তানজিনা আকতারী মৌমীঃ
“মধ্যরাতে এসেছে আজ একুশে ফেব্রুয়ারি,
এদিকে যে বেড়েই চলেছে পোড়া লাশের সারি!
হায়রে আমার দেশ,
অপরিকল্পিতভাবে সেজেছো তুমি বেশ!”
মৃত্যু, কান্না, আহাজারি, পোড়া গন্ধ, ধোঁয়া, আর্তনাদ, আকুতি, চিৎকার সব মিলেমিশে একাকার হয়ে আছড়ে পড়েছে চকবাজারের চুড়িহাট্টায়। কিন্তু কীভাবে ঘটেছে এমন অঘটন?
স্থানীয় জনসাধারণ জানান- যানজটে আটকে থাকা একটি পিকআপ-ভ্যানে প্রথমে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ঘটে। আগুন ধরে যায়। আগুন ধরে পাশের একটি সিএনজি অটোরিকশায়, মোটরসাইকেলে। এরপর আগুন ছড়িয়ে পড়ে চকবাজারের নন্দকুমার দত্ত রোডের চুড়িহাট্টা এলাকার পুরো চৌরাস্তায়। একে একে বিস্ফোরিত হতে থাকে গাড়ির সিলিন্ডার। পাশের দুটি রেস্টুরেন্টের গ্যাস সিলিন্ডারগুলো বিস্ফোরিত হয়। বৈদ্যুতিক খুঁটির ট্রান্সফর্মারও বাদ যায় না। যারা ছিলেন গাড়িতে, মোটরসাইকেলে, অটোরিকশা, রিক্সা বা অন্য কোন বাহনে অথবা বাড়ি ফিরছিলেন পায়ে হেঁটে, আশেপাশের দোকানে, হোটেলে কেউ রক্ষা পাননি। আগুনের নির্মম হাত ছুঁয়ে গেছে সবাইকে। আগুন ছড়িয়ে গেল ভবনে, দোকানে, নেলপালিশের কেমিক্যালের গোডাউন থেকে শুরু করে পারফিউমের কেমিক্যালে, লাইটার রিফিলের গ্যাসের ছোট ছোট জারে। তারপর আর সব আগুন লাগার ঘটনায় যা দেখা যায়, তারই পুনরাবৃত্তি। দিনের আলো ফুটলে দেখা গেল কয়লা, মানুষের……
৯ বছর আগের নিমতলীর পোড়া ছাই বসন্তের বাতাসে উড়ে গিয়ে গতরাতে বসেছিল চুড়িহাট্টায়। নিমতলীর ঘটনা আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম প্রায়। সে সময় পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকা থেকে এসব বিপজ্জনক কেমিক্যাল গুদাম ও কারখানা সরিয়ে নেয়ার জোরালো দাবি উঠেছিল এবং সরকারও এসব কারখানা ২ মাসের মধ্যে সরিয়ে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল। কিন্তু, বাস্তবতা হলো এত বছরেও সরকারের সে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয়নি। প্রতিবছরই এখানে কোন না কোন কেমিক্যাল গুদাম বা কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটছে। এই এলাকার বাড়িগুলোতেও মজুদ রাখা হয় উচ্চমাত্রার দাহ্য বিস্ফোরক রাসায়নিক। ন্যূনতম নিরাপত্তা সতর্কতা বা অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থাপনা না থাকায় এই এলাকার বাড়ি একেকটা বিস্ফোরকের গুদামের মতই মহাবিপজ্জনক।
নিমতলী ট্র্যাজেডি, তাজরিন গার্মেন্টস ট্র্যাজেডি, রানাপ্লাজা ধ্বস ট্র্যাজেডি, গুলশান ডিএনসিসি মার্কেটে অগ্নিকাণ্ড, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের অগ্নিকাণ্ডসহ প্রায় প্রতিটা ঘটনার পরই ফায়ার সার্ভিসের দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার খতিয়ান বেরিয়ে এসেছে। চোখের সামনেই শত শত মানুষের জীবন ও সর্বস্ব হারানোর আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী হয়েছে। পরিবেশের জন্য বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের উৎস এসব গুদাম ও কারখানা সরিয়ে নিয়ে আধুনিক নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত স্থানে স্থানান্তর করার জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে। দেশবাসী আরও তাজরিন, নিমতলী, চুড়িহাট্টার ট্র্যাজেডি দেখতে সত্যিই প্রস্তুত নয়। তবু দেখতে হচ্ছে। কিন্তু, আমরাই বা কতটা নিরাপদ? প্রতিনিয়ত যে গাড়িটাতে চড়ছি, সেটার সিলিন্ডার কতটা নিরাপদ আমাদের জন্য? গ্যাস সিলিন্ডারের এই শহর, কতটা ভয়ঙ্কর মরণফাঁদ নিয়ে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য? যে বাসায় বাস করছি, সেখানে কতটুকু আছে আগুন নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা? যেখানে কেনাকাটায় যাচ্ছি, ছেলেমেয়ের শিক্ষাগ্রহণের স্থানে কি আছে প্রাণ বাঁচানোর, আগুন থেকে রক্ষা পাবার উপায়?
বসবাসের অযোগ্য শহরের উন্নয়নের ধারা দেখতে দেখতে আমরা আজ শুধু অভ্যস্তই নই, ক্লান্তও বটে। যে উন্নয়নের সাথে নিরাপত্তা, অগ্নি নির্বাপক ট্রেনিং বা ক্যাম্পেইন, অসুস্থ ব্যক্তির প্রাথমিক চিকিৎসা, পর্যাপ্ত ওষুধ, ড্রেসিং ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, এ্যাম্বুলেন্স ও আগুন নেভানোর যানবাহন দ্রুত চলাচলের জরুরি পথ না থাকে, যানজট ও সরু পথের কারণে যাতায়াতের পথেই মানুষের পরিচয় হয় “লাশ”, সেই উন্নয়ন আমাদের জন্য কতটুকুই বা কাজের?
প্রায়ই কতোই না বস্তি উচ্ছেদ হয়, কিন্তু, কেন হয় না পুরানা ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউন উচ্ছেদ? কেন দেখা হয় না গাড়ির ও রান্নায় ব্যবহৃত সিলিন্ডারের মান ও মেয়াদ? আমাদের ক্লান্তির অবসান ঘটবে তখন, যখন আমরা আসলেই এক নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পাব। আসলেই কোন একদিন কি পাবো সেই কাঙ্ক্ষিত আশ্রয়টুকু?
যারা চলে গেলেন, তারা ক্ষমা করবেন আমাদের। আর কত মানুষ পুড়লে বিবেক জাগবে আমাদের? প্রশ্নটা আবারও রেখে গেলাম…।
গণমাধ্যম কর্মী ও সংবাদ পাঠক, বাংলাদেশ বেতার