১৪ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
সোমবার | সকাল ১০:৩৯
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.
নদীবেষ্টিত হওয়ায় মুন্সিগঞ্জ জেলাজুড়ে রাসেল ভাইপার আতঙ্ক
খবরটি শেয়ার করুন:

মুন্সিগঞ্জ, ১৯ জুন ২০২৪, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)

চারপাশ থেকে নদীবেষ্টিত হওয়ায় মুন্সিগঞ্জ জেলাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে বিষধর সাপ রাসেল ভাইপার আতঙ্ক। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চর্চা হচ্ছে বেশ। তবে, মুন্সিগঞ্জে রাসেল ভাইপার ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে যা বলা হচ্ছে তার কতটুকু সত্য- এমন প্রশ্নও রয়েছে অনেকের মনে।

পদ্মা অববাহিকা ধরে দক্ষিণাঞ্চলের অনেক জেলায় রাসেল ভাইপার ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের রাজশাহী, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ, চাঁদপুর, হাতিয়া, ভোলাতে রাসেল ভাইপারের উপস্থিতি বেশি পাওয়া গেছে। তবে গেল বছরগুলোতে মুন্সিগঞ্জ জেলায়ও এই সাপের উপস্থিতি বেশ টের পাওয়া যায়।

মুন্সিগঞ্জে সর্বপ্রথম রাসেল ভাইপার ধরা পড়ে ২০১৯ সালে। ওই বছরের ২৮ এপ্রিল পদ্মা তীরবর্তী লৌহজংয়ের ঘোড়দৌড় বাজার এলাকায় গৌতম কুমার সাহার বাড়ি থেকে একটি রাসেল ভাইপার উদ্ধার করেন স্থানীয় সাপুড়েরা। সেবছর নভেম্বর মাসের ২৮ তারিখ পদ্মা তীরবর্তী লৌহজং উপজেলার বেজগাঁও ইউনিয়নের মালিরঅংক এলাকা থেকে ৪ ফুট দৈর্ঘ্যের নারী রাসেল ভাইপার উদ্ধার হয়। পরে সেটি বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট, বন বিভাগের কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। একইসময় আরও দুইটি রাসেল ভাইপার স্থানীয়রা দেখতে পেলেও সেগুলো রয়ে যায় ধরাছোয়ার বাইরে।

সেসময় প্রকাশিত খবরের লিংক: মুন্সিগঞ্জে রাসেল ভাইপার উদ্ধার, বংশ বিস্তারের সম্ভাবনা

২০১৮ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে পদ্মার চর থেকে রাসেল ভাইপারকে অজগর ভেবে এক ব্যক্তি বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। এরপর রাসেল ভাইপারের কামড়ে তিনি মারা যান। মুন্সিগঞ্জে রাসেল ভাইপারের কামড়ে সেটিই প্রথম মৃত্যু বলে ধারণা করা হয়।

২০২০ সালের ৪ জুলাই মেঘনা নদী তীরবর্তী মুন্সিগঞ্জ সদরের বাংলাবাজার ইউনিয়নের সরদারকান্দি গ্রামের জেলে আবুল হোসেন (১৮) এর চাঁইয়ে (মাছ ধরার ফাঁদ) ধরা পড়ে রাসেল ভাইপার সাপ। একইবছর ২৩ আগস্ট পদ্মা নদী তীরবর্তী টংগিবাড়ী উপজেলার পাঁচগাও ইউনিয়নের দশত্তর গ্রামের রাসেল ঢালী রাসেল ভাইপার সাপ আটক করেন। আরও একটি রাসেল ভাইপার ধরা পড়ে ঐ বছরের ২৯ নভেম্বর পদ্মা নদী তীরবর্তী দিঘিরপাড় ইউনিয়নের মিতারাঁ এলাকার একটি পুকুরের কচুরিপানার ভেতর থেকে। স্থানীয় অপু মন্ডল সাপটি উদ্ধার করেন। পরে সেটি চট্টগ্রাম ভেনম রিসার্চ সেন্টারের কর্মকর্তারা নিয়ে যান।

২০২৩ সালের জুলাই মাসে পদ্মা নদী তীরবর্তী লৌহজং উপজেলার কনকসার গ্রামে টিংকু বর্মন (৩২) নামের এক যুবক নিজ ঘরে খাবার খাওয়ার সময় রাসেল ভাইপারের আক্রমণের শিকার হন। তবে দ্রুত চিকিৎসা নেয়ায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান।

একই বছরের নভেম্বরে একই উপজেলার বেজগাঁও ইউনিয়নের সুন্দিসার এলাকায় পদ্মা নদীতীরের একটি চর থেকে রাসেল ভাইপার সাপ আটক করেন স্থানীয়রা। একই মাসে মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার আধারা ইউনিয়নের মেঘনা নদী তীরবর্তী কালিরচর এলাকায় রাসেল ভাইপারের কামড়ে একজন আক্রান্ত হন।

সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার (১৮ জুন) লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ ইউনিয়নে পদ্মা নদীর একটি চরে রাসেল ভাইপার ধরা পড়ে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একাধিক পোষ্টে দাবি করা হয়।

তথ্য বলছে, রাসেল ভাইপার সাধারণত ঘাস, ঝোপ, বন, ম্যানগ্রোভ ও ফসলের ক্ষেতে, বিশেষত নিচু জমির ঘাসযুক্ত উন্মুক্ত ও কিছুটা শুষ্ক পরিবেশে বাস করে। স্থলভাগের সাপ হলেও এটিকে পানিতে দ্রুতগতিতে চলতে পারে। ফলে বর্ষাকালে কচুরিপানার সঙ্গে বহুদূর পর্যন্ত ভেসে নিজের স্থানান্তর ঘটাতে পারে। এরা নিশাচর, এরা খাদ্য হিসেবে ইঁদুর, ছোট পাখি, টিকটিকি ও ব্যাঙ ভক্ষণ করে। বসতবাড়ির আশেপাশে রাসেল ভাইপারের খাবারের প্রাচুর্যতা বেশি থাকায় খাবারের খোঁজে চন্দ্রবোড়া অনেক সময় লোকালয়ে চলে আসে।

রাসেল ভাইপার প্রচন্ড আক্রমনাত্মক হয়ে থাকে। পৃথিবীতে প্রতিবছর যত মানুষ সাপের কামড়ে মারা যায়, তার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ এই চন্দ্রবোড়ার কামড়ে মারা যায়। এদের বিষদাঁত বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃহৎ। এরা প্রচণ্ড জোরে হিস হিস শব্দ করতে পারে। চন্দ্রবোড়া দিনে ও রাতে উভয় সময়ে কামড়ায়। অন্য সাপ মানুষকে দংশনের পর সেখান থেকে দ্রুত সরে যায়, কিন্তু রাসেল ভাইপার ঘটনাস্থল থেকে সরতে চায় না। অন্য সাপ সাপ শিকারের সময় শিকারকে কামড় দিয়ে সাথে সাথে খেয়ে ফেলে কিন্তু রাসেল ভাইপার কামড় দিয়ে ছেড়ে দেয়। প্রচণ্ড বিষের যন্ত্রণায় ইঁদুর যখন তার গর্তের দিকে ছুটে চলে রাসেল ভাইপার তার পিছু পিছু গিয়ে সে গর্তে ঢুকে সব ইঁদুরকে খেয়ে ফেলে।

অন্য সাপ মানুষকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করলেও এ সাপটি স্বভাব তার বিপরীত। তাই প্রতিবছরই উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ কেবল এ সাপটির কামড়েই প্রাণ হারান। আক্রমণের ক্ষিপ্র গতি ও বিষের তীব্রতার কারণে ‘কিলিংমেশিন’ হিসেবে বদনাম রয়েছে সাপটির।

রাসেল ভাইপারের বিষ হেমাটোটক্সিক, যার কারণে কামড় দিলে মানুষের মাংস পচে যায়। রাসেল ভাইপারের বিষ ফুসফুস, কিডনি নষ্ট করে দেওয়ার মতো বিভিন্ন জটিলতা তৈরি করে। রাসেল ভাইপার সাপের কামড়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ক্ষতস্থান ফুলে যায়।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মাসুদ কনক বলেন, ‘এই সাপটি ভাইপারিডি পরিবারভূক্ত একটি বিষাক্ত সাপ। এর সাধারণ ইংরেজি নাম রাসেল’স ভাইপার। বৈজ্ঞানিক নাম Daboia russelii স্কটল্যান্ডের সরীসৃপ বিশেষজ্ঞ প্যাট্রিক রাসেল এর নামকরণ করেন। এটি ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র, দক্ষিণ চীন ও তাইওয়ানে পাওয়া যায়। এটি শুস্ক পরিবেশে বাস করে। হালকা শুষ্ক বনাঞ্চল ও শুষ্ক ঝোপ ও তৃণভূমি এদের পছন্দের বাসস্থান। জলাশয়ের ধারে কাছে এদের পাওয়া যায় না। এরা তীব্র বিষধর সাপ। এর কামড়ে তীব্র যন্ত্রণা, শরীর ফুলে যাওয়া, বমিভাব, মাথাঘোরা প্রভৃতি লক্ষণ দেখা দেয়। পরিণতিতে কিডনি বিকল হয়ে রোগীর মৃত্যু হয়।

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগে এ সাপের আধিক্য দেখা যায়। মুন্সিগঞ্জ অঞ্চলে বিরল। সাধারণভাবে থাকার কথা নয়। কারণ, এ অঞ্চল নিম্নভূমি ও বছরের অনেক সময় জলমগ্ন থাকে যা এই সাপের পছন্দ নয়।’

সাপ কামড়ালে কি করা উচিৎ?

সাপের দংশনের শিকার হলে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের পরামর্শ অনুযায়ী যা করণীয় তা হলো:

* শান্ত থাকুন এবং অতিদ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন

* শরীরের যে স্থানে সাপ কামড়েছে সেটি যতটা কম সম্ভব নড়াচড়া করুন। ঘড়ি বা অলঙ্কার পড়ে থাকলে তা খুলে ফেলুন।

* কাপড়ের বাঁধ ঢিলে করুন, তবে খুলবেন না।

নিম্নবর্তী কোনও পদক্ষেপ নেয়ার চেষ্টা করবেন না:

* কামড়ের স্থান থেকে চুষে বিষ বের করে আনার চেষ্টা করা

* কামড়ের স্থান আরও কেটে বা সেখান থেকে রক্তক্ষরণ করে বিষ বের করে আনার চেষ্টা করা

* বরফ, তাপ বা কোনও ধরনের রাসায়নিক কামড়ের স্থানে প্রয়োগ করা

* আক্রান্ত ব্যক্তিকে একা ফেলে যাওয়া

* কামড়ের স্থানের গিঁটের কাছে শক্ত করে বাঁধা। এর ফলে বিষ ছড়ানো বন্ধ হবে না এবং আক্রান্ত ব্যক্তি পঙ্গুও হতে পারেন।

* বিষধর সাপ ধরা থেকেও বিরত থাকা উচিত। এমনকি মৃত সাপও সাবধানতার সাথে ধরা উচিৎ, কারণ সদ্যমৃত সাপের স্নায়ু মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ পরও সতেজ থাকতে পারে এবং তখন তা দংশন করতে পারে।

error: দুঃখিত!