২১শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
বুধবার | সকাল ৮:৪০
সদর আ. লীগের সম্মেলন; নতুন বোতলে পুরনো মদ
খবরটি শেয়ার করুন:

মুন্সিগঞ্জ, ১০ জুন ২০২৩, নিজস্ব প্রতিনিধি (আমার বিক্রমপুর)

দীর্ঘ দশ বছর পর মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্মেলন শেষে কোন প্রতিদ্বন্দী প্রার্থী না থাকায় পূর্বের কমিটি বহাল রাখা হয়েছে।

সরকার ক্ষমতায় থাকা দলে নতুন কোন নেতৃত্ব না আসায় হতাশ নেতাকর্মীরা। তাদের প্রতিক্রিয়া- এ যেন নতুন বোতলে পুরনো মদ।

শনিবার সকাল দশটায় মুন্সিগঞ্জ শহরের বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান স্টেডিয়ামে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও পায়রা উড়ানোর মধ্য দিয়ে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রি বার্ষিক সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এসময় একে একে বক্তব্য দেন অতিথিরা। দুপুর ৩টার দিকে শেষ হয় প্রথম অধিবেশন।

এরপর বিকাল ৫টার দিকে পুরাতন কাচারি এলাকার জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত হয় সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশন। এসময় উপস্থিত বিভিন্ন ইউনিটের নেতাকর্মীদের কাছে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদের বিপরীতে প্রার্থীতা আহবান করেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ লুৎফর রহমান। তবে, কেউ প্রার্থী হতে আগ্রহ না দেখালে বিনা প্রতিদ্বন্দীতায় সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে চরকেওয়ার ইউপি চেয়ারম্যান আফসার উদ্দিন ভুইয়া ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শামছুল কবির মাষ্টারের নাম ঘোষণা করা হয়।

শুরু থেকেই একাধিক প্রার্থী না থাকায় এই সম্মেলনকে ঘিরে নেতাকর্মীদের মাঝে বাড়তি আগ্রহ ছিলো না। সম্মেলনস্থলের আশপাশেও দেখা যায়নি নেতাকর্মীদের তেমন ব্যানার-ফেষ্টুন।

২০১৩ সালে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের ৬৭ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে সভাপতি নির্বাচিত হন আফসার উদ্দিন ভুইয়া ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শামসুল কবির মাষ্টার। দশ বছর পরও তারাই পুনরায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব পেলেন।

ফলে, দল ক্ষমতায় থাকার পরও কেন নতুন নেতৃত্ব তৈরি হলো না তা নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মনে নানা প্রশ্ন রয়েছে। নাকি নিজেদের সুবিধার জন্য আওয়ামী লীগের বিবদমান জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ও সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি বলয়ের মধ্যে গোপন আতাত হয়েছে তা নিয়েও আলোচনা রয়েছে।

সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিলো কৃষি মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক এমপির। তবে তার অনুপস্থিতিতে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম এমপি। উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ মহিউদ্দিন।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত কোন প্রার্থীকে পছন্দ না হলেও চোখ বুঝে শেখ হাসিনার মুখ স্মরণ করে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে নৌকায় ভোট দেয়ার আহবান জানান।

সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, মুন্সিগঞ্জ ৩ আসনের সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক কাজী নজিবুল্লাহ হিরু, সদর উপজেলা চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি আনিছ উজ্জামান।

প্রধান বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ লুৎফর রহমান। বিশেষ বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সোহানা তাহমিনা, মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ফয়সাল বিপ্লব।

এছাড়াও সম্মেলনে জেলার অন্যান্য উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

নেতাদের গোপন আতাত!

সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটি পুনর্বহাল করার পেছনে জেলা আওয়ামী লীগ পক্ষ ও স্থানীয় সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাস পক্ষের সাথে বর্তমান কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের গোপন আতাতের গুঞ্জন চলছে রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে পাড়ার চায়ের দোকানে। মুন্সিগঞ্জে বিশেষত সদর-গজারিয়া উপজেলায় স্থানীয় রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের দুইটি পক্ষ বিরাজমান থাকলেও এই সম্মেলন ঘিরে তারা একত্রিত হয়ে গেছে। তাই সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাসের পক্ষ থেকে কোন প্রার্থী দেয়া হয়নি বলে শোনা যাচ্ছে।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কোনপক্ষই রাজনৈতিক ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। কারণ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের এই দুই প্রার্থীই চরাঞ্চলের বাসিন্দা। চরাঞ্চলের ভোট বা সমর্থন আওয়ামী লীগের জন্য সবসময়ই আশীর্বাদ স্বরুপ। এর মধ্যে আফসারউদ্দিন ভুইয়া চরাঞ্চলের রাজনীতির অন্যতম নিয়ন্ত্রক। তিনি চরকেওয়ার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানও। আর শামসুল কবির মাষ্টার আধারা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান।

এদিকে, আফসারউদ্দিন ভুইয়া জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদের অনুসারী হলেও মহিউদ্দিন পুত্র মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র ফয়সাল বিপ্লবের সাথে তার রাজনৈতিক দূরত্ব রয়েছে। সর্বশেষ চরকেওয়ার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আক্তারুজ্জামান জীবনকে ঘিরে এই দূরত্ব অনেকটা প্রকাশ্যেই দেখা গেছে। এরপর জেলা পরিষদ নির্বাচনেও মেয়র বিপ্লবের অনুসারী আক্তারুজ্জামান জীবনকে ছাড় দেননি আফসু। নিজের ছেলেকে প্রার্থী করেছেন জীবনের বিপক্ষে।

অন্যদিকে, মুন্সিগঞ্জ ৩ আসনের সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাসের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেন আফসারউদ্দিন ভুইয়া ও তার ছেলে মাহমুদুল হাসান সাদি। সবকিছু মিলিয়ে দুই শিবিরেই আস্থাভাজন হয়ে উঠেছেন আফসারউদ্দিন ভুইয়া। আর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জেলা আওয়ামী লীগের সাথে দূরত্ব যাতে তৈরি না হয় সে বিষয়ে সজাগ রয়েছেন সংসদ সদস্য মৃণাল কান্তি দাস। তাই শেষপর্যন্ত জেলা আওয়ামী লীগের সাথে রাজনৈতিক আতাত করেছেন তিনি- এমনটাই বলছেন রাজনৈতিক সচেতন মহল।

বহিস্কৃত নেতার হাতেই নেতৃত্ব!

সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক শামছুল কবির মাষ্টার। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়ে দল থেকে বহিস্কার হয়েছিলেন তিনি। শেষপর্যন্ত নতুন কোন নেতৃত্ব প্রার্থী না হওয়ায় পুনরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন শামছুল কবির মাষ্টার।

মুন্সিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ লুৎফর রহমান জানান, ২০২১ সালের ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত আধারা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনে অংশ নেন শামছুল কবির। প্রথমে তাকে নির্বাচন থেকে সরে দাড়াতে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তিনি না অমান্য করে প্রার্থীতা বহাল রাখলে দল তাকে বহিস্কার করে। তবে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে ক্ষমা চেয়ে আবেদন করলে দল তার উপর থেকে বহিস্কারাদেশ তুলে নেয়।

এদিকে শনিবার সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রি বার্ষিক সম্মেলনে শেষ পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক পদে অন্য কোন প্রার্থী না থাকায় শামসুল কবির মাষ্টার পুনরায় সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হয়েছেন।

ঈদের পরে পৌর সম্মেলন

দশ বছর পর মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে  আজ শনিবার। এর মধ্যেই আলোচনা হচ্ছে, মুন্সিগঞ্জ পৌর শাখা আওয়ামী লীগের সম্মেলন কবে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।

কেননা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মুন্সিগঞ্জ জেলা শহরে এই কমিটির দায়দায়িত্ব অনেক। সরকারবিরোধী আন্দোলনে এই কমিটি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা না রাখতে পারলে যে কোন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

কেননা, বিএনপিসহ অন্যান্য প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দল সবসময়ই শহরকে টার্গেট করে আন্দোলনে নামছে। বিপরীতে পাল্টা কর্মসূচি নিয়ে শহর আওয়ামী লীগকে আলাদা অবস্থানে দেখা যাচ্ছে না। তবে আশার কথা জানালেন মুন্সিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ লুৎফর রহমান।

তিনি বলছেন, সদরের পাশাপাশি পৌর শাখা আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, যে কোন আন্দোলন শহর থেকেই ছড়িয়ে পরে গ্রামে-গঞ্জে। তাই শহরে ভালো, দক্ষ, সাংগঠনিক নেতৃত্ব প্রয়োজন। তিনি জানান, আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে, আগামী ঈদ উল আযহার পর মুন্সিগঞ্জ পৌর শাখার সম্মেলন আয়োজনের।

error: দুঃখিত!