মুন্সিগঞ্জ, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)
কৃষকের সূক্ষ্ম-নিবিড় পরিচর্যায় বেড়ে উঠছে ‘মুন্সিগঞ্জ স্পেশাল’ শীতকালীন সবজি কপির চারা। বিক্রিও হচ্ছে প্রতিদিন। যা চলবে কার্তিক পর্যন্ত। আগামী শীত মৌসুমের শুরুতে চারা থেকে পূর্ণাঙ্গ রুপ নিয়ে দেশী জাতের এই কপি বিক্রি হবে খুচঁরা বাজারে।
উন্নত মান ও ফলনের কারনে প্রতিবছর আষাঢ়-কার্তিক মৌসুমে একদফায় দেশী জাতের এবং অগ্রহায়ণ-ফাল্গুন পর্যন্ত আরেক দফায় বিদেশী জাতের দানা থেকে কপি চারা উৎপাদন হয় জেলা সদর ও টংগিবাড়ী উপজেলার ১০-১২ হেক্টর জমিতে। যা থেকে কৃষকের আয় কোটি টাকার উপরে।
সম্প্রতি সরেজমিনে সদর ও টংগিবাড়ী উপজেলার বেশ কয়েকটি কপির বীজতলা ঘুরে দেখা যায়, কপির চারা পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষক। কপিক্ষেতের পাশেই ছোট খুপরি ঘর তৈরি করে ২৪ ঘন্টা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছেন তারা।
ভট্টাচার্য্যের বাগ এলাকার চারাচাষী মাসুদ ঢালী জানান, প্রতিবছর শীতের আগে ২০০ শতাংশ জমিতে কপির দানা বপণ করেন তিনি। ৩০-৩৫ বছর যাবৎ এ পেশায় জড়িত তার পরিবার। এবছরও ১২ হাজার টাকায় প্রতিকেজী কপিদানা কিনে জমিতে বুনেছেন। প্রতিকেজী দানা থেকে ১ লাখের উপর কপিচারা জন্ম নিয়েছে। যার পেছনে সর্বমোট ব্যায় হয়েছে ৫ হাজার টাকা। আর ১ টাকা পিস হিসাবে বিক্রি করলে ব্যায়ের সমপরিমাণ লাভের আশা তার। তবে, লোকসানের কোন আশঙ্কা নেই।
তিনি জানান, প্রতিবছর আষাঢ় মাসে দানা বপণ করলে শ্রাবণ মাসে চারা ফুটে উঠে। এক আঙ্গুল পরিমাণ বড় হতেই চারা বিক্রি করে দিতে হয়। বেশি বড় হলে বিক্রির অযোগ্য হয়ে যায়। কপিচারা কৃষক কিনে নিয়ে জমিতে লাগানোর পর পূর্ণাঙ্গ রুপ পায় শীতের শুরুতে। চারা থেকে প্রতিপিস কপি উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয় ৭-৮ টাকা। এরপর পাইকারদের কাছে প্রতিটি কপি বিক্রি হয় ২৫-৩০ টাকায় এবং সবশেষে খুঁচরা বাজারে ক্রেতা পর্যায়ে কপিগুলো বিক্রি হয় ৫০-৬০ টাকায়। একটি চারা থেকে পূর্ণাঙ্গ কপি হতে সময় লাগে ৫৫-৬০ দিন। শীতের শুরুতে সারাদেশে এর চাহিদা থাকে ব্যাপক।
রামপাল এলাকার চাষী আব্দুর রহমান জানান, মুন্সিগঞ্জের কপি বীজের আলাদা বৈশিষ্ট্য হওয়ার কারণ এর পেছনে কৃষকের নিবিড় পরিচর্যা। দানা বপণের পর চারায় রুপান্তরিত হলে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সেগুলোকে পরিচর্যা করতে হয়। সারাদিন রোদ লাগালে চারা মুটিয়ে যায় আবার একেবারেই রোদ না লাগালে ভাপা লেগে নষ্ট হয়ে যায়। তাই বাঁশ ও খলফার মাঝামাঝি রাখতে হয়। যাতে যেকোন সময় চারা ঢেকে দেয়া যায় আবার খুলে রাখা যায়।
কপিক্ষেতের শ্রমিক সালাউদ্দিন জানান, ৭০০ টাকা রোজে কাজ করেন তিনি। জমিতে কপিবীজ বপণের পর থেকে চারা উৎপাদন ও বিক্রি পর্যন্ত দায়িত্ব থাকে তার উপর। বেশি রোদ হলে পানি দিতে হয় কপিচারায়। আবার বেশি বৃষ্টি হলে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হয়।
সদর উপজেলা উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. জাকির হোসাইন জানান, মুন্সিগঞ্জ সদর ও টংগিবাড়ীর ১০-১২ হেক্টর জমিতে প্রতিবছর দুই দফায় কপিচারা উৎপাদন করে ১০-১৫জন কৃষক। দুই মৌসুমে কোটি টাকার উপরে কপিচারা বিক্রি করেন তারা। শীতকাল সামনে রেখে দেশী জাতের কার্তিকা, আইট্টা, কাইট্টা, ষাইটশা ও চালানি ষাইটশা জাতের কপির চারা উৎপাদন হয় এখানে। অন্যদিকে শীতের শুরুতে তাইওয়ান, জাপানীজ জাতের (হাইব্রিড) কপিচারা উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে সিরাজি, হেমাজি, ফ্রেশ, স্নো হোয়াইট, লিনজা। দেশী জাতের দানার তুলনায় বিদেশী জাতের দানার দাম কয়েকগুণ বেশি। ফলে, এর উৎপাদন ব্যায়ও বেশি। অন্যদিকে বিদেশী হাইব্রিড জাতের কপি দেখতে রিষ্টপুষ্ট হলেও দেশী জাতের কপি খেতে সুস্বাদু হওয়ায় এর চাহিদা ক্রেতাপর্যায়ে বেশি।
তিনি বলেন, কপির দানা থেকে চারা উৎপাদনের প্রক্রিয়া অত্যন্ত নিবিড়ভাবে সম্পন্ন করতে হয়। এসময় আবহাওয়ার তাপমাত্রা উঠানামা করলে রোগে আক্রান্তের ঝুঁকি থাকে। আবার উষ্ণ আবহাওয়ায় চারা বড় হয়ে গেলে বিক্রয়ের অযোগ্য হয়ে পড়ে। কপিচারাগুলো খুবই নরম কান্ড বিশিষ্ট। অঙ্কুরিত হওয়া থেকে ৩৫ দিনের মধ্যে এগুলো বিক্রি করে দিতে হয়। তানাহলে এর গুনগত মান নষ্ট হয়ে যায়। তিনি জানান, দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় করণীয়, জলাবদ্ধতা হলে দ্রুত পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা, রোগ-কিটনাশক প্রতিরোধের জন্য ছত্রাকনাশক ছিটাতে কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে নিয়মিত পরামর্শ দেয়া হয় কৃষককে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. আব্দুল আজিজ বলেন, সবজির জন্য সারাদেশে মুন্সিগঞ্জের সুনাম রয়েছে। এ জেলায় প্রচুর উর্বর কৃষি জমি থাকায় কৃষক সকল মৌসুমেই বিভিন্ন কৃষি পণ্য উৎপাদন করে থাকেন। এখানে উৎপাদিত কপি বীজের মান খুব ভালো। তাই এটিকে ‘মুন্সিগঞ্জ স্পেশাল’ বলা হয়ে থাকে। যা স্থানীয় চাহিদা পূরণ করে সারাদেশে চলে যাচ্ছে। কৃষকের প্রতি পরামর্শ থাকবে তারা যেন এই মান ও সুনাম ধরে রাখেন। তাছাড়া যেকোন সহযোগিতায় কৃষি অফিস পাশে থাকবে।