ হলো। সেই উত্তপ্ত সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেসময়কার বোমারু বিমান ক্রু’র সদস্য হাওয়ার্ড জিন। পরে যিনি সুখ্যাতি অর্জন করেন বিকল্প ইতিহাসের রচয়িতা হিসেবে। তার সাড়া জাগানো বই ‘এ পিপলস হিস্টরি অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস’ বিশ্বব্যাপী আলোড়ন তোলে। ওই বইতে উঠে আসে মানুষের ইতিহাস, যে ইতিহাসের নায়কেরা ছিলেন কৃষক বিদ্রোহের নেতা কিংবা শ্রমিক ইউনিয়নের সংগঠকেরা।
ড. জিনের জন্ম ১৯২২ সালের ২২ আগস্ট, নিউইয়র্ক শহরে অভিবাসী হয়ে আসা এক ইহুদি পরিবারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বোমারু হিসেবে বীরত্বের জন্য তাঁকে ‘এয়ার মেডেল’ দেওয়া হয় এবং তিনি সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে উন্নীত হন। যুদ্ধের পরে ২৭ বছর বয়সে তিনি নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। দিনের বেলায় পড়াশোনা আর রাতে কুলির কাজ করে পড়াশোনার খরচ জোগাতে হতো তাঁকে। নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করার পর তিনি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
২০১০ সালের ২৭শে জানুয়ারি, মৃত্যুর দিন বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি তাঁর পাঠদান ৩০ মিনিট আগে শেষ করেন। কারণ, সেখান থেকে তার একটি মিছিলে যোগ দেয়ার কথা ছিলো। তাঁর ক্লাসে উপস্থিত প্রায় ৫০০ শিক্ষার্থীকেও সেই মিছিলে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। তাঁদের মধ্য থেকে একশয়ের মতো শিক্ষার্থী তাঁর সঙ্গে গিয়েছিলেন। সেটাই ছিল তাঁর শেষ প্রতিবাদ।
সেই হাওয়ার্ড জিনের নামে থাকা এক ওয়েব সাইটে একটি সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে বর্ণিত হয়েছে জিনের সেই সময়কার যুদ্ধস্মৃতি। হিরোশিমা স্বরণে জিন একবার বলেছিলেন: “ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরম নৈতিকতাকে প্রশ্নাতীতভাবে আমি এক সময় গ্রহণ করি। আর হিরোশিমা ও রোয়ানে হামলার ঘটনা আমাকে তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে সাহায্য করে। তিনি আরও বলেন: “যুদ্ধের পরিবেশ কীভাবে এক পক্ষ থেকে অন্য পক্ষকে অবিভেদ্য করতে শুরু করে, সেই শিক্ষাটা আমি আমার যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে পুনর্ভাবনা এবং ইতিহাস পঠন থেকে পেয়েছিলাম।”
হাওয়ার্ড জিনের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সংবাদে কীভাবে যুদ্ধ পরিবেশে দুটো পক্ষের ভূমিকা অবিভেদ্য হয়ে পড়ে তার বর্ণনা দেয়া হয়। হাওয়ার্ড জিনের বর্ণনার আলোকে তার সেই উপলব্ধিকেই প্রিয় পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল।
জিন জানান, ‘যুদ্ধকালে নিজেদের পক্ষের কার্যাবলীর ন্যায্যতা নিয়ে কিছু সন্দেহ তার মনে উঁকি দিয়েছিল। সেসময় অন্য ক্রুর এক গোলন্দাজ সৈনিকের সাথে বন্ধুত্ব হয় তার। এক কথায় বলতে গেলে সাহিত্য বিবর্জিত একটি বিমান ঘাঁটিতে সেই বন্ধুটির সঙ্গে নিজের দর্শন এবং চিন্তাধারায় মিল খুঁজে পেয়েছিলেন জিন। তিনি বলেন, ‘আমরা দুজনই বই পড়তাম এবং রাজনীতিতেও আমাদের আগ্রহ ছিল। একটা সময়ে সে আমাকে সচকিত করে দিয়ে বলল: “তুমি জান, এটা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কোন যুদ্ধ নয়। এটা ক্ষমতার লড়াই। ইংল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন এরা সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্র। এরা কেউই হিটলারের নীতি সম্পর্কে নৈতিকভাবে উদ্বিগ্ন না। এরা শুধু বিশ্বকে শাসন করতে চায়। এটি একটি সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ।”
জিন জানান, ওই বন্ধুটির কথায় চমকে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, যদি সে এ যুদ্ধের বিপক্ষেই হয় তবে কেন বিমান ঘাঁটিতে অবস্থান করছে এবং যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে? উত্তরে সেই বন্ধুটি বলেছিলেন, জিনের মত যারা আছে তাদের বোঝানোর জন্যই তিনি সেখানে আছেন।
শুরুতে বন্ধুর কথা বিশ্বাস না করলেও পরবর্তীতে জিনের ভাবনায় পরিবর্তন আসে। জিন বলেন, ‘ঠিক সেসময় আমি তার কথা বিশ্বাস করতে পারিনি। কিন্তু তার এই মতাদর্শ আমাকে মনের অজান্তেই প্রভাবিত করে ফেলে এবং যুদ্ধ শেষ হলে আমি আমার যুদ্ধের সকল সরঞ্জামাদি যেমন: সংগৃহীত ছবিসমূহ, স্মারক, তারকা খচিত মেডেলগুলোকে বাক্স বন্দি করে ফেলি। এমনকি বাক্সের উপর মোটা মোটা করে লিখে দিই “আর কখনও না।”
ঠিক কীভাবে ধারণায় পুরোপুরি পরিবর্তন এসেছিল তারও বর্ণনা দেন জিন।
তিনি জানান, ইউরোপ জয়ের পর, তার সঙ্গী আর সব ক্রুরা আটলান্টিক মহাসাগর পার হয়ে বি-১৭ ঘাঁটিতে ফিরে আসে। এরপরই জাপানে অভিযান শুরু হবে। এবং সেকারণেই জাপানের বোমা হামলা চালানোর আগে তাদের ১ মাসের জন্য ছুটি ছিল বলে জানান জিন। আর সেসময়কার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘রজ (জিনের স্ত্রী) এবং আমি ছুটি শেষ হওয়ার আগে বাসে করে দেশের ভিতরে গিয়ে একলা সময় কাটাতে থাকি। ঠিক সেসময়, একটি পত্রিকার দোকানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বড় একটি শিরোনামে আমাদের চোখ আটকে যায়। শিরোনামটি ছিল: “জাপানের হিরোশিমা শহরে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ, যুদ্ধের অবসান প্রত্যাশিত।”
আর সেদিনের সে খবরে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে জয় হয়েছে ভেবে আনন্দিত হয়েছিলেন বলে জানান হাওয়ার্ড জিন। সেই আনন্দ কেমন ছিল তা জানা যায়, জিনের বর্ণনাতেই। তিনি বলেন, ‘খবরটি দেখে আমার প্রতিক্রিয়া ঠিক কেমন ছিল তা আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। পারমাণবিক বোমা সম্বন্ধে আমাদের স্বচ্ছ কোন ধারণা ছিল না। কিন্তু আমরা সচরাচর যে ধরনের বোমা ব্যবহার করি তার থেকে যে এটি অনেকাংশে বড় তা বোধ করি বুঝতে সময় লাগেনি। এখন আমার আর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যাওয়া লাগবে না আর যুদ্ধও শেষ হয়ে যাবে- ভাবছি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত জয় হয়েছে- এবং আমি ভালো কিছুর জন্যই বাড়ি আসছি।’
তবে সহসাই সে আনন্দে ভাটা পড়ে বলে জানান জিন। তার কারণ জন হার্সির একটি লেখা।
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জন হার্সির লেখা ‘হিরোশিমা’ নামের এক প্রতিবেদনের কথা তুলে ধরেন জিন। সেখানে হার্সি লিখেছেন, ‘হিরোশিমা শহরটিতে যখন আমি গেলাম তখন শহরটির ধ্বংসযজ্ঞ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, একটি বেসামরিক নাগরিকদের শহরকে আমরা কী করেছি। শহরটির বয়স্ক মানুষ, স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের করুণ পরিণতি দেখে জাপানিদেরকে হিংস্র বা নিষ্ঠুর যোদ্ধা না ভেবে সাধারণ মানুষ হিসেবে ভাবতে বাধ্য করে। এটি আমাকে ফ্রান্সের বাটানে চালানো জাপানের সেই অপরিচিত নৃশংসতার সঙ্গে হিরোশিমায় আমাদের চালানো নৃশংসতার তুলনা করতে বাধ্য করে। আমি দেখলাম, আমাদের নৃশংসতায়, বেসামরিক মানুষের আগুনে দগ্ধ দেহ, তাদের ঝুলন্ত মাংস, চক্ষুগোলক থেকে বের হওয়া তাদের মণিগুলো, মৃতদেহ থেকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মনের অসাড়তায় চলতে চলতে ভুতুড়ে পরিবেশে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে ঐ চ্যাপ্টা শহরেই নিজেদের অস্তিত্ব প্রকাশ করছে।’
জিন জানান, পরবর্তীতে জাপান ভ্রমণের সময় সেই নৃশংসতার চিহ্ণ আর ভয়াবহ গল্পগুলো তার মনে দাগ কেটেছিল।
১৯৬৬ সালের আগস্টে জিন আর তার স্ত্রী রজ জাপানের শান্তি গ্রুপের এক নিমন্ত্রণে সেদেশে যান। সেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ বোমা নিক্ষেপণের সেই ভয়াবহ দিনটি স্বরণ করে। তাছাড়া ওইদিন পারমাণবিক অস্ত্র বর্জন করতে সবাই বদ্ধপরিকর হয়। জিন জানান, সেদিন তারা সবাই হিরোশিমায় দেখা করেন। সেখানে ঐ নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কথা সবাইকে মনে করিয়ে দিতে কয়েকটি বিধ্বস্ত অংশ বাদে আর সবকিছু পুননির্মাণ করা হয় বলেও জানান তিনি।
এরপর বোমার গ্রাস থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষদের জন্য নির্মিত কেন্দ্র “হাউজ অব ফ্রেন্ডশিপে” তাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানকার মানুষদের করুণ অবস্থা দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন বলে উল্লেখ করেন জিন। তিনি বলেন, ‘আমরা কেন্দ্রটির মানুষদের উদ্দেশ্যে সৌজন্যমূলক কিছু কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু যখনই আমার পালা এল, আমি মেঝেতে বসে থাকা পুরুষ ও নারীদের দেখলাম, তারা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। এদের কারো কারো পা ছিল না, কারো হাত ছিল না, কারো চক্ষুকোঠরে মণি ছিল না অথবা তাদের সারা শরীর বীভৎসভাবে আগুনে দগ্ধ ছিল। আর এসব দৃশ্য দেখে বোমারু বিমানের সদস্য হিসেবে আমার কাজের কথা মনে পড়ে যায়। আর তাতে আমি স্তব্ধ হয়ে যায়। কথা বলতে পারছিলাম না।’
জাপানের পর আরেক বিধ্বস্ত শহর (যা পরে পুনর্নির্মিত হয়েছিল) ফ্রান্সের হোয়াইওতে যান জিন এবং রজ। সেখানকার মানুষের সঙ্গে কথা বলেন তারা। জিন বলেন, ‘ঐ বছরেই আমি এবং রজ প্যারিস থেকে আটলান্টিক মহাসাগরের পাড়ে যুদ্ধ পরবর্তী পুনঃনির্মিত রোয়ান শহর দেখতে যাই। সেখানে বোমা হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষদের সাথে কথা বলি এবং তা নথিভুক্ত করি। সেসময় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পেছনে একটি বিকল্প অভিপ্রায় আমরা খুঁজে পেয়েছিলাম, আর তা হল- যুদ্ধ শেষ হওয়ার আগে আরেকটি জয় নিশ্চিত করার জন্যই ফ্রান্স এবং মার্কিন সেনাদের প্রয়োজন ছিল ।’
জিন মনে করেন, সর্বজনীনভাবে কোন যুদ্ধই এখনকার এই আধুনিক যুগে স্বীকৃত নয়। ফ্যাসিবাদী শত্রুরা নিঃসন্দেহে “খারাপ লোক” এবং ‘আমরা ভালো’। আর যখনই এই সিদ্ধান্তটি মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়, তখন আর কিছু ভাবনায় আসে না । জিনের মতে, তিনি সে চিন্তাধারা থেকে বের হতে পেরেছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন, যুদ্ধের পরিবেশে দুটো পক্ষের ভূমিকাই এক। আর যুদ্ধ কীভাবে এক পক্ষ থেকে অন্য পক্ষকে অবিভেদ্য করে তার শিক্ষা তিনি তার যুদ্ধের অভিজ্ঞতা এবং পঠিত ইতিহাস থেকে পেয়েছিলেন বলে জানান জিন।