ছেলেটির বাড়ি মুন্সিগঞ্জ শহরেই। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফলাফল করেছিলেন। পরিবার-প্রতিবেশীদের আশা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবেন। জীবনে বড় কিছু করবেন। কিন্তু মাদকে আসক্ত হয়ে তিনি লেখাপড়াই ছেড়ে দিয়েছেন।
মুন্সিগঞ্জে এমন অনেক তরুণের অভিভাবকই এখন সন্তানদের ইয়াবা আসক্তি নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় আছেন। জেলা ও উপজেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির সাম্প্রতিক বৈঠকগুলোতে আলোচনার প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে মাদক; বিশেষ করে ইয়াবা। জেলায় উদ্ধার করা মাদকের ধরন বিশ্লেষণ করে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, মাদকের ৯৫ শতাংশই ইয়াবা।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, মুন্সিগঞ্জে এখন যত ফৌজদারি মামলা আছে, তার ৭৫ শতাংশই মাদকের মামলা। গত সাড়ে চার বছরে এই জেলায় মাদকের মামলা হয়েছে প্রায় ছয় হাজার। গ্রেপ্তার হয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার লোক।
জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে এ জেলায় ৮ হাজার ৩০০ ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করা হয়েছিল। এ বছরের প্রথম নয় মাসে উদ্ধার করা হয়েছে ৪৬ হাজার ৯৬০টি ইয়াবা বড়ি। অর্থাৎ, পাঁচ বছরে জেলায় ইয়াবার সরবরাহ সোয়া তিন গুণ বেড়েছে।
পুলিশ সূত্র ও স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন, মুন্সিগঞ্জ জেলাটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের মধ্যে পড়ায় এবং নদীপথে সহজ যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকায় খুব সহজেই ইয়াবা চলে আসছে। ফলে স্কুলপড়ুয়া কিশোর থেকে অনেক তরুণ-যুবক ইয়াবাসহ অন্য দু-একটি মাদকের নেশায় আসক্ত হচ্ছেন।
মুন্সিগঞ্জের রানা শফিউল্লাহ কলেজের অধ্যক্ষ সুখেন চন্দ্র ব্যানার্জি বলেন, স্কুল-কলেজের অনেক তরুণই ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। কেবল পুলিশ ব্যবস্থা নিলেই হবে না, অভিভাবকদেরও এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত প্রভাবশালী অনেকেই ইয়াবা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ায় মূল হোতারা গ্রেপ্তার হচ্ছেন না। ফলে মাদক সমস্যারও সমাধান হচ্ছে না। জেলার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের অন্তত পাঁচজন ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত বলে জানিয়েছে একাধিক গোয়েন্দা সূত্র। তবে যাঁরা গ্রেপ্তার হচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগই মাদকসেবী। খুচরা মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে যাঁরা ধরা পড়ছেন, তাঁরা দ্রুতই জামিনে বেরিয়ে আবার একই কাজে যুক্ত হচ্ছেন। এর মধ্যে কানা সুমন, জাকারিয়া, আক্তার ঢালীসহ ১০-১৫ জন উল্লেখযোগ্য।
মুন্সিগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির দপ্তর সম্পাদক কাজী মোজাম্মেল হোসেন বলেন, মাদক এখন মুন্সিগঞ্জের প্রধান সামাজিক সমস্যা। তাঁর মতে, মাদকের মামলার সংখ্যা অনেক বাড়লেও বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে আসামিরা জামিনে বেরিয়ে এসে পুনরায় মাদক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
পুলিশ প্রশাসন, স্থানীয় বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শহর ও শহরের আশপাশের যেসব জায়গায় ইয়াবা বিক্রি ও সেবন করা হয়, তার মধ্যে নয়াগাঁও, মুক্তারপুর, মানিকপুর, শিলমন্দি, গণকপাড়া, সরদারপাড়া, পাঁচঘড়িয়াকান্দি, দেওভোগ, হাটলীগঞ্জ, খালইষ্ট, মাঠপাড়া, উত্তর ও দক্ষিণ ইসলামপুর, মালপাড়া, রামপাল, সিপাহীপাড়া, বিনোদপুর, আবদুল্লাহপুর, বেতকা চৌরাস্তা, মিরকাদিম, বজ্রযোগিনী উল্লেখযোগ্য। পুলিশ অনেকবার এসব জায়গায় অভিযান চালিয়ে ইয়াবাসহ অনেককে আটক করেছে।
মাদকের কারণে অপরাধের প্রবণতাও বাড়ছে বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা বললেন, কয়েক মাস আগে সদর উপজেলার বজ্রযোগিনী ইউনিয়নে ইয়াবা বিক্রিতে বাধা দেওয়ায় মোহাম্মদ রুবেল (২৫) নামের এক যুবককে ব্যাপক মারধর করা হয়েছে। মাদকের টাকা ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে সিরাজদিখান উপজেলার কেইয়ান ইউনিয়নে শেখ জিন্নাত আলী (৪৫) নামের এক ব্যবসায়ী খুন হয়েছিলেন।
জেলা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির সদস্য ও জেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক কুতুবউদ্দিন আহমেদ বলেন, মুন্সিগঞ্জে মাদকের ব্যবসা বেড়েছে। আইনশৃঙ্খলা কমিটির প্রতিটি বৈঠকে এ নিয়ে কথা হচ্ছে। জেলার গ্রামগঞ্জেও ইয়াবা ঢুকে যাচ্ছে। এই মাদকের বিরুদ্ধে এখনই সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।
পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা অভিযোগ করেন, মাদকের মামলার আসামিদের গ্রেপ্তার করা হলেও তারা আদালত থেকে সহজে জামিন পেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সাজাও হয় কম।
তবে আদালত সূত্র বলছে, এ বছরের শুরুতে আদালতে মোট সাড়ে আট হাজার ফৌজদারি মামলা ছিল। গত দশ মাসে সেই সংখ্যা কমে সাড়ে ছয় হাজারে এসেছে। এর মধ্যে ২০১১ সালের মাদকের মামলাগুলোর বিচারকাজ শেষ করেছেন আদালত। চলতি বছরের মধ্যে ২০১২ সালের সব মামলাও শেষ হয়ে যাবে। এই সময়ের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, অনেক মামলায় পুলিশ সাক্ষ্য দিতে আসে না। অনেক সময় সাক্ষ্যে ব্যাপক গরমিল থাকে। ফলে আসামিরা পার পেয়ে যায়। মাদকের মামলার তদন্তও নির্ধারিত সময়ে শেষ না করার অভিযোগ আছে পুলিশের বিরুদ্ধে। মামলার জব্দ তালিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকছে।
মুন্সিগঞ্জ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) আবদুল মতিন বলেন, ‘মুন্সিগঞ্জের ফৌজদারি মামলার বারো আনাই মাদকের। কিন্তু মাদকের অনেক মামলায় পুলিশ সাক্ষ্য দিতে আসে না। কাগজপত্রে গরমিল থাকে। ফলে আসামিরা পার পেয়ে যায়। এ বিষয়ে পুলিশের জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।
জেলা পুলিশ সুপার বিপ্লব বিজয় তালুকদার বলেন, ‘আমি এই জেলায় যোগদানের পর থেকেই মাদক নির্মূলের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। এ বছরের নয় মাসেই আমরা দুই কোটি টাকা মূল্যের মাদক উদ্ধার করেছি। মাদক নির্মূলে এলাকাবাসীকেও এগিয়ে আসতে হবে।’ তবে মাদক মামলার আসামিরা দ্রুত জামিন পেয়ে যান বলে অনুযোগ আছে তাঁরও। পুলিশের অবহেলার কারণেও অনেক আসামি পার পেয়ে যায়—এমন অভিযোগ সম্পর্কে এসপি বলেন, ‘অতীতে কী হয়েছে জানি না। কিন্তু আমি নিজেই এখন মাদকের মামলা তদারক করছি।’