মুন্সিগঞ্জ, ২২ অক্টোবর ২০২৩, ডেস্ক রিপোর্ট (আমার বিক্রমপুর)
মুন্সিগঞ্জ প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, ভাষাসৈনিক, সফল চারণ সাংবাদিক সফিউদ্দিন আহমেদ এর ১৪তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ রোববার (২২ অক্টোবর)।
সফিউদ্দিন আহমেদের গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার হাড়িদিয়া গ্রামে। তার বাবা জলকদর দেওয়ান বার্মিজ জাহাজের সারেং ছিলেন।
সফিউদ্দিন আহমেদ স্কুলে পড়তে থাকাকালীন সময় থেকেই সাংবাদিকতা করেন, ছাত্র রাজনীতি করেন, চলি্লশের দশকে তিনি অবিভক্ত ভারতে কংগ্রেসে যোগ দেন।
১৯৪৩ সালে সাপ্তাহিক জনযুদ্ধ নামক পত্রিকায় কাজ শুরু করেন তিনি। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সময় সফিউদ্দিন আহমেদ ছিলেন ঢাকার জগন্নাথ কলেজের ছাত্র পরিষদের নেতা।
তিনি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গড়ে-ওঠা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে সক্রিয় কর্মী ছিলেন, জগন্নাথ কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এছাড়া ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে যে ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার সঙ্গে সম্পৃক্তির অভিযোগে অন্যান্য দেশবরেণ্য নেতাদের সঙ্গে তাঁকেও কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়।
পাকিস্তান রাজত্বকালে সাধারণ মানুষের দুর্দশা ও সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে সাংবাদিক হিসেবে তাঁর সাহসী ও বলিষ্ঠ ভূমিকার জন্যে তিনি বেশ কয়েকবার জেল খাটেন দেশের বিভিন্ন জেলার কারাগারে। জেলে থাকাকালীন অবস্থায় কয়েকবার তাঁর ওপর নির্দয় অত্যাচার ও নিপীড়ন-ও হয়।
সফিউদ্দিন গ্রাম ও মফস্বলের সাংবাদিকদের ন্যায্য বেতন, সম্মান ও বিবিধ সুযোগ সুবিধার জন্যে আজীবন লড়ে গিয়েছেন। অকুতোভয় সফিউদ্দিন আহমেদ প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমে এইসব দাবিদাওয়া নিয়ে দিনের পর দিন যুদ্ধ করেছেন।
দেশের নামকরা সব জাতীয় দৈনিকে, যেমন- আজাদ, ইত্তেফাক, সংবাদ, ইত্তেহাদ, মিল্লাত, আমার দেশ, বাংলাদেশ অবজার্ভার, মর্নিং নিউজ ইত্যাদি কাগজে তিনি কাজ করেছেন।
‘দৈনিক বাংলা’ বন্ধ না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত সেখানেই সাংবাদিকতা করতেন তিনি। সফিউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ মফঃস্বল সাংবাদিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি এই সংস্থায় ৭ বার প্রেসিডেন্ট ও তিনবার জেনারেল সেক্রেটারি নির্বাচিত হন।
১৯৬২ সালে তিনি মুন্সিগঞ্জ প্রেস ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন, এবং প্রথম বছর সেই প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্টও ছিলেন। এছাড়া জাতীয় প্রেস ক্লাব ও বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে বরাবর যুক্ত ছিলেন।
আস্তর্জাতিক প্রেস কাউন্সিল আয়োজিত ২৬টি দেশের সাংবাদিকদের নিয়ে সংগঠিত সম্মেলনে সফিউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি মুন্সিগঞ্জ থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘বিক্রমপুর বার্তা’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। সাংবাদিকতায় তাঁর বিশেষ অবদানের জন্যে তিনি বহুরকম পুরস্কার ও সম্মান লাভ করেন। এর মধ্যে জাতীয় পুরস্কার যেমন রয়েছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দেওয়া বেশ কিছু স্থানীয় পুরস্কার-ও রয়েছে।
বর্তমান মুন্সিগঞ্জ প্রেসক্লাবের মিলনায়তন কক্ষের নামকরণ করা হয়েছে সাংবাদিক সফিউদ্দিন আহমেদ মিলনায়তন।
ভাষা সৈনিক সফিউদ্দিন আহমদ সংবাদপত্র ও মফস্বল সাংবাদিকতাকে ব্রত করে দেশ ও জনগণের সমস্যা এবং গণমনের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করার দায়িত্বটুকু নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করে গেছেন।
সাংবাদিকতায় অবদান রাখায় ১৯৯৯ সালে জনকণ্ঠ প্রতিভা সম্মাননা’, ২০০২ সালে মাওলানা মনিরুজ্জামান (চট্টগ্রাম) স্বর্ণপদক, মওলানা ভাসানী স্বর্ণপদক, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া পদক পান।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চারদলীয় জোট সরকারের সময় বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকা অবস্থায় ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে ২০০৬ সালে এক সুফি সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বন্দি থাকা রাজবন্দী সফিউদ্দিন আহমদকে সম্মাননা ও পদক প্রদানসহ জায়নামাজ ও তসবি প্রদান করেন। বাংলাদশে সুফি পরিষদ-২০০৬ পদক ও অতীশ দীপঙ্কর পদকসহ আরও গুণীজন সম্মাননায় ভূষিত হয়েছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের বিখ্যাত চারণ সাংবাদিক এবং বিক্রমপুরের কৃতিসন্তান হিসেবে ২০০০ সালে ভারতের কলকাতায় বিক্রমপুর সম্মেলনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা প্রদান করেন সফিউদ্দিন আহমদ।
দেশের এই সংগ্রামী কৃতি সন্তান ও মফস্বল সাংবাদিকতার পথিকৃৎ গ্রামীণ সাংবাদিক ও ভাষা সৈনিক সফিউদ্দিন আহমদ ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর রাতে মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানের পারিবারিক কবরে তাকে সমাহিত করা হয়।
আজীবন সংগ্রামী, আপোষহীন ছাত্রনেতা, ভাষা সৈনিক ও চারণ সাংবাদিক সফিউদ্দিন আহমদ তার ত্যাগ ও আদর্শের জন্য অমর হয়ে থাকবেন।