১৬ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
রবিবার | সকাল ১১:৩৮
মুন্সিগঞ্জে প্রতিবছর আলু চাষ কমছে
খবরটি শেয়ার করুন:

মুন্সিগঞ্জ, ৩ এপ্রিল ২০২৩, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)

টানা লোকসানে মুন্সিগঞ্জে আলু আবাদে কৃষকের আগ্রহ কমেছে। চলতি বছর জেলায় কমেছে আলু আবাদি ফসলি জমির পরিমাণ। এতে এবছরও জেলায় আলু উৎপাদন কম হয়েছে।

পরিসংখ্যান বলছে, গেল পাঁচ বছরে জেলায় ধারাবাহিকভাবে আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ও উৎপাদন কমেছে। অন্যদিকে চলতি বছর তেল ও বিদ্যুৎয়ের দাম বাড়ায় আলু উৎপাদন-পরিবহন ও সংরক্ষণে কৃষকের খরচ বেড়েছে। কৃষি অফিসের সাথে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিস জানায়, আলু উৎপাদনে শীর্ষ জেলা মুন্সিগঞ্জে প্রতিবছর গড়ে প্রায় সাড়ে ১০ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হয়। যেখানে জেলার ৬৮টি কোল্ডষ্টোরেজের ধারণক্ষমতা প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মেট্রিক টন সেখানে উৎপাদিত বাকি আলু নিয়ে প্রতিবছরই কৃষকের হিমশিম খেতে হয়। আবার কোল্ডষ্টোরেজে সংরক্ষণে খরচ বাড়ায় কম লাভে ক্ষেতে থেকেই আলু বিক্রি করে দেন তারা। এতে লোকসানে পড়েন তারা।

জেলায় এবছর ৩৫ হাজার ৭৯৬ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আবাদ হয়েছে ৩৪ হাজার ৩৪৬ হেক্টর জমিতে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ হাজার ৪৫০ হেক্টর কম জমিতে আলুর আবাদ হলেও বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে কৃষি অফিস।

 

তারা বলছে, যেহেতু কৃষক প্রতিবছরই বলছে আলুতে তাদের লোকসান হচ্ছে তাই তাদের বিকল্প হিসেবে ভুট্টা ও সরিষা চাষের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এবছর তারা সেটি শুনেছেন। তাছাড়া বিদেশে রপ্তানিযোগ্য আলুর জাত চাষে কৃষকের মাঝে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।

চলছে আলু উত্তোলনের মহোৎসব। এই কাজে পুরুষের পাশাপাশি সমানতালে কাজ করছেন নারী শ্রমিকরা। সম্প্রতি সিরাজদিখান উপজেলার কাকালদি এলাকায়। ছবি: আমার বিক্রমপুর।

জেলা কৃষি অফিস জানায়, জেলার ৬টি উপজেলাতে এবছর ৩৪ হাজার ৩৪৬ হেক্টর জমিতে আলুর আবাদ করেছে কৃষক। এর মধ্যে সদর, টংগিবাড়ী ও সিরাজদিখানে বেশি চাষ হয়েছে। বর্তমানে জেলাজুড়ে চলছে আলু উত্তোলনের মহোৎসব।

কৃষকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তেলের দাম বাড়ায় গত বছরের তুলনায় আলু পরিবহনে কৃষকের দেড়গুন খরচ বেড়েছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎয়ের দাম বাড়ায় বস্তাপ্রতি কোল্ডষ্টোরেজ ভাড়াও বেড়েছে ২০-৩০টাকা।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ক্ষেত থেকে আলু তুলে বস্তাবন্দি করে নেয়া হচ্ছে জেলার বিভিন্ন কোল্ডস্টোরেজে। আলু ক্ষেতে ব্যস্ত সময় পার করছেন আলু চাষী ও শ্রমিকরা। ক্ষেত থেকে ৫০ কেজি ওজনের প্রতি বস্তা আলু কৃষক পাইকারদের কাছে বিক্রি করছেন ৬০০ টাকা দরে।

অন্যদিকে, কোল্ডষ্টোরেজে প্রতি বস্তা আলু সংরক্ষণে কৃষকের ব্যায় হচ্ছে ২৪০-২৬০ টাকা।

বাজার ঘুরে খুচরা বিক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি কেজি আলু খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৩-২৫ টাকায়। অর্থাৎ প্রতি বস্তা বিক্রি হচ্ছে ১২৫০ টাকায়।

মুন্সিগঞ্জ শহর বাজারের খুচরা সবজি বিক্রেতা মো. রাহাত জানান, প্রতি বস্তা আলু তারা পাইকারদের কাছ থেকে ১ হাজার টাকায় কেনেন। কেজিতে পরে ২০ টাকা। কৃষকের কাছ থেকে কিনলে আরও কম দামে কেনা যায়। এরপর খুচরা পর্যায়ে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয় ২৪-২৫ টাকায়।

আরেক বিক্রেতা স্বপন জানান, ২০টাকা কেজি দরে পাইকারদের কাছ থেকে আলু কিনে আনেন তারা। খুচরা ক্রেতাদের কাছে প্রতি কেজি আলু বিক্রি করেন ২৩-২৪ টাকা দরে।

টংগিবাড়ী উপজেলার হাসাইল এলাকার কৃষক মুজিব বেপারি জানান, গতবছরের তুলনায় এবছর ক্ষেত থেকে কোল্ড স্টোরেজে আলু পরিবহনের খরচ দেড়গুন বেড়েছে। দেশে জ্বালানী তেলের দাম বাড়ায় বাড়তি খরচ বহন করতে হচ্ছে। এছাড়া গতবছর যেখানে প্রতিবস্তা আলু কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষণে ব্যায় হতো ২১০ টাকা এবছর বিদ্যুৎয়ের দাম বাড়ায় কোল্ডষ্টোরেজ মালিকরা প্রতি বস্তায় ২৬০টাকা রেট নির্ধারণ করেছে। এতে অনেক কৃষক কোল্ডস্টোরেজে আলু না দিয়ে ক্ষেত থেকেই কম লাভে বিক্রি করে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, গেল বছরের তুলনায় এবার আলুর দাম ভালো যাচ্ছে বাজারে। এতে লাভবান হচ্ছেন কৃষক।

আবির এগ্রো কোল্ড স্টোরেজের স্বত্বাধিকারি মোশাররফ হোসেন জানান, বিদ্যুৎয়ের দাম বাড়ায় লোকসান এড়াতে বাংলাদেশ কোল্ড ষ্টোরেজ এসোসিয়েশন থেকে প্রতি বস্তা আলু সংরক্ষণে ২৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু ২৩০-২৪০ টাকার বেশি কৃষকরা দিতে চাচ্ছেননা। এতে কোল্ড স্টোরেজগুলি লোকসানে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

মুন্সিগঞ্জ সদরের মোল্লাকান্দি এলাকার আলুচাষী বাদল বেপারি বলেন, ৪০ লাখ টাকা ব্যায়ে এবছর ২০ কানি জমিতে আলু আবাদ করেছি। গতবছরও লোকসান হয়েছে। এরপরও এবছর লাভের আশায় আলুচাষ করেছি। ক্ষেত থেকে আলু সব তুলে কোল্ডষ্টোরেজে রেখেছি। দাম আরও বাড়লে বিক্রি করবো। তিনি বলেন, আলুর পাশাপাশি জমির আইলে সামান্য পরিমাণ সরিষার আবাদ করেছি। ভালো দামে বিক্রি হলে সামনের বছর আলুর আবাদ কমিয়ে সরিষা করবো।

সিরাজদিখানের মধ্যপাড়া ইউনিয়নের কাকালদি গ্রামের কৃষক আহমদ খান বলেন, এ বছর আমি ৪০ শতাংশ জমিতে আলুর আবাদ করেছি। বাকি ২০ শতাংশ জমিতে স্থানীয় কৃষি অফিসের পরামর্শে সরিষা চাষ করেছি। তিনি বলেন, আমার মত এই এলাকার অনেক কৃষক আলুর আবাদ কমিয়ে বিকল্প সবজি চাষ করেছে।

আলুক্ষেতের শ্রমিক বিল্লাল মোল্লা বলেন, এবছর একেবারেই বৃষ্টি হয়নি। আবার খাল-বিল শুকনা থাকায় আলু ক্ষেতের আশপাশে চাহিদা মোতাবেক যথেষ্ট পানিও পাওয়া যায়নি। এতে আলু গাছে সকাল-বিকাল পানি দিতে কৃষকের খরচ বেশি হয়েছে। আবার সার-কীটনাশকের দামও বেশি ছিলো। সবমিলিয়ে খরচ বেশিই হয়েছে। তবে বর্তমানে বাজারে আলুর চাহিদা থাকায় দাম ভালো পাওয়া যাচ্ছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. আব্দুল আজিজ আমার বিক্রমপুরকে জানান, ইতিমধ্যে ক্ষেত থেকে ৮০ শতাংশের উপরে আলু তুলে নিয়েছে কৃষক। বাকিটাও কয়েকদিনের মধ্যে তুলে নিবে। এবছর আমাদের হেক্টর প্রতি ফলনের টার্গেট ছিলো ৩০.৬৪ মেট্রিক টন। গড় ফলন পাওয়া গেছে ২৭ মেট্রিক টন করে। কারণ হলো- আগাম জাতের আলু তারাতারি তুলে নেয়ায় ফলন কম হয়েছে। চলতি দফায় যে আলু উঠছে সেগুলোর ফলন ভালো।

তিনি বলেন, সার্বিকভাবে যদিও আবাদ কম হয়েছে কিন্তু কৃষক লোকসানে পড়েনি। যেহেতু কৃষকও বলছে, আলুতে তাদের প্রতিবার লোকসান হচ্ছে তাই তাদের আলুর বিকল্প সরিষা, ভুট্টা ও শাকসবজি চাষ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। কৃষককে বুঝিয়েছি, মুন্সিগঞ্জ আলুর রাজধানী হলেও লোকসান দিয়ে তো আর ব্যবসা করা যাবে না। আলু আবাদ কমে আসছে এটি অবশ্যই ইতিবাচক।

রপ্তানি ও প্রক্রিয়াজাত উপযোগী আলুর জাত ছাড়করণ ও কৃষক পর্যায়ে জনপ্রিয় করার বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা বলেন, জেলায় বেশি চাষ হওয়া আলুর জাতের মধ্যে একটি হচ্ছে ডায়মন্ড। এছাড়াও অরিকো, মালতা ও পেরটোনাইস জাতের আলু বেশি চাষ হয় এখানে। অন্যদিকে বিদেশে রপ্তানিযোগ্য যে জাতগুলো রয়েছে যেমন বিএডিসির সানশাইন, কুইন এনি, বারী আলু-৬২ সেগুলো সম্পর্কে আমরা কৃষককে জানাচ্ছি। উৎপাদন প্রক্রিয়া সেখানোর চেষ্টা করছি। এই জাতগুলোর উৎপাদন বাড়ানো গেলে আলুচাষীরা বেশি লাভবান হবে অন্যদিকে বিদেশে আলু রপ্তানি অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখবে।

 

error: দুঃখিত!