মুন্সিগঞ্জ, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)
মুন্সিগঞ্জ জেলা সদর থেকে রাজধানী ঢাকার গুলিস্তানের দূরত্ব ২৬ কিলোমিটার। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এই পথ পারি দিতে দেড় ঘন্টার বেশি সময় লাগার কথা নয়। কিন্তু স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও উন্নত সড়ক ব্যবস্থা গড়ে না উঠায় এই পথ পারি দিতে ২-৩ ঘন্টা সময় লাগে যাত্রী-যানবাহনের।
একসময় এই পথে ৩-৪টি বাস সার্ভিস চালু থাকলেও এখন কোনরকমে টিকে আছে মাত্র একটি। দফায় দফায় জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধি ও বিভিন্ন কারণে ভাড়াও বেড়েছে বহুগুণ।
মাঝে মুন্সিগঞ্জ-সদরঘাট নৌ পথে যাত্রীরা ঢাকায় যাতায়াত করলেও কয়েক দফা লঞ্চডুবিতে প্রাণহানির পর নৌ পথ বিমুখ হয়ে পড়েছেন যাত্রীরা।
সড়কপথে সরাসরি মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকায় যাতায়াতের আর কোন ব্যবস্থা না থাকায় বর্তমানে বাধ্য হয়ে সিএনজি-লেগুনা ব্যবহার করে পার্শ্ববর্তি নারায়ণগঞ্জ দিয়ে কয়েক দফায় যানবাহন পাল্টে অতিরিক্ত ভাড়া ও সময় ব্যায় করে ঢাকায় যাতায়াত করতে হচ্ছে মুন্সিগঞ্জের সদর ও টংগিবাড়ী উপজেলার পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ। যাত্রী ভোগান্তি কমাতে মাঝে ৩ দফায় ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ পথে বিআরটিসির শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ও উন্নত বাস সার্ভিস চালু হলেও সরু সড়ক-যানজটের কবলে প্রতিবারই কয়েকদিন পেরোতেই তা বন্ধ হয়ে গেছে।
এসব দুর্ভোগ লাঘবে ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর একনেকে ২ হাজার ২৪২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যায়ে পঞ্চবটি-মুক্তারপুর সড়ক প্রশস্তকরণ ও দোতলা রাস্তা নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। কিন্তু প্রকল্প মেয়াদের ৩৪ মাস পেরিয়ে গেলেও সার্বিক কাজের অগ্রগতি মাত্র পাঁচ শতাংশ।
এদিকে নাগরিক ও সূশীল সমাজের ব্যক্তিরা বলছেন, সড়ক পথের পাশাপাশি ঢাকার সাথে মুন্সিগঞ্জের রেল যোগাযোগ স্থাপন করা গেলে মুন্সিগঞ্জ-ঢাকা যাতায়াতে যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে।
বাংলাদেশ সেতু কতৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ পথে যাতায়াতের সুবিধার্থে ২০০৮ সালে মুক্তারপুর সেতু নির্মাণ করে দেয় সেতু কতৃপক্ষ। এর মাধ্যমে ঢাকার সাথে মুন্সিগঞ্জের সরাসরি সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থাপন হয়। পাশাপাশি মুক্তারপুর সেতু থেকে নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটি পর্যন্ত সড়কটি সংযোগ সড়ক হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। কিন্তু মুক্তারপুর সেতু থেকে নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটি পর্যন্ত প্রায় ১১ কিলোমিটার সড়কটি ক্রমেই সরু হয়ে যাওয়ার কারণে দুর্ভোগ দিনের পর দিন আরও বেড়েছে।
একসময় এই পথের প্রশস্ত ৮০ থেকে ১২০ ফুট হলেও এখন তা ২০ ফুটে ঠেকেছে। ফলে যাত্রী-যানবাহন ও স্থানীয় বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের পণ্যবাহী যানবাহন ও শ্রমিকদের চলাচলের কারনে এই পথে যানজট নিত্যদিনের চিত্র।
ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ পথের এই অংশের ভোগান্তি নিরসণ, পার্শ্ববর্তী নারায়ণগঞ্জসহ অন্যান্য জেলার সাথে নিরবচ্ছিন্ন, সহজতর ও ব্যায় সাশ্রয়ী সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর একনেকে ২ হাজার ২৪২ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ব্যায়ে পঞ্চবটি-মুক্তারপুর সড়ক প্রশস্তকরণ ও দোতলা রাস্তা নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদিত হয়। ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি শুরু হয়ে যা ২০২৫ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু গতকাল (শনিবার) পর্যন্ত বাস্তবে এই কাজের অগ্রগতি মাত্র পাঁচ শতাংশ।
ফলে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা নিয়ে সন্দিহান প্রকল্প পরিচালকও।
সেতু কতৃপক্ষ ও প্রকল্প পরিচালকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মুক্তারপুর হতে পঞ্চবটি পর্যন্ত সংকীর্ণ এই সড়কের গড় প্রশস্ততা ৫.৫ মিটার। এই পথটি আঁকাবাঁকা ও রাস্তার উভয় পাশে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, বসত-বাড়ি, দোকানপাট ইত্যাদি থাকায় যানবাহন চলাচলে প্রায়ই দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। এছাড়া মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুরে ৫ টি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি এবং আলু সংরক্ষণের জন্য বেশ কয়েকটি কোল্ড স্টোরেজ থাকায় ২৪ টন হতে প্রায় ৫০ টন পর্যন্ত ওজনের ভারী যানবাহন চলাচল করায় প্রায়শঃই যানবাহনগুলোকে দূর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হয় এবং এর ফলে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়।
এছাড়া নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা এলাকাটি বিসিক শিল্পাঞ্চল-এর অন্তর্ভূক্ত এবং এ এলাকায় কয়েক শতাধিক গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী থাকায় প্রতিদিন লক্ষাধিক শ্রমিক তিনবেলা রাস্তাটি ব্যবহার করে। ফলে রাস্তায় যানজটের সৃষ্টি হয়। তাছাড়া এ এলাকায় বেশ কয়েকটি রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে যার উৎপাদিত পণ্য পরিবহনের জন্যও রাস্তাটি ব্যবহার করা হয়।
সেতু কতৃপক্ষ সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পের আওতায় মুন্সিগঞ্জ সীমানায় ২.২৭ একর জমি অধিগ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে ২ দশমিক ২৫ একর জমি সকল প্রক্রিয়া শেষে মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসন সেতু কতৃপক্ষকে ইতিমধ্যে বুঝিয়ে দিয়েছে। বাকি ০ দশমিক ২ একর জমি তিতাস গ্যাস কতৃপক্ষ আন্ত:মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে খুব শীঘ্রই হস্তান্তর করবে। অন্যদিকে, নারায়ণগঞ্জ সীমানায় ৩১ দশমিক ৬৯২৫ একর জমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম সম্প্রতি শেষ হয়েছে।
প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ও নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করা যাবে কি না জানতে চাইলে পঞ্চবটি-মুক্তারপুর সড়ক প্রশস্তকরণ ও দোতলা রাস্তা নির্মাণ প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রকল্পের বাস্তবিক ভৌত অগ্রগতি ৫ শতাংশ। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কাজ উদ্বোধনের চেষ্টা চলছে। প্রধানমন্ত্রী সময় দিলেই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্পের কাজ পুরোদমে শুরু করা যাবে। স্থানীয় সংসদ সদস্যদের সাথেও আলোচনা হয়েছে। আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি পঞ্চবটিতে একটা কর্মসূচি আয়োজনের। সেখানে একটি জনসভা হতে পারে। খুব শিঘ্রই সময়টা জানা যাবে।’
তিনি বলেন, প্রকল্পের যে নির্ধারিত মেয়াদ অর্থাৎ ২০২৫ সালের জুনের মধ্যে কাজ হয়তো শেষ করতে পারবো না। তবে, আশা করি আরও ৬-৭ মাস বেশি হলে কাজ শেষ হয়ে যাবে।’
মুন্সিগঞ্জ জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক আরিফ উল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও জেলা সদর-টংগিবাড়ীর সাথে রাজধানী ঢাকার উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। এটি আমাদের জন্য লজ্জার। সড়ক পথ ভালো না থাকায় মাঝে নৌপথে ঝুঁকেছিলো যাত্রীরা। কিন্তু কয়েক দফায় মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকা নারায়ণগঞ্জগামী লঞ্চডুবির ঘটনার পর ভয়ে আতঙ্কে সেখান থেকেও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন যাত্রীরা। এখন মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকায় যাতায়াত করতে হচ্ছে ভেঙ্গে ভেঙ্গে। এতে খরচও যেমন বাড়তি হচ্ছে আবার সময়ও ব্যায় হচ্ছে কয়েকগুণ। দ্রুত সময়ে পঞ্চবটি-মুক্তারপুর সড়ক প্রশস্তকরণ ও দোতলা রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা উচিৎ। পাশাপাশি মুন্সিগঞ্জ সদর থেকে নারায়ণগঞ্জের সাথে রেল লিংক তৈরি করা গেলে ঢাকা মুন্সিগঞ্জ যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আসবে।
মুন্সিগঞ্জ সদর থেকে ঢাকায় নিয়মিত বাতায়াতকারী ব্যবসায়ী আবুযর গিফারী রিমন বলেন, মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকায় সরাসরি পথে মুক্তারপুর-পঞ্চবটি পর্যন্ত মাত্র ১১ কিলোমিটার যেতে যানবাহনের যে সময় লাগে তার চেয়ে কম সময়ে মুক্তারপুর সেতু পার হয়ে বিকল্প পথে নারায়ণগঞ্জের কাশিপুর, গোপনগর বা ভোলাইল দিয়ে সিটি কর্পোরেশনের মহল্লার সড়ক ধরে পঞ্চবটি বা ঢাকায় পৌছানো যায়। কিন্তু এতে সময় ও অর্থ ব্যায় হয় বেশি। সিটি কর্পোরেশনের আরসিসি সড়কগুলোর প্রশস্ত একেবারেই অম্ল হওয়ায় একই সড়কে বড় কোন গাড়ি ঢুকলেই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়ে দীর্ঘ যানজট দেখা দেয়। কখনো কখনো পুরো গড়ক বন্ধ হয়ে বিকল হয়ে যায়। সরকার দেশে এত রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করছে তাহলে আমরা বঞ্চিত হবো কেন? তাছাড়া মুন্সিগঞ্জের পাশের জেলা নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় সরাসরি রেলের ব্যবস্থা রয়েছে। মুন্সিগঞ্জ সদর থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ করে দিলে যাত্রীরা সহজেই অল্প অর্থ ব্যায় ও কম সময়ে ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবে।
প্রসঙ্গত, পঞ্চবটি-মুক্তারপুর সড়ক প্রশস্তকরণ ও দোতলা রাস্তা নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় নারায়ণগঞ্জের পঞ্চবটি চৌরাস্তা থেকে ছয় লেনের ৩১০ মিটার দৈর্ঘ্যের একটি সড়ক ফতুল্লা-ঢাকার দিকে ও নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ার দিকে একই দৈর্ঘ্যের আরেকটি সড়ক নির্মিত হবে। পাশাপাশি পঞ্চবটি থেকে চরসৈয়দপুর এলাকায় তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু পর্যন্ত ১০ দশমিক তিন সাত কিলোমিটার পথে ৯ দশমিক শূন্য হয় কিলোমিটার দোতলা সড়ক ও পঞ্চবটি থেকে কাশিপুর পর্যন্ত ৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার বর্তমান দুই লেনের গড়কটি চার লেনে উন্নীত হবে। এবং তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু থেকে মুক্তারপুর সেতু পর্যন্ত ৩ দশমিক ৭৫ কিলোমিটারের বর্তমান দুই লেনের সড়কটি চার লেনে উন্নীত হবে। এছাড়া প্রকল্প এলাকায় ১৭ দশমিক ৬১ কিলোমিটার ড্রেন ও ৪টি টোলপ্লাজা নির্মাণ করা হবে। এটি হবে ফরিদপুরের ভাঙ্গা এবং সিরাজগঞ্জের পর তৃতীয় ইন্টারসেকশন সম্বলিত দৃষ্টিনন্দন সড়ক। ২০২৫ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ হলে যানবাহনের গতি বাড়বে প্রায় ৫ গুণ।