মুন্সিগঞ্জ, ১৭ জুন ২০২৩, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)
মুন্সিগঞ্জ জেলা সদরে প্রবেশের একমাত্র প্রবেশপথ মুক্তারপুর সেতু (ষষ্ঠ বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু)। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ হয়ে এই পথ দিয়েই প্রতিদিন জেলায় ঢোকেন লক্ষাধিক সাধারণ মানুষসহ জেলার শীর্ষ পুলিশ-প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকতাসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা।
২০০৮ সালে মুক্তারপুর সেতু উদ্বোধনের পর পেরিয়ে গেছে ১৫ বছর। এরপরও কোন শৃঙ্খলায় আসেনি সেতু এলাকা। বছরের পর বছর ধরে এই সামান্য জায়গাটুকোতে শৃঙ্খলা আনতে পারছেনা কেউই। আসলেই পারছেনা নাকি সদিচ্ছা নেই নাকি এখানে অন্য কোন স্বার্থ জড়িত তা নিয়ে আলোচনা রয়েছে সাধারণ মানুষের মাঝে।
জেলা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় প্রতিটি সভায় এ নিয়ে আলোচনা হয়। অভিযোগ তুলে ধরা হয় জেলা পুলিশ-প্রশাসনের কাছে। অভিযোগ শুনে প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তৎক্ষণাৎ বিভিন্ন দিকনির্দেশনাও দেন। কিন্তু পরদিনই যেন সেসসব নির্দেশনা ভুলে যান সবাই।
জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির একাধিক সদস্য জানান, প্রতি সভাতেই মুক্তারপুর সেতু এলাকায় যানবাহনের যত্রতত্র পার্কিং, অবৈধ স্ট্যান্ড, চাঁদাবাজি, ট্রাফিক পুলিশের সক্রিয়তা এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। পুলিশ সুপার, জেলা প্রশাসক সবার প্রতিই বারবার অনুরোধ করা হয় সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে তারা যেন উদ্যোগ নেন। কিন্তু সবাই যেন জেনেও জানেননা। দেখেও দেখেন না।
সম্প্রতি সেতু এলাকা ঘুরে দেখা যায়, মুক্তারপুর সেতু হয়ে মুন্সিগঞ্জে ঢুকতেই নারায়ণগঞ্জগামী অটো-মিশুক চালকদের বিশাল জটলা। যে যেভাবে ইচ্ছা সেতুর প্রবেশমুখে অটো-মিশুক রেখে যাত্রী উঠাচ্ছেন। ফলে দ্রুতগামী ভাড়ি যেসকল যানবাহন সেতু পার হয়ে জেলায় ঢুকছে সেগুলোকে বেগ পেতে হচ্ছে। প্রায়ই যানজট তৈরি হয়ে ভোগান্তি হচ্ছে।
সেতু থেকে নেমে স্পিডব্রেকার পার হলেই ডানদিকের সড়কটি চলে গেছে দয়ালবাজার-বিনোদপুরের দিকে আর বামদিকের সড়কটি গিয়ে মিশেছে মুক্তারপুর-মুন্সিগঞ্জ সড়কে। কিন্তু উভয়পাশেই অটো-মিশুক, সিএনজি এমনভাবেই দাড়িয়ে থাকছে ফলে সেতু থেকে নেমে যানবাহনগুলো নির্বিঘ্নে যেতে পারছে না। এত গেল সামান্য চিত্র। এর কয়েক হাত সামনে এগোলেই ডানে লেগুনা আর সিএনজির লম্বা জটলা আর বামে সারি সারি দাড় করানো সিএনজি। এই জটলা সেতু এলাকা পেরিয়ে চলে গেছে পেট্টোলপাম্প পর্যন্ত। দেখলে মনে হবে- কোথাও যেন কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। এই সড়কটি বা সেতুটি বানানোই হয়েছে বিশৃঙ্খলা তৈরিকারী যানবাহনগুলোর জন্য।
অথচ মুক্তারপুর সেতু এলাকায় সুষ্ঠুভাবে যানবাহন চলাচল করার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখা, ট্রাফিক আইন ঠিকভাবে পালন করা হচ্ছে কি না খেয়াল রাখা, যানজট নিরসন করাসহ ইত্যাদি কাজের জন্য সেতু এলাকায় কনস্টেবল কোবাদ আলী ট্রাফিক পুলিশ বক্স ও ট্রাফিক পুলিশের একাধিক সদস্য নিয়মিত ডিউটিরত থাকলেও তাদের কর্মকান্ড নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে সাধারণ মানুষের।
যাত্রী সাধারণের অভিযোগ, ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন না। তাদের নাকের ডগায়ই চলছে সকল নৈরাজ্য। এই এলাকার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ বা যত্রতত্র পার্কিংরোধের চেয়ে মোটরসাইকেল/অটো আটকে তাদের সাথে বাকবিতন্ডায় জড়ানোই যেন তাদের বেশি পছন্দ। প্রায় প্রতিদিনই দেখা মেলে এমন চিত্রের।
এসব বিষয়ে মুন্সিগঞ্জ ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক (প্রশাসন) বজলুর রহমান বলেন, মুক্তারপুর সেতু এলাকায় শৃঙ্খলা রক্ষায় আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা রয়েছে। সেখানে যারা দায়িত্ব পালন করেন তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। এরপরও যদি কারও বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ পাওয়া যায় তার বিরুদ্ধে প্রমাণ সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
চাঁদাবাজির ভাগ পায় কারা?
মুক্তারপুর সেতু এলাকা থেকে গড়ে প্রতিদিন ৪০০ সিএনজি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ/লৌহজংসহ বিভিন্ন এলাকায় যাত্রী আসা-নেওয়া করে। সরকার এই এলাকায় কোন বৈধ স্ট্যান্ড ইজারা দিয়েছে কি না তা জানা নেই খোদ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার। আমার বিক্রমপুর অনুসন্ধান করে এই এলাকায় কোন বৈধ স্ট্যান্ড রয়েছে বলে তথ্য পায়নি। কিন্তু সেতু এলাকায় স্ট্যান্ডের নামে প্রতিমাসে লাখ টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে প্রকাশ্যে। এখানকার প্রতিটি সিএনজি চালকরাই দিলেন এমন তথ্য।
সেতু এলাকায় সিএনজি চালকদের সাথে কথা বলার সময় মো. কবির নামের এক ব্যক্তি অকোপটে স্বীকারও করেন চাঁদাবাজির কথা। জানান, ৪০০-৫০০ টাকা রোজে কাজ করেন। বিনিময়ে প্রতিদিন সিএনজি থেকে ২০ টাকা ও অটো-মিশুক থেকে ১০ টাকা করে তোলেন। টাকাগুলো বুঝিয়ে দেন মুক্তারপুরের কথিত শ্রমিক লীগ নেতা আব্দুল মালেকের হাতে।
এই টাকার ভাগ কারা কারা পায় এমন প্রশ্ন করলে এড়িয়ে যান কবির। বলেন, ‘বোঝেনই তো বড় বড় ব্যাপার’। চাঁদা উত্তোলনকারী কবির যেখানে দাড়িয়ে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা বলছিলেন সেটি নারায়ণগঞ্জগামী সিএনজির সিরিয়াল এলাকা।
সিএনজিচালক মোস্তাক আহম্মেদ জানান, ‘কোন গাড়ি কখন যাবে, আবার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের গাড়ি আগে-পড়ে ছাড়া এসবই নিয়ন্ত্রণ করেন শ্রমিক লীগ নেতা আব্দুল মালেক।’
মোস্তাক বলেন, ‘৩৩ বছর ধরে সিএনজি চালাই। ১৪ বছর ধরে আছি মুক্তারপুর এলাকায়। প্রতিদিন এখান থেকে ৩০০-৪০০ সিএনজি যাত্রী আসা-নেওয়া করে। মুক্তারপুর স্ট্যান্ডে প্রতিদিন দিতে হয় ২০ টাকা আর নারায়ণগঞ্জের মন্ডলপাড়ায় প্রতিদিন দিতে হয় ৮০ টাকা।’
সরেজমিন দেখা যায়, এই সারি সারি সিএনজিগুলোর ১০ হাত সামনেই কনস্টেবল কোবাদ আলী ট্রাফিক পুলিশ বক্স। সেখানে প্রতি বেলায় নিয়ম করে বসছেন একাধিক ট্রাফিক কর্মকর্তা-সার্জেন্ট। কিন্তু কোনভাবেই কোন বিশৃঙ্খলা/প্রকাশ্য চাঁদাবাজি তাদের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে পারছে না। তারা নিজ মনে অবিরাম চলেছেন তাদের মত।
মুক্তারপুর সেতু এলাকায় প্রকাশ্যে এমন চাঁদাবাজির বিষয়ে জানতে চাইলে মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসাইন মো. আল জুনায়েদ শোনান প্রশাসনের সেই গৎ বাঁধা কথা। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
সুযোগ পেলেই বেড়ে যায় ভাড়া
মুক্তারপুর থেকে প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষ সেতু পার হয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জে যাতায়াত করেন। আবার ঢাকার সাথে সরাসরি মুন্সিগঞ্জের উন্নত/আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় বেশিরভাগ ঢাকাগামী যাত্রী সিএনজি/লেগুনাতে করে মুক্তারপুর থেকে নারায়ণগঞ্জে যাতায়াত করেন। কিন্তু কোন কোন দিন যাত্রীর চাপ বাড়লে/সড়কে যানবাহনের ধীরগতি থাকলে কিংবা দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া দেখা গেলেই হুট করে ভাড়া বাড়িয়ে দেন সিএনজি-লেগুনা ও অটো-মিশুক চালকরা। সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অহরহ অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে কোন তদারকি বা ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়না সংশ্লিষ্টদের।
এই পথে নিয়মিত যাতায়াতকারী নারায়ণগঞ্জের রণদা প্রসাদ সাহা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আল মাহমুদ মঞ্জুর বলেন, আমি প্রতি মাসে ১৫-২০ দিন এই পথে যাতায়াত করি। কোন কোন দিন আমার ফিরতে সন্ধ্যা হয়। কোনরকম সন্ধ্যা হলেই বা রাস্তায় যানজট হলেই সিএনজি চালকরা ১০-২০ টাকা ভাড়া বাড়িয়ে দেয়। কোনভাবে অনুরোধ করলেও তারা শোনেনা। যেন একটা মগের মুল্লুক- তাদের ন্যুনতম জবাবদিহিতা নেই।
একই পথে নিয়মিত যাতায়াতকারী জুবায়ের হাসান বলেন, মুন্সীগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া সামান্য পথ। এই পথটুকুও আমাদের জন্য নিরাপদ নয়। এর মধ্যে সিএনজি চালকদের কাছে আমরা জিম্মি। যখন ইচ্ছা হয় ভাড়া বাড়তি ভাড়া আদায় করে তারা।
অভিযুক্ত কথিত শ্রমিক লীগ নেতা আব্দুল মালেকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।
যাত্রীদের জিম্মি করে এভাবে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসাইন মো. আল জুনায়েদ বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। কেউ লিখিত অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
বৃষ্টি হলেই জমে থাকে পানি
মুক্তারপুর সেতুর মুন্সিগঞ্জ অংশে সামান্য বৃষ্টি হলেই পানি জমে। এতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় সিএনজি চালকসহ সাধারণ যাত্রীদের। সরেজমিন এলাকাটিতে গিয়ে দেখা যায়- রোদ উঠে পানি শুকানো পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া বৃষ্টির পানি নিস্কাশনের কোন ব্যবস্থা নেই এখানে। এতে যাতায়াতে ভোগান্তি হয় যাত্রীদের।
সিএনজিচালক আনোয়ার হোসেন জানান, সামান্য বৃষ্টি হলেই এখানে পানি জমে থাকে। পানির জন্য যাত্রীদের যানবাহনে উঠতে অসুবিধা হয়। অন্যদিকে, গাড়ির চাকা ভেজা থাকলে ব্রেকে সমস্য হয়। দ্রুত এই এলাকায় ড্রেনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।
এই পথে যাতায়াতকারী যাত্রী মনির হোসেন বলেন, মুন্সিগঞ্জে প্রবেশের প্রধানতম পথ মুক্তারপুর সেতু। অথচ এই এলাকায় কোন কিছুতেই কোন শৃঙ্খলা নেই। একদিকে যেভাবে খুশি সেভাবে গাড়ি রেখে যানজট তৈরি করা হচ্ছে। অন্যদিকে বৃষ্টি হলেই এই এলাকায় হাটা দায় হয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের উচিৎ সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া এবং এই এলাকায় ড্রেনেজ নির্মাণ করে পানি অপসারণের ব্যবস্থা করা।