২০শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
সোমবার | রাত ১০:৩২
মুন্সীগঞ্জে মাটির নিচে পাওয়া প্রাচীন সোনা-রূপা ভর্তি কৌটার আসল কাহিনী
খবরটি শেয়ার করুন:

মুন্সীগঞ্জে মাটির নিচ থেকে উদ্ধার করা সোনা-রূপা নিয়ে অনুসন্ধানে প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এগুলো প্রায় চার দশক ধরে মাটির নিচে ছিল। এই সোনা-রূপার গহনাগুলো ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের রথের জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা বিগ্রহের। সদর উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন ইদ্রাকপুরে মাটি খননের সময় দুই শ গ্রাম ওজনের সোনা ও রূপাসহ তামার কৌটা উদ্ধার হয়।

নুরুল ইসলাম কমান্ডারের বাড়িতে বহুতল ভবন নির্মাণে শ্রমিকের সাবলের আঘাতে তামার কৌটার মোটকা খুলে গহনা বেরিয়ে আসে।

ইউএনও সারাবান তাহুরা প্রাচীন কানের দুল, মাটলি, বাকু, স্বর্নের পুথি, রৌপ্য ও রৌপ্যের মোহরসহ কৌটাটি ট্রেজারিতে জমা রেখেছেন। রথের তিনটি বিগ্রহের গহনাগুলোর ঐতিহ্য মূল্য অনেক। কিন্তু এর সংরক্ষনকারী বাড়িটি মেয়েদের দান করে দেয়ার পর অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়ার কারণে মূল্যবান এই সম্পদ মাটির নিচেই চাপা থেকে যায়।

ইদ্রাকপুরের প্রবীন বাসিন্দা রমেন কুমার বনিক রবি জানান, গহনা উদ্ধার হওয়া বাড়িটির পূর্ব মালিক ছিলেন হর কান্ত পাল। শহরে ইদ্রাকপুরের লক্ষী নারায়ন জিউর মন্দির থেকে প্রায় দুই শ বছর ধরে নিয়মিত রথ যাত্রা হত। জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা এই তিনটি বিগ্রহকে গহনা পরানো হত। এসব গহনাগুলো মন্দির থেকে চুরির আশঙ্কায় তৎকালীন কর্মকর্তা হর কান্ত পালের তত্ত্বাবধানে ছিল। এই রথ ইদ্রাকপুরস্থ উপজেলা পরিষদ (তৎকালীন থানা পরিষদ) কার্যালয়েরর প্রধান গেটের পাশে এবং মন্দিরের উত্তর-পশ্চিম কোনে মন্দিরের নিজস্ব জায়গায় রাখা হত। পরবর্তী পরিস্থিতিতে স্বাধীনতা কিছু পরে এই বিগ্রহ ও রথের ঘোড়া ঢাকার তাঁতী বাজারস্থ জগন্নাথ জিউর মন্দিরে দান করা হয়। এখনও ওই মন্দিরে ঐতিহ্যবাহী এসব বিগ্রহ রয়েছে। তবে পরিস্থিতি পরিবর্তন হওয়ায় কয়েক বছর পরেই নতুন রথ নির্মাণ করে নতুন বিগ্রহ তৈরি করে লক্ষী নারায়ণ জিউর মন্দির থেকে প্রতি বছর রথ ও উল্টো রথ যাত্রা চালু করা হয়।

কিন্তু এই পুরনো বিগ্রহের গহনা হার কান্ত পালের কাছেই রয়ে যায়। তিনি নিরাপত্তার কারণ্রে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা বিগ্রহের গহনা মাটির হারির ভেতরে একটি তামার কৌটায় কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে রাখেন। হর কান্ত পালের কোন পুত্র ছিল না। তাই হর কান্তর দুই কন্যা ভানু রানী পাল ও শান্তি রানী পালকে প্রায় সাড়ে আট শতাংশের বাড়িটি দান করে যান। দানের বছর তিনেক পরে ৩০/৩৫ বছর আগে কন্যারা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নরুল ইসলামের কাছে বাড়িটি বিক্রি করে দেন। এই জমি বিক্রির সময় হর কান্ত পাল সস্ত্রীক মেয়ের বাড়ি মিরকাদিমের নগর কসবায় বসবাস করছিলেন। কিন্তু এই জমি বিক্রির বছর তিনেক পরে হর কান্ত পাল পরলোক গমন করেন। মুত্যুর কয়েক বছর আগে থেকেই বার্ধক্যজনিত কারণে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তখন হর কান্ত পাল কথা বলতে পারতেন না। তাই হয়ত মৃত্যুর আগে মাটির নিচের এই গহনার কথা বলে যেতে পারেননি বা মন্দির কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিতে পারেননি। এর ২/৩ বছর পরেই হর কান্ত পালের স্ত্রীও মারা যান। হর কান্ত পালের কন্যা শান্তি রানী পাল (৭২) রবিবার এই গহনা উদ্ধারের খবর পেয়ে বিকালে তাদের পুরনো বাড়িতে আসেন। তিনি বলেন, এসব গহনা যে মাটির নিচে আছে এটি তার বাবা কখনও তাদের বলে যেতে পারেননি। গহনাগুলো তাদের নিজস্ব বা পারিবারিক ছিল না। এটি মন্দিরের গহনা এবং তা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল তার বাবার। তিনি এই গহনার কথা বলে যাওয়ার আগে অসুস্থ হয়েছিলেন। হর কান্ত পাল ছিলেন একজন স্বর্ণকার। শহরের সদর রোডের বাজারের কাছে পালের দোকানের বিপরীতেই ছিল তার স্বর্ণের দোকান। এটি তখন হরকান্ত পোদ্দারের দোকান হিসাবেই পরিচিত ছিল। ওই সময় স্বর্ণকাররা পোদ্দার হিসাবেই পরিচিত ছিলেন।

৬২ বছরের বৃদ্ধ রমেন কুমার বনিক রবি নিশ্চিত করে জানান, তিনি নিজের চোখে ৫০ বছর আগে এসব গহনা ঠাকুরকে পরাতে দেখেছেন। তখন রমেন কুমার বনিক রবির বয়স ছিল বার বছর। বর্তমানে তিনি মুন্সীগঞ্জ বাজারের বস্ত্র ব্যবসায়ী।

ইদ্রাকপুর লক্ষী নারায়ণ জিউর মন্দিরের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক অভিজিৎ দাস ববি হিন্দু সম্প্রদায় ঐতিহ্যবাহী এসব গহনা মন্দিরকে ফেরত দেয়ার দাবি জানিয়েছে।

জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল হাসান বাদল জানান, মাটির নিচ থেকে পাওয়া প্রাচীন এই সোনা-রূপার বিস্তারিত খোঁজ খবর করেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

error: দুঃখিত!