১১ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
মঙ্গলবার | রাত ৮:৪০
শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের পরিবারে চাপা আতঙ্ক
খবরটি শেয়ার করুন:

মুন্সিগঞ্জ, ৭ এপ্রিল, ২০২২, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)

ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাতের অভিযোগে মামলায় কারা অন্তরীণ শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের পরিবারের দিন কাটছে ভয় আর চাপা আতঙ্কে।

বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা গেল, বাইরে থেকে ভেতরে মানুষ আছে এটা যাতে কেউ টের না পায় সেরকম পরিবেশ নিশ্চিত করে ভেতরে থাকছেন পরিবারের সদস্যরা।

মুন্সিগঞ্জের পঞ্চসার ইউনিয়নের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক ছিলেন হৃদয়। তিনি গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ের ক্লাস নিতেন। তবে ঘটনার দিন বিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট থাকায় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের অনুরোধে দশম শ্রেণীর বাংলা দ্বিতীয় পত্রের ক্লাসে গিয়ে নিজের ইচ্ছায় বিজ্ঞান ক্লাস নিচ্ছিলেন হৃদয় মন্ডল। ঐ ক্লাস থেকেই বিক্ষোভের সূত্রপাত। স্কুলটির পাশেই স্কুল থেকে বরাদ্দ পাওয়া একটি কোয়ার্টারে থাকতেন তিনি। সেখানে প্রতিদিন ২-৩ দফায় শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট কোচিং পড়াতেন। তার কাছে অন্তত ৬০-৭০ জন নিয়মিত পড়তেন।

এই কক্ষটিতেই প্রাইভেট কোচিং পড়াতেন শিক্ষক হৃদয় মন্ডল। কক্ষটির সবখানেই যেন বিজ্ঞানমনস্কতার ছাপ। ছবি: আমার বিক্রমপুর।

গতকাল বুধবার (৬ এপ্রিল) দুপুরে হৃদয় মন্ডলের বাড়ির সামনে গিয়ে দেখা যায় বাড়িটির গেট ভেতর থেকে তালাবদ্ধ। কয়েকবার শব্দ করে ডাকলেও কেউ গেট খুলছিলেন না। একপর্যায়ে সজোরে সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে ডাকলে কিশোর বয়সের এক ছেলে এগিয়ে আসে। পরে তার পেছনে আসেন মধ্যবয়সী আরেকজন পুরুষ। তিনি সাংবাদিক পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন আমাদেরকে। নিয়ে বসালেন হৃদয় মন্ডল যেখানে শিক্ষার্থী পড়াতেন সেই কক্ষটিতে।

হৃদয় মন্ডলের সেই কক্ষটির চারিদিক গাণিতিক বিভিন্ন সূত্র, দুইটি বেঞ্চ, টেবিল, একটি ল্যাপটপ, বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক সরঞ্জামাদি ইত্যাদিতে ভরা।

এই টেবিলে বসেই শিক্ষার্থীদের পড়াতেন শিক্ষক হৃদয় মন্ডল। ছবি: আমার বিক্রমপুর।

বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের গণিত শিক্ষক হৃদয় মন্ডল (৫৪) মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার শিকারপুর এলাকার মৃত নন্দ লাল মন্ডলের ছেলে। গত ২০ বছর ধরে তিনি বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। বিজ্ঞান ও গণিত দুই বিষয়েই সে বেশ অভিজ্ঞ।

হৃদয় মন্ডলের ব্যক্তিগত টেবিলের ছবি। ছবি: আমার বিক্রমপুর।

হৃদয় মন্ডলের বিরুদ্ধে দায়ের করা ধর্ম অবমাননার মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, গত ২০ মার্চ দুপুর ৩ টা’র দিকে স্কুলটির ২য় তলার ২০৯নং কক্ষে দশম শ্রেণীর খ শাখার ক্লাস রুমে বিজ্ঞান বিষয়ে ক্লাস নেয়ার সময় তার বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাতের অভিযোগ করে স্কুলের কয়েকজন ছাত্র। স্কুলে মোবাইল ফোন ব্যবহারে নিষেধ থাকলেও তারা ঐদিন মোবাইল ফোনে শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের সাথে এক ছাত্রের কথোপকথন রেকর্ড করে। এর ২ দিন পর ২২ মার্চ হঠাৎ করেই উত্তেজনা শুরু হয় স্কুলটিতে। ক্লাস ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা। তারা শিক্ষক হৃদয়কে আটকের দাবিতে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে শুরু করে। একপর্যায়ে পুলিশ এসে ঘটনাস্থল থেকে শিক্ষক হৃদয় মন্ডলকে থানায় নিয়ে যায়।

বিজ্ঞানকে ভালোবাসতেন। ভালোবাসতেন জগৎ খ্যাত বরেণ্য ব্যক্তিদের। হৃদয় মন্ডলের ব্যক্তিগত টেবিলের পাশেই চোখে পড়লো দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ-বিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী নেলসন ম্যান্ডেলা ও ভারতের পরমাণু বিজ্ঞানী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালামের পেপার কাটিং। তাদের মৃত্যু তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাই এই দু’জনের মৃত্যুর পর পেপার কাটিং সংগ্রহ করে সাটিয়ে রেখেছেন শিক্ষক হৃদয়। ছবি: আমার বিক্রমপুর।

ঐদিনই মুন্সিগঞ্জ সদর থানায় বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের অফিস সহকারি (ইলেক্ট্রিশিয়ান) বিনোদপুর এলাকার মৃত ইস্রাফিল মিয়ার ছেলে মো. আসাদ (৩০) বাদী হয়ে পেনাল কোডের ২৯৫/২৯৫ ধারায় ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত ও কোরআন শরীফকে অবমাননা করার অভিযোগে মামলা দায়ের করেন।

পুলিশ আটক শিক্ষক হৃদয় মন্ডলকে পরদিন জেলহাজতে প্রেরণ করে।

শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের পালিত বিড়াল। যে টেবিলের সামনে দাড়িয়ে হৃদয় পড়াতেন সেই টেবিলে মাথা নিচু করে বসে আছে বিড়ালটি। ছবি: আমার বিক্রমপুর।

দশম শ্রেণির যে শিক্ষার্থী ঐদিন হৃদয় মন্ডলের কথোপকথন মোবাইলে রেকর্ড করেছিলো তার সাথে কথা হয় ‘আমার বিক্রমপুর’ এর। দশম শ্রেণীর কমার্সের ছাত্র জুনায়েদ আল একান্ত জানান, ঐদিন শিক্ষক সংকটের কারণে প্রধান শিক্ষকের অনুরোধে বাংলা ২য় পত্র ক্লাস নিতে যান হৃদয় মন্ডল। সেখানে গিয়ে তিনি নিজেই বাংলা পড়ানো বাদ দিয়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ানো শুরু করেন। তিনি ক্লাস নিয়েছিলেন দেড় ঘন্টা। আর রেকর্ড করেছিলাম আমি ৩৬ মিনিট। পাশে থাকা বন্ধুর পরামর্শে রেকর্ড করি আমি। অন্য কারো প্ররোচনায় নয়। ঐদিন টিফিনের পরে এমনিই আমি স্কুলে ফোন নিয়ে যাই। আগে থেকে আমার উদ্দেশ্য ছিলো না স্যারের কথা রেকর্ড করার। রেকর্ড করে প্রধান শিক্ষককে শুনাতে চেয়েছিলাম আমরা। যেদিন বিক্ষোভ হলো তার আগের দিন আমাদের ক্লাসের ৩-৪ জন লিখিত আকারে আমাদের অভিযোগগুলো প্রধান শিক্ষককে জানাই। স্যার আমাদের পরদিন হৃদয় মন্ডল স্যারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন। এরপরে আর সে বিষয়ে আমি খোঁজ নেইনি। কিন্তু আমার অন্য বন্ধুরা কয়েকজন বড় ভাইকে নিয়ে পরদিন আন্দোলন শুরু করে। বড় ভাইরা স্থানীয়। এরপর সব ক্লাস থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা আন্দোলনে যোগ দেয়।

শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের প্রাইভেট কোচিং কক্ষে চোখে পড়ে বিভিন্ন গাণিতিক সূত্র। ছবি: আমার বিক্রমপুর।

হৃদয় মন্ডলের স্ত্রী ববিতা হাওলাদার জানান, ধর্মীয় অনুভুতিতে আঘাত হানতে পারে এরকম কোন কথা আমার স্বামী বলেনি। আদালতে দুই দফায় হৃদয় মন্ডলের জামিন চাওয়া হলেও আদালত হৃদয়ের জামিন নামঞ্জুর করেন। বর্তমানে ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে দিন কাটছে। ছোট ছেলের স্কুলে যাওয়া বন্ধ। আমরা ভীত, আতঙ্কিত ও বিচলিত।

তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী ডায়াবেটিসের রোগী। কারাগারে সে ঔষধ ছাড়াই আছে।’

হৃদয় মন্ডলের বন্ধু পপন চন্দ্র সরকার জানান, প্রাইভেট পড়ানো নিয়ে এক শিক্ষকের সাথে দ্বন্দ ছিলো হৃদয়ের। পুরো ঘটনাটি তাদের উস্কানিতেও হয়ে থাকতে পারে। সিরাজদিখানের কুচিয়ামোড়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ সালে সেকেন্ড ডিভিশন পেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় সে। পরে শ্রীনগর কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশ করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা জগন্নাথ কলেজ থেকে গণিতে অনার্স ও মাষ্টার্স করেন তিনি। এরপর সে বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। এখানেই গত ২১ বৎসর যাবৎ শিক্ষকতা করছেন তিনি।

শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের প্রাইভেট কোচিং কক্ষের বোর্ডের ছবি। ছবি: আমার বিক্রমপুর।

হৃদয় মন্ডলের স্ত্রী’র বড় ভাই বাদল হাওলাদার জানান, বোনের নিরাপত্তাহীনতার কথা ভেবে তিনি গত কযেকদিন যাবৎ নিজের পরিবার রেখে বোনের বাসায় থাকছেন। পুরো ঘটনাটিকে পূর্ব পরিকল্পিত মনে হচ্ছে তার।

তিনি বলছেন, ‘ঘর থেকে বাইরে বের হই না। এলাকার লোকজন এড়িয়ে চলি। সবসময়ই আতঙ্কে থাকি। বাইরে কোন শব্দ পেলেই বিচলিত হয়ে পরি।’

মুন্সিগঞ্জ আদালত সূত্রে জানা যায়, গত ২৮ মার্চ হৃদয় মন্ডলের পক্ষে অ্যাডভোকেট দেবদাষ মন্ডল দীপু জামিন চেয়ে নিম্ন আদালতে আবেদন করলে ঐ আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল্লাহ আল ইউসুফ জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেন। পরবর্তীতে ঐ আদেশের প্রেক্ষিতে আসামী পক্ষের আইনজীবী গত ৪ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জ সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আসামীর জামিনের জন্য ফৌজদারি মিস মামলা দায়ের করেন। ঐ মামলাটি অর্থাৎ হৃদয় মন্ডলের জামিনের বিষয়ে আগামী ১০ এপ্রিল শুনানীর জন্য ধার্য করেছেন সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আমজাদ হোসেন।

error: দুঃখিত!