১২ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
বৃহস্পতিবার | রাত ৪:২৯
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.
মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল: দালাল পোষেন কতৃপক্ষই!
খবরটি শেয়ার করুন:

মুন্সিগঞ্জ, ৬ মার্চ, ২০২৩, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)

মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে মাসে গড়ে অন্তত ৩০ হাজার মানুষ চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন। এর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশের রোগ পরীক্ষা করতে হয়।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শুধুমাত্র মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের রোগীদের কাছ থেকেই হাসপাতালের আশপাশের অন্তত ১৩টি ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের আয় মাসে কোটি টাকার উপরে। সরকারি এই হাসপাতালে উন্নত মানের মেশিন এবং দক্ষ টেকনিশিয়ান ও চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকেন। এরই মধ্যে হাসপাতালের ল্যাবে যুক্ত হয়েছে হেমোটোলজি অটো অ্যানালাইজার সিস ম্যাক্স এক্সএন-৫৫০ ভার্সন মেশিন। এই মেশিনে সিবিসিসহ ১২ ধরনের পরীক্ষা একসাথে করা যায়। এই অত্যাধুনিক মেশিন মুন্সিগঞ্জে আর কোথাও নেই। এছাড়াও ডিজিটাল এক্স-রে, ইসিজি এবং আল্ট্রাসনোগ্রাফ রয়েছে। হাসপাতালে নির্দিষ্ট সরকারি ফি দিয়ে উন্নতমানের পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ডাক্তাররা বেশিরভাগ রোগীকে পরীক্ষা করতে বাইরের ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠান এবং তাদের আয় থেকে নিয়মিত কমিশন পান তারা।

অন্যদিকে, প্রায় ৯০ শতাংশ রোগীকেই অ্যান্টোবায়োটিক লিখে দেন ডাক্তাররা। মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে বিভিন্ন রোগের ১১টি অ্যান্টিবায়োটিকের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলেও বেশিরভাগ রোগীকে বাইরের বেসরকারি ঔষধ কোম্পানির অ্যান্টিবায়োটিক কিনতে বাধ্য করেন ডাক্তাররা। সাধারণ ঔষধের তুলনায় অ্যান্টিবায়োটিকের দাম বেশি হওয়ায় সাধারণ রোগীদের বেগ পেতে হয়। হাসপাতালে বিনামুল্যে থাকা অ্যান্টিবায়োটিকও বাধ্য হয়ে বাইরের ফার্মেসি থেকে কেনেন রোগীরা। এছাড়া প্রয়োজনের ‍তুলনায় বেশি অ্যান্টিবায়োটিক লিখে দেয়ার ব্যাপারেও কথা উঠেছে।

গতকাল সরেজমিন মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি ডাক্তারের কক্ষেই একাধিক ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের প্রতিনিধি বা দালালরা রয়েছেন। তারা হাসপাতাল থেকে ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে রোগী আনা নেয়া করছেন। হাসপাতালে কম মূল্যে বিভিন্ন রোগ পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও প্রকাশ্যেই এসব প্রতিনিধি বা দালালের মাধ্যমে রোগীদের বাইরের ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠাচ্ছেন ডাক্তাররা।

অভিযোগ রয়েছে, ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ঔষধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের কাছ থেকে নিয়মিত কমিশন নিয়ে রোগীদের জিম্মি করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছেন ডাক্তাররা।

এই যখন বাস্তব চিত্র তখন জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সাফাই গাইলেন ডাক্তারদের কমিশন বাণিজ্যের পক্ষেই। আর প্রাইভেট ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক ওনার’স এসোসিয়েশন, মুন্সিগঞ্জের সভাপতি বলেন ভিন্ন কথা।

প্রতিটি ডাক্তারের কক্ষেই দালাল

মুন্সিগঞ্জ সদর হাসপাতাল সড়কের সুপারমার্কেট থেকে শুরু করে মানিকপুর পর্যন্ত দুইপাশে অন্তত ১৩টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার-ক্লিনিক রয়েছে। এর সবকয়টিই গড়ে উঠেছে সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের টার্গেট করে। সদর হাসপাতাল থেকে প্রতিদিন রোগী নিয়ে আসার জন্য এদের আলাদা লোকবল নিয়োগ দেয়া রয়েছে।

ডাক্তারদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলে রোগীদের নানা কথায় মন ভুলিয়ে নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টার-ক্লিনিকে নিয়ে যান তারা। গতকাল মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল ঘুরে ও বিভিন্ন সেবাপ্রার্থীর সাথে কথা বলে পাওয়া গেছে এমন চিত্র।

গতকাল রোববার দুপুরে কোমরের ব্যাথা নিয়ে মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের সহকারি সার্জন ডা. তানভিন হাসান মাহমুদ অপুকে দেখাতে আসেন মুন্সিগঞ্জ সদরের আব্দুল হান্নান। ডাক্তারের পাশের কক্ষেই সরকারি এক্স-রের ব্যবস্থা থাকলেও ডাক্তার তাকে পাঠান বাইরের সিটি ক্লিনিকে। নিরুপায় হয়ে আব্দুল হান্নান ১হাজার টাকায় বাইরে থেকে শোল্ডারের দুইটি এক্স-রে পরীক্ষা করান। অথচ হাসপাতালে করলে তার খরচ হতো ৬০০ টাকা।

এসময় তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ডাক্তাররা সরাসরি রোগীদের ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পাঠাচ্ছেন। দালালরা ডাক্তারের রুমের ভেতরে তাদের পাশে দাড়িয়ে থাকে। আমরা কোন প্রতিবাদ করতে পারিনা।

এসময় একই ধরনের অভিযোগ করেন মুন্সিগঞ্জ সদরের কলি বেগম। তিনি বলেন, ডাক্তার আমাকে মেডিল্যাব ডায়াগনস্টিক সেন্টারে এক্স-রে করতে পাঠায়। সেখানে আমার ৪০০ টাকা খরচ হয়েছে। অথচ হাসপাতালে করলে খরচ হতো ১০০ টাকা।

মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের নাক, কান, গলা ও হেড-নেক বিশেষজ্ঞ ডা. মোহাম্মদ ইমরান খানের কক্ষের সামনে গিয়ে দেখা যায় প্রকাশ্যে রোগীদের সাথে দেনদরবার করছেন ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালরা।

এসময় মুন্সিগঞ্জ সদরের এনি আক্তার অভিযোগ করে জানান, আমার ৮বছর বয়সী মেয়ে তাকওয়ার কানে ব্যাথার জন্য ডাক্তারের কাছে আসলে তিনি কানের এক্স-রে করতে দিয়েছেন। আমি ডাক্তারের কক্ষ থেকে বের হয়ে আসার সময় অপরিচিত এক মহিলা আমাকে ডেকে বলে আমার সাথে চলেন আমি ১০০ টাকা কমে করে দিবো। পরে আমি তার পরিচয় জানতে চাইলে তার নাম শারমিন এবং তিনি স্থানীয় সুরক্ষা ডায়াগনস্টিকে কাজ করেন বলে জানান। এসময় তার সাথে কথা কাটাকাটি হলে তিনি ডাক্তারের রুমের ভেতর থেকে রিপন নামের আরও একজনকে ডেকে নিয়ে আসেন। সেও ঐখানে কাজ করেন বলে জানান।

এনি আক্তার বলেন, আমি সদর হাসপাতালে সেবা নিতে এসেছি। আমার যেখানে ইচ্ছা পরীক্ষা করাবো। ডাক্তারের রুমে এভাবে ক্লিনিক- ডায়াগনস্টিক সেন্টারের দালালরা বসে থাকলে সাধারণ মানুষ বুঝবে কি করে এরা দালাল না সাধারণ মানুষ।

এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রাইভেট ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক ওনার’স এসোসিয়েশন, মুন্সিগঞ্জের সভাপতি আয়নাল হক স্বপন বলেন, হাসপাতালে কোন ক্লিনিক- ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লোক থাকে না। হাসপাতালে থাকবে সরকারি ষ্টাফ। সেখানে প্রাইভেট ক্লিনিক- ডায়াগনস্টিক সেন্টারের থাকার কথা না, এবং তাদের থাকা উচিৎ না। সেখানে তাদের যাওয়ার প্রশ্নও আসে না।

হাসপাতালের আশপাশের গড়ে উঠা ক্লিনিক- ডায়াগনস্টিকে সেন্টারে সেবা নিতে আসা বেশিরভাগই রোগীই মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল থেকে আসে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা রেজিষ্টার্ড না দেখে বোঝা যাবে না।

মুন্সিগঞ্জ সিভিল সার্জন ও জেনারেল হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়ক ডা. মঞ্জুরুল আলম ডাক্তারের রুমে বহিরাগতদের অবস্থান ও কর্মকান্ডের বিষয়ে অবগত রয়েছেন জানিয়ে বলেন, ‘ডাক্তারের সাথে সরকারিভাবে কোন সহযোগী দেয়া হয় না। শৃঙ্খলার জন্য আমাদের নিজস্ব কিছু ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেয়ার চেষ্টা করি। কোন কোন ডাক্তার তার নিজস্ব চেম্বারের বা অন্য কাউকে বলে যে, তুই একটু দাড়া- এরকম আছে।’ প্রতিটি ডাক্তারের রুমেই কিছু ব্যক্তিগত নিজস্ব লোকজন আছে এবং সেটিও তিনি জানান বলে জানান সিভিল সার্জন।

তিনি আরও বলেন, ল্যাবগুলোতে ডাক্তাররা রোগীদের রেফার করে কিছু কমিশন পান এটা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত মেডিকেলের একটা পদ্ধতি। আর আমি যে ব্যবস্থা নিবো-ব্যবস্থা নেয়ার মত কোন আইন নাই।’

অ্যান্টিবায়োটিক না দিলে লাভ কার?

মুন্সিগঞ্জ সদরের আফসানা বেগম অভিযোগ করে বলেন, আমি আমার জ্বরে আক্রান্ত শিশুকে নিয়ে ডা. সালাহউদ্দিন আহমেদের কাছে যাই। তিনি আমার শিশুকে জিম্যাক্স সিরাপ (অ্যাজিথ্রোমাইসিন) ও প্যারাসিটামল সিরাপ লিখে দেন। আমি তাকে হাসপাতাল থেকে দেয়ার ব্যবস্থা করে দেয়ার কথা বললেও তিনি কোন কথা বলেননি। পরে আমি বাইরের ফার্মেসি থেকে ২০০ টাকায় জিম্যাক্স সিরাপ (৫০এমএল) ও ৩৫ টাকায় নাপা (প্যারাসিটামল) সিরাপ (৬০ এমএল) কিনি।

একই ধরনের অভিযোগ করেন শিউলি বেগম। তিনি বলেন, আমি ও আমার ভাবি ডাক্তার দেখাতে আসি। আমাকে ডাক্তার সেফ-৩ ট্যাবলেট (সেফ্রাডিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক) লিখে দেয়। অন্যদিকে আমার ভাবিকে হাসপাতাল থেকে সরকারি সেফ্রাডিন (অ্যান্টিবায়োটিক) দেয়া হয়। আমার ভাবি সরকারি অ্যান্টিবায়োটিক পেলে আমি বাইরে থেকে টাকা দিয়ে কিনবো কেন? এমন তো নয় যে হাসপাতালে সরবরাহ নেই। হাসপাতালে পর্যাপ্ত অ্যান্টিবায়োটিকের সরবরাহ রয়েছে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, সেবা নিতে আসা একটি বড় অংশই শিশু রোগী। ঠান্ডা-জ্বরসহ বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় তাদের অ্যান্টিবায়োটিক সিরাপ নেয়ার পরামর্শ দেন ডাক্তাররা। তবে, হাসপাতালে সরবরাহ না থাকায় তাদের বাইরে থেকে চড়া দামে অ্যান্টোবায়োটিক কিনতে হয়।

মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে স্টোর কিপার মো. ওবায়দুল হক গতকাল জানান, হাসপাতালে বিভিন্ন রোগের ৯ ধরনের ট্যাবলেট-ক্যাপসুল ও ২ ধরনের অ্যান্টোবায়োটিক ইঞ্জেকশনের সরবরাহ ও মজুদ রয়েছে। সেগুলো হলো- ক্যাপসুল সেফিক্সিম২০০-৪০০, সেফুরক্সিম৫০০, এজিথ্রোমাইসিন৫০০, সেফ্রাডিন৫০০, ফ্লুক্লক্সাসিলিন৫০০, ডক্সিসাইক্লিন১০০ ও এমোক্সাসিলিন ২৫০/৫০০। ট্যাবলেট সিপ্রোফ্লক্সাসিন ও পেনিসিলিন ভি। এবং ইনজেকশন সেফট্রিয়াক্সোন ১-২ গ্রাম, ও মেরোপেনম। তবে শিশুদের কোন অ্যান্টিবায়োটিক সিরাপ সরবরাহ নেই।

তিনি বলছেন, রোগীদের চাহিদার তুলনায় অ্যান্টিবায়োটিকের পর্যাপ্ত মজুদ আছে। তারপরও কেন সবাই অ্যান্টিবায়োটিক পান না এমন প্রশ্ন করলে তিনি কোন উত্তর দিতে পারেননি।

এসব বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে সিভিল সার্জন ডা. মঞ্জুরুল আলম বলেন, ‘আমরা ডাক্তারদেরকে বলি এবং যে ঔষধগুলো রয়েছে তার তালিকাও তাদের সরবরাহ করি। এরপরও ডাক্তাররা যদি না লেখে আমি তো ডাক্তারদের জিজ্ঞাসা করতে পারি না।’ ডাক্তাররা কোম্পানির কাছ থেকে কোন সুবিধা নিয়ে তাদের খুশি করতে ঔষধ লেখে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সেটার উত্তর আমি দিতে পারবো না।’

 

error: দুঃখিত!