২৯শে নভেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ
বুধবার | বিকাল ৩:৪৪
মাশরাফিতো আমাদেরই একজন
খবরটি শেয়ার করুন:

বাংলা সাহিত্যে মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি বলে একটা কথা আছে। আর এবারের ভরা বর্ষার মৌসুমে আমার কপালে যেন মেঘ না চাইতেই পুরো বর্ষাকাল জুটে গেল! সেটা হচ্ছে ফটোগ্রাফার হিসেবে ঈদের সময় মাশরাফির বাড়িতে একদিন থাকার সুযোগ!

না আছে নিজের একটা ক্যামেরা, না আছে ফটোগ্রাফির পূর্ব কোন অভিজ্ঞতা। তবুও অন্যের ক্যামেরা ধার করে এনে এই মৌসুমী ফটোগ্রাফার সাজার উদ্দেশ্য আর কিছু নয়, শ্রদ্ধেয় দেবব্রত মুখোপাধ্যায় এর বইয়ের জন্য কিছু ছবি তোলা। যে বইটি লেখা হচ্ছে মাশরাফি বিন মুর্তজাকে নিয়ে!

যাই হোক, ঈদের দিন নামাজ পড়ে বাসায় ফিরে বাবা-মা কে সালাম করে আর সামান্য উদরপূর্তি করেই বের হয়ে গেলাম। আমাদের অভয়নগর থেকে নড়াইল খুব একটা দূরে নয়, নৌকায় করে নদী পার হয়ে ভাড়ার মোটরসাইকেলে করে এক ঘন্টাতেই পৌঁছে গেলাম।

সেখানে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, ঈদের দিন সকালবেলাতেও তিনি নড়াইলে তার আর দশটা দিনের মতোই বসে আছেন মামাবাড়ির পাশেই ‘ইউসুফ’ মামার দোকানে। সাথে একগাদা বন্ধু-বান্ধব। মন থেকে চাইছেন নিজের মতো কিছু সময় কাটাতে। কিন্তু তার কি আর জো আছে? শুধু নড়াইল কেন, যশোর, খুলনা, মাগুরাসহ দূর দুরান্তের বিভিন্ন এলাকা থেকে মোটর সাইকেল, ইজিবাইক এমনকি ট্রাকে করেও দলে দলে লোক আসছেন মাশরাফিকে এক নজর দেখার জন্য, পাশে বসে একটা ছবি তোলার জন্য। বেচারা মাশরাফি, না পারছেন সইতে, না পারছেন কিছু কইতে!

 

অজানা অচেনা মানুষের সাথেও কাঁধে হাত রেখে বড্ড আপন মানুষের মতো ছবি তুলছেন, কারো বা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। আর নিরূপায় হয়ে বন্ধুদের সাথে রাগারাগি করছেন, অভিযোগ করছেন, নিজের নড়াইলে এসেও কেন সে আপন জগতে ডুবে গিয়ে নিজের মতো সময় কাটাতে পারবে না? একটা সময় তো বলেই উঠলেন, ‘বৃষ্টি নামলি ভাল হবেনে!’ যাতে মানুষজন বাসা থেকে কম বের হয়, আর তারও একটু কম কম ছবি তোলা লাগে, বন্ধুদের নিয়ে চুটিয়ে আড্ডা দিতে পারেন!

আড্ডা চলছে, সবার জন্য চায়ের অর্ডার হবে। আমার জন্য আনতে না করলাম। মাশরাফি বলে উঠলেন, ‘ওরে ভাই এর জন্যিও নিয়ে আয়। খায় না তো কি হইছে, আনলি ঠিকই খাবেনে!’ মুগ্ধ বিস্ময়ে আমিও আর না করতে পারলাম না! এর মাঝেই দোকানের পাশের পেয়ারা গাছ থেকে কেউ পেয়ারা পাড়া শুরু করলো। ভাল দেখে একটা পেয়ারা নিয়ে কোনরকম ধোয়া-ধুয়ির কোন বালাই না করেই সরাসরি কামড় বসালেন! এর মাঝে কাকে যেন ফোনে বলছেন, ‘নড়াইলে গাছের ডাসা পেয়ারা খাচ্ছি ভাই!’ কথাটা বলার সময় চোখে মুখে যে গভীর আত্মতৃপ্তির একটা চাপ পড়লো, মনে হলো ঐ মুহূর্তে তারচেয়ে সুখী কোন মানুষ আর দুনিয়ায় নেই!

 

আড্ডা দিতে দিতেই কোন এক বন্ধুর হাতের রিস্ট ব্যান্ডটাতে চোখ পড়লো। সেখানেও মাশরাফি! অবাক হয়ে বলে উঠলেন, ‘তুই দেখি আমার ব্যান্ড পরিছিস! এই জিনিসও আবার বের হইছে নাকি!’ যেন তার ছবি আর নামসহ কেউ ব্যান্ড বানাতে পারে, আর সেটা আবার তারই একান্ত আপন কোন বন্ধু পরে বসে থাকতে পারে, এর চেয়ে বিস্ময়কর কোন ঘটনা এর আগে আর দুনিয়াতে ঘটেনি!

আমি এক পাশে চুপচাপ বসে থাকলাম আর মাঝে মাঝে কিছু মুহুর্ত ক্যামেরাবন্দী করতে থাকলাম। আর দেবুদার সামনে মাশরাফি ও তার বন্ধুরা মেলে দিলেন গল্পের ঝাপি। সেখান থেকেই জানলাম, তাদের সীমাহীন দুরন্তপনার কথা। অল্প বয়সে খেলাধুলাই যে তাদের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান ছিল সেই কথা। সেটা শুধু ক্রিকেট নয়, এর পাশাপাশি ফুটবল, ব্যাডমিন্টন কোন খেলাই বাদ যেতো না। এবং যখন যেটা খেলতেন সেটাই খুব সিরিয়াসলি খেলতেন। যে কারণে ছোটবেলা থেকেই মাশরাফির মাঝে হার না মানা মন মানসিকতা গড়ে উঠেছে।

কোনরকম নেশার কোন বস্তু তারা ভুলেও ছুঁয়ে দেখতেন না। এলাকার ছোট ভাইরা যদি কখনো ভুল পথে পা বাড়ায়, সবার আগে তাদেরকে মাশরাফির শাসনের সামনে পড়তে হয়। সেখানেও এই বন্ধুরাই তার সঙ্গী। আড্ডার মাঝেই তার হঠাৎ মনে পড়লো এলাকার বড় মসজিদটার উন্নয়নকাজে টাকা তুলতে হবে। সাথে সাথে দোকান থেকে কাগজ আর কলম নিয়ে লিস্ট করতে বসে গেলেন। একে একে লেখা হতে থাকলো বন্ধুদের নাম, কে কে টাকা দেবে, কতো টাকা দেবে সেইসব।

এর মাঝেই আবার তার বড় মেয়ে হুমায়রা এসে ঘুরাঘুরি করছে। তার দিকেও রাখছেন কড়া নজর। গল্পের মাঝেই বলছিলেন, ছোট ছেলেটা এখনো ঐভাবে তাকে চেনেনা। কিন্তু বড়ো মেয়েটা তার জন্য পাগল, তাকে ছাড়া ঘুমায় না। যতো রাতই হোক, সে বাবার জন্য জেগে থাকবে। শুধু যখন সিরিজ চলাকালে হোটেলে থাকা লাগবে তখন সে মেনে নেবে। যদিও বিদায় দেওয়ার আগে বাবাকে আটকানোর অসহায় আকুতি থেকে বলে উঠবে, ‘হোটেল এ না গেলে চাচ্চুরা কি তোমাকে মারবে?’

মাশরাফির বাড়ি, তার মামার বাড়ি, তার বন্ধুদের আড্ডা সব কিছু ঘুরে একটা জিনিসই মনে হয়। আমরা যে মাশরাফির কথা জানি, জাতীয় দলের অধিনায়ক, বিশ্ব ক্রিকেটেরই মহাতারকা, সেই মাশরাফি আর এই মাশরাফি যেন কোনভাবেই এক নয়। এই মাশরাফি বড্ড সাধারণ একজন মানুষ, আপনার আমার মতোই। বন্ধুদের সাথে একটুখানি আড্ডা দেওয়া, সুখ-দু_খের গল্প করা, ছেলে-মেয়েকে একটু আদর করা এসবই যেন তার জীবনের সবচেয়ে বড় সুখ। বাবা-মা কে ছেড়ে ঢাকায় থাকতে যেমন তার কষ্ট হয়, নিজের স্ত্রী-সন্তানদের ছেড়ে হোটেলে কিংবা দেশের বাইরে থাকতেও তার বড্ড বেশি পরাণ পোড়ে। তবুও তিনি থাকেন, তবুও তিনি ক্রিকেট মাঠে লড়াই করেন। কারণটা আর কিছু নয়, কারণটা ‘বাংলাদেশ।‘

এই অতি সাধারণ মাশরাফির বিশ্ব কাপানো ক্রিকেটার হওয়া, একের পর পর ইনজুরিতে পড়েও বার বার ফিরে আসাকে আমরা এরই মাঝে মিরাকল হিসেবে মেনে নিয়েছি। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না, মাশরাফির জীবনে এর চেয়েও বড় মিরাকল আছে। যেই ঘটনার কোন ব্যাখ্যা নেই, নেই রহস্যের কোন কিনারা নেই। সেই রহস্যের কথা লেখার অনুমতি আমার এই লেখায় নেই। সেসব জানতে হলে অপেক্ষা করতে হবে আরো বেশ কিছুদিন।

মাশরাফির জীবনের চমকপ্রদ ও অতি সাধারণ সব ঘটনা নিয়েই দেবুদা তার বইটি সাজাচ্ছেন, নাম দিতে চান ‘আগুন পাখির ডানা।’ সেই বইয়ে লেখা হবে এমন অনেক কিছুই নিজের কানে শুনে, নিজের চোখে দেখে আমার উপলব্ধি, অতি সাধারণ বলেই তিনি এতো বেশি অসাধারণ।
মাশরাফি মানেই তাই বিস্ময়, মাশরাফি মানেই এক রাশ মুগ্ধতা!

error: দুঃখিত!