জাল দলিল তৈরী করে ‘খ’ তালিকাভূক্ত অর্পিত হিন্দু সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে একটি মহল উঠে পড়ে লেগেছে। তারা এখন দলিল জালিয়াত চক্রের সাথে আতাত করে অর্থের বিনিময়ে পুরনো ভলিয়মে দলিলের রেজিষ্ট্রার্ট দেখিয়ে হিন্দুদের জমি হাতিয়ে নেবার পায়তারা করছে। এ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে সংশ্লিষ্ট হিন্দু সম্পত্তির মালিক ও ওয়ারিশগণ।
জানা যায়, লৌহজংয়ের হলদিয়া গ্রামের মৃত জগদিস চন্দ্র ঘোষের ছেলে গণেশ ঘোষ উত্তর হলদিয়া মৌজার তার দাদার নামে ‘খ’ তালিকা ভূক্ত সম্পত্তি ওয়ারিশ সূত্রে মালিকানা দাবী করে লৌহজং ভূমি অফিসে দুটি জমাভাগ নামজারি কেস দাখিল করে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগন তদন্তপূর্বক গনেশ ঘোষের ওয়ারিশান সঠিক পেয়ে নামজারির প্রস্তুতি কার্যক্রম শুরু করে। এ সময় কতিপয় ব্যক্তি ওই সকল জমি তাদের দাবী করে ভূমি অফিসে নামজারী না করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে শুরু করে। এতে ভূমি অফিস থেকে ওই ব্যক্তিদের জমির মালিকানার সপক্ষে কাগজপত্রসহ আবেদন করতে বলা হয়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাদের দাবীর সপক্ষে তেমন কোন দলিলাদি না দেখাতে পারায় লৌহজং অফিস হতে গনেশ ঘোষের নামে জমাভাগ নামজারি কেস মঞ্জুর করে অপরাপর ওয়ারিশগনের নামে নামজারি করে দেন। এতে ওই মহলটি সুবিধা করতে না পেরে এখন অন্য কারো নামে পুরোনো দলিল তৈরী করে তা দলিল জালিয়াত চক্রের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের পরবর্তী সময়ের রেজিষ্ট্রি অফিসের ভলিয়মে দলিল লিপিবদ্ধ করতে বিভিন্ন জায়গায় দৌড়ঝাপ শুরু করেছে।
গনেশ ঘোষ জানান, তার দুই দাদু নেপাল গোপ ওরফে নেপাল ঘোষ ও যুদ্দিষ্টি গোপ ওরফে যুদ্দিষ্টি ঘোষের প্রচুর জমি রয়েছে উত্তর হলদিয়া মৌজায়। স্বাধীনতা পরপর্তী সময়ে নেপাল ঘোষ তার সম্পত্তি হতে কিছু পরিমান জমি বিক্রি করলেও যুদ্দিষ্টি ঘোষ তার কোন সম্পত্তি বিক্রি করেননি। কিন্তু নেপাল ঘোষ যে সকল জমি বিক্রি করেছেন, সেকল জমি দুই াইয়ের নামে থাকলেও দলিলে একই দাগের পুরো অংশ লেখে নেয়া হয়। অথচ একই জমির মালিক নেপাল ও যুদ্দিষ্টি। কিন্তু নেপাল ঘোষ জমি বিক্রি করলেও যুদ্দিষ্টি ঘোষের নামটি পর্যন্ত দলিলের কোথাও উল্লেখ নেই। এমনিই একটি দলিল নিয়ে গনেষ ঘোষের নামজারি বন্ধ করতে উপজেলা ভূমি অফিসে হাজির হয়েছিলেন উপজেলার হলদিয়া ইউনিয়নের কারপাশা গ্রামের জনৈক হুমায়ূন কবির খান। তিনি ১২২৫৯-১১২-৮৯/১৯৭৫-ঢাকা নম্বরের একটি দলিল যার রেজিষ্ট্রি তারিখ ৩/৬/১৯৭৫ইং মূলে উত্তর হলদিয়া মৌজার আরএস ৭৭৩ নং দাগের ৭৪ শতাংশ জমির মালিকানা দাবি করেন। কিন্তু ৭৪ শতাংশ জমির মালিক নেপাল ও যুদ্দিষ্টি ঘোষ সমান সমান অংশিদার। দলিলদাতা নেপাল ঘোষ একাই ৭৪ শতাংশ জমি বিক্রি দেখিয়েছে দলিলে। কিন্তু আইনত তিনি অর্ধেক আর্থাৎ ৩৭ শতাংশের মালিক।
অপর ভাই যুদ্দিষ্টি ঘোষের অংশ তিনি আইনত বিক্রি করতে পারেননা। দলিলটি আইন সম্মত না হওয়ায় লৌহজং ভূমি অফিস হতে হুমায়ূন কবির খাননে শুধু নেপাল ঘোষের অংশ তার নামে নামজারি করা যাবে বলে জানিয়ে দেয়া হয়। এবং গনেশ ঘোষের ওয়ারিশান অনুযায়ী যুদ্দিষ্টি ঘোষের অংশ গনেশ ঘোষ ও অপরাপর অংশিদারের নামে নাম জারি করে দেয়া হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে হুমায়ূন খানের মত আরো বেশ কয়েকজন ব্যক্তি এখন অন্য নামে স্বাধীনতা পরবর্তী সময় বা তারও আগের জাল দলিল তৈরী করতে দৌড়ঝাপ শুরু করেছে বলে এলাকায় শুনা যাচ্ছে।
এ ব্যাপরে হুমায়ুন কবির খানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোন মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করে। একটি সূত্র মতে, ওই দলটি এখন জাল দলিল চক্রের সন্ধানে নেমেছে। ইতিমধ্যে তারা জাল দলিল চক্রের কয়েকজনের সাথে যোগাযোগও করেছে। মোটা অকের টাকার বিনিময়ে ওই চক্রটি এই সকল লোকজনের পূর্ব পুরুষদের নামে সেই সময়ের জাল দলিল তৈরী করে দেবে। চক্রটি নাকি সেই সময়ের পুরোনো দলিলকে প্রথমে কম্পিউটারের মাধ্যমে স্কেন করে। তা থেকে প্রিন্ট করে দলিল(নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প) বেড় করে।
এর পর দাগ খতিয়ান নাম্বারসহ তাতে লিখে দলিল তৈরী করে। ওই সময়কার রেজিষ্টারের স্বাক্ষরও নকল করা হয় দলিলে। এর পর তা সেই সময় বা পুরোনো কোন ভলিয়মের ফাঁকা পাতায় দলিলের লেখা লিপি বদ্ধ করে। এর পর বিশেষ এক ধরণের পাউডার ভলিয়ম ও দলিলে কয়েক দিন লাগিয়ে রাখলে লেখাগুলো না-কি পুরোনো হয়ে যায়। যা থেকে বুঝা যাবে তা অনেক বছর আগের লেখা।
তবে অনেক সময় সামান্য কিছু লেখা লিখে ভলিয়মের পাতা ছিড়ে ফেলা হয় বলেও জানা গেছে। তাতে জালিয়াত চক্রটি বুঝাতে চায় পুরোনো ভলিয়ম ছিড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এভাবেই এখন মুন্সীগঞ্জ ও ঢাকার তেজগাঁও রেকর্ড রুমসহ দেশের যে কোন জায়গায় জাল জলিল রেকর্ড ভুক্ত করতে ছুটে চলছেন ওই দলটি। কারণ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে দেশের যে কোথাও যে কোন জায়গার জমি রেজিষ্ট্রি করা যেতো। এতে করে গনেশ ঘোষসহ এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
গনেষ ঘোষ বলেন, আমরা প্রথমে আদালতে আমাদের পূর্ব পুরুষদের সম্পত্তি অবমুক্ত করে আমাদের নামে নামজারির আদেশ চেয়ে মামলা করি। কিন্তু সরকার ‘খ’তালিকা বাতিল করলে সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসে আবেদন করে আমার আমাদের পূর্ব পুরুষদের সম্পত্তি ফিরে পেয়েছি। কিন্তু যদি জালিয়াতি করে আমাদের সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়া হয়, তাহলে আর এ সুযোগের কি মূল্য রইলো। গনেষ ঘোষ বলেন, শুনেছি ওই লোকগুলো এখন আমার দাদুু যুদ্দিষ্টি ঘোষের জমি অন্য কারো নামে বিক্রি দেখিয়ে জাল দলিল তৈরী করে মিস কেস করে আমাদের নামজারি বাতিল করতে দৌড়ঝাপ শুরু করেছে।
তাদের কাছে যদি দলিলই থাকবে তবে প্রায় দুই বছর ধরে শুরু হওয়া খ তালিকার নামজারির জন্য তারা মামলা বা আবেদন করেনি কেন ? তিনি প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেছেন, জালিয়াতি ওই চক্রটি জেনো জাল দলিল তৈরী করে তা পুরোনো ভলিয়মে লিপিবদ্ধ করতে না পারে। শুধু গনেশ ঘোষই নয়, তার মত অনেক ব্যক্তিই এখন এই ভূমি দলিল জালিযাতি রক্রের খপ্পরে পড়ে বিষয় সম্পত্তি হারাতে বসেছে বলে স্থানীয়া জানিয়েছেন। এ নিয়ে এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়সহ জমিরি মালিকদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
এ প্রসঙ্গে মুন্সীগঞ্জ জেলা রেজিষ্ট্রার্ট মো. আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, আমার জানা মতে এরকম কিছু আমার অফিসে সম্ভব নয়। তবে এটা অমূলক কিছু নয়। পূরোনো ভলিয়মের সুযোগ নিয়ে জালিয়াতি চক্ররা আমার অজ্ঞাতসারে এ ধরণের ঘটনা ঘটাতে পারে। কারণ একজন রেজিষ্ট্রার্টের পক্ষে সব সময় ভলিয়ম বুক পাহারা দেয়া সম্ভব নয়। যারা ভলিয়ম বই নিয়ে কাজ করে তারা যদি অসৎ হয়ে যায়, তবে এরকম কাজ করা সম্ভব হতেও পারে।