মুন্সিগঞ্জ, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)
সদর উপজেলার পঞ্চসার ইউনিয়নের নয়াগাঁও পার হলেই পৌরসভার ইদ্রাকপুর শুরু। ওদিকে মুন্সিরহাটে গিয়ে শেষ হয়েছে শহর। এরপর চরাঞ্চলের ৫টি ইউনিয়ন। এদিকে কাটাখালি বাজার পার হয়ে শহর শেষ হয়ে শুরু হয়েছে মহাকালী ইউনিয়ন। মাঝে মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার ৪১ টি মহল্লা। প্রায় প্রতিটি মহল্লাতেই হাত বাড়ালেই মিলছে মরণঘাতি মাদকদ্রব্য ইয়াবা-ফেনসিডিল, গাঁজা-হেরোইন ইত্যাদি।
আশপাশের ইউনিয়নগুলির তুলনায় শহরে যাতায়াত-আবাসন ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়মিত নজরদারির বাইরে থাকার সুবিধা থাকায় গড়ে উঠেছে মাদকের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। এর নেপথ্যে রয়েছেন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। এদের অনেকেই আবার ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত। এলাকাভিত্তিক মাদক কারবারি আলাদা হলেও মূলহোতারা একে অপরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেই বিক্রি করছেন মাদক।
অন্যদিকে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, ছেলেদের পাশাপাশি বন্ধুবান্ধবের পাল্লায় পড়ে মাদক সেবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে শহরে বসবাসরত বিভিন্ন স্কুল-কলেজগামী মেয়েরাও। গেল বছর শহরে আলোচিত এক হত্যাকান্ডের ঘটনায়ও শোনা যায়- নেপথ্যে ছিলো মাদকসেবন, অবাধ মেলামেশা ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনাচার।
শুধু মাদকসেবনই নয় মাদক বিক্রি ও পরিবহনে মুন্সিগঞ্জ শহরের বিভিন্ন মহল্লায় বাসা ভাড়া নিয়ে শক্তিশালী মাদক নেটওয়ার্কের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছেন একাধিক নারী মাদক কারবারি। পাশের জেলা নারায়ণগঞ্জ থেকেও নির্বিঘ্নে প্রতিদিন যাতায়াত করছেন বড় বড় রাঘববোয়ালদের মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রক নারীরা।
আমার বিক্রমপুরের নিজস্ব অনুসন্ধান, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য ও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রকরা এসব তথ্য দিয়েছেন।
সচেতন মহলের অভিযোগ, শহরে মাদকের ভয়াবহ বিস্তার হলেও এর তুলনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট দপ্তর বা সংস্থার অভিযানের সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। ফলে, অনেকটা মাদক ব্যবসায়ীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে মুন্সিগঞ্জ শহর।
এদিকে, সম্প্রতি শহরে সরেজমিন দেখা গেছে- কম জনবহুল এলাকা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ চলাচলের গুরুত্বপূর্ণ এলাকাতেও বাঁধাহীনভাবে মাদকসেবন করে যাচ্ছে উঠতীবয়সী ছেলে-মেয়েরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থা বা মাদক নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বরত বিভিন্ন দপ্তরের পক্ষ থেকে একাধিক ঝটিকা অভিযানে মাঝেমধ্যে মাদকসেবীদের আটক করে সাজা-জরিমানা করতে দেখা গেলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করছেন সচেতন নাগরিকরা।
এলাকায় লোকমুখে প্রচলিত আছে, শহরের যেসব মহল্লা বা এলাকায় কিশোর-তরুণ, যুবকদের প্রকাশ্যে মাদকসেবন করতে দেখা যায় সেগুলো হলো- হাটলক্ষীগঞ্জ এলাকার বেরি বাঁধ, মাঠপাড়া এলাকায় শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ লেফটেন্যান্ট ফ্লাইট মতিউর রহমান স্টেডিয়ামের ভেতরে, ইদ্রাকপুর কেল্লা সংলগ্ন এলাকা, সুপারমার্কেট বিএনপি কার্যালয়ের পেছনে, রাতে মোল্লারচর রেষ্টুরেন্ট পাড়া এলাকায়, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের বিপরীতে নির্মানাধীন পৌর শিশু পার্কের ভেতরে সহ ইত্যাদি জায়গায় দিনভর মাদকসেবিদের আনাগোনা দেখা যায়। এসব এলাকায় হেটে গেলেও পায়ে পায়ে চোখে পড়ে ফেনসিডিলের বোতল। দেখা মিলে গাঁজা-হেরোইন সেবনে ব্যস্ত রয়েছেন মাদকসেবীরা।
হাটলক্ষীগঞ্জ বেরি বাঁধ এলাকায় বাঁধের উপরে বসে দুপুরের পর থেকেই গাঁজা সেবন করতে দেখা যায় বিভিন্ন স্কুল-কলেজের উঠতীবয়সী সন্তানদের। সন্ধ্যায় এই আড্ডা বাড়ে আরও। রাত যত গভীর হয় এই আড্ডায় অংশ নেয় মেয়ে বন্ধুরাও। এদের কর্মকাণ্ডের কারনে আশপাশের নাগরিকরা বেরি বাঁধ ব্যবহার করে চলাফেরা করতেও ইতস্তত বোধ করেন।
নয়াগাও পূর্বপাড়া এলাকার বাসিন্দা রহিমা বেগম বলেন, প্রয়োজনীয় কোন কাজে লঞ্চঘাটে যেতে এই পথটি সহজতর হলেও মাদকসেবীদের উৎপাতে এই পথ ব্যবহার করা যায় না। এরা এতটাই নির্লজ্জ যে, মা-বাবার বয়সী ব্যক্তিদের দেখলেও তারা তাদের কাজ চালিয়ে যায়। এখন তো আরও আধুনিক সমাজ চলে এসেছে। ছেলেদের সাথে মেয়েদেরও দেখি বসে সিগারেট-গাঁজা সেবন করতে।
শহরে কারা মাদক ব্যবসা করে বা কোন কোন স্পটে মাদক বিক্রি হয় এর কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে। তবে ‘যখনই যেখানে খবর পাওয়া যায় সেখানেই অভিযান চালানো হয়’ বলে দাবি করেন ডিবির ওসি ফখরুদ্দীন ভুইয়া।
অভিযোগ আছে, শহরের যেসব মহল্লায় অন্তত একটি হলেও মাদক বিক্রির আস্তানা রয়েছে সেগুলো হলো- মানিকপুর, হাসপাতাল রোড, হাসপাতালের নতুন ভবনের সামনে, সুপারমার্কেট বিএনপি কার্যালয়ের পেছনে, হাটলক্ষীগঞ্জ বেরি বাঁধ, ইদ্রাকপুর, জগদ্ধাত্রীপাড়া, মালপাড়া, জমিদারপাড়া, গণকপাড়া, বৈখর, পশ্চিম দেওভোগ, রনছ, পূর্বশিলমন্দি, চরশিলমন্দি, কাচারি চত্বর ও এর আশপাশের বেশ কয়েকটি মুদি সদাইর দোকান, দক্ষিণ কোর্টগাও, লিচুতলা, মাঠপাড়া, কোর্ট সংলগ্ন এলাকা, দক্ষিণ ইসলামপুর, পাঁচঘড়িয়াকান্দি, চরশিলমন্দি, চরহায়দ্রাবাদ, গুচ্ছগ্রাম, উত্তর ইসলামপুর, নয়াপাড়া। এসব এলাকায় একাধিক ব্যক্তি জড়িত মাদক ব্যবসার সাথে। তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে জড়িত স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।
মোল্লারচর এলাকার আব্দুল কাদির বলেন, মোল্লারচর ঢুকতে যোগিনীঘাট ব্রিজের নিচে মোল্লারচর অংশে, এছাড়া রেষ্টুরেন্ট পাড়া ও লাড্ডুম শাহের খানকা শরীফ এলাকায় দিনদুপুর থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি চলে। অথচ প্রশাসনের এখানে নজরদারি নেই।
সরকারি হরগঙ্গা কলেজের অধ্যক্ষ সুভাষ চন্দ্র হীরা বলেন, মাদকাশক্তি সমাজের সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ নেশা। এ নেশার ছোবলে দেশের যুবসমাজের একাংশ বর্তমানে চরমভাবে আক্রান্ত। মুন্সিগঞ্জ শহর তথা জেলাতেও এই আসক্তি দৃশ্যমান। স্বার্থান্বেষী মাদক ব্যাবসায়ীরা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ নেশার বীজ ছড়িয়ে দিচ্ছে যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। যুবসমাজকে এর থেকে দূরে রাখতে এবং সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে অভিভাবক, শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, শিল্পী, বিভিন্ন প্রশাসনের ব্যক্তিবর্গ এবং দেশের প্রত্যেক সচেতন নাগরিককে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
মুন্সিগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মু. আবু সাঈদ সোহান বলেন, উঠতি বয়সী ছেলেদের পাশাপাশি নতুন করে মেয়েদেরও মাদক সেবনে অভ্যস্ত হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগের। অপরাধ-অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে এই মাদক। মুন্সিগঞ্জ শহরের যে চিত্র তা চলতে থাকলে সামাজিক অবক্ষয়ের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলার অবনতিও ঘটবে। তাই সামাজিক সংগঠনগুলোকে এগিয়ে এসে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজটি করতে হবে পাশাপাশি অভিভাবকদের তাদের সন্তানের উপর নজরদারি বাড়াতে হবে। তারা স্কুল-কলেজের নাম দিয়ে অন্য কোথাও সময় কাটাচ্ছে কি না বা মন খারাপের কথা বলে বাসা থেকে বের হয়ে বিপথগামী বন্ধু-বান্ধবের সাথে মিশছে কি না এসব বিষয়ে কঠোর হতে হবে।
জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক সিবনাথ কুমার সাহা বলেন, শহরে মাদক বিক্রির চিহ্নিত স্পট বা মাদককারবারিদের বিষয়ে আমাদের কাছে কিছুটা তথ্য রয়েছে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করি। তিনি বলেন, এর বাইরেও সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য থাকলে অভিযান পরিচালনা করা হবে।
সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থান্দার খায়রুল হাসান বলেন, মুন্সিগঞ্জ শহরে মাদক ব্যবসার কোন স্পট আছে বলে আমার কাছে তথ্য নেই। যারা এসবের সাথে জড়িত তারা ভ্রাম্যমাণ। দেখা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়াতে মোটরসাইকেলে করে বা পোটলায় করে তারা মাদক সরবরাহ করে থাকে। অনেকক্ষেত্রে পেমেন্ট নেয় মোবাইল ব্যাংকিংয়ে।
তিনি বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে আমাদের জিরো টলারেন্স নীতি। এর সাথে জড়িত ব্যক্তি যত প্রভাবশালী হউক তার বিষয়ে কোন আপোষ পুলিশ করবে না। শহরে আমাদের নিয়মিত নজরদারি প্রয়োজনে আরও বাড়ানো হবে। মাদক ব্যবসায়ী ও যারা প্রকাশ্যে মাদক সেবনের সাথে জড়িত তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে।