হাজারো ভক্তের দেবী মনসার প্রতি বিনয়াবনত শ্রদ্ধা, শংখ, উলুধ্বনির মধ্য দিয়ে ও মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে আজ মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হবে মধ্যযুগের মনসা মঙ্গল কাব্য গ্রন্থের রচয়িতা, বাংলা সাহিত্যের অমর কবি বিজয় গুপ্তর প্রতিষ্ঠিত প্রায় সাড়ে ৫শ’ বছরের পুরনো মনসা মন্দিরের বাৎসরিক পুজো।
পুজো উপলক্ষে ইতোমধ্যে সাধু, সন্যাসী, দেশ-বিদেশের ভক্ত হাজারো নারী-পুরুষের উপস্থিতিতে সরগরম হয়ে উঠেছে মন্দির প্রাঙ্গণ। মন্দিরের পার্শ¦বর্তী এলাকায় বসেছে একদিনের মেলা। বাৎসরিক পুজো উপলক্ষে মনসা মঙ্গল উপজীব্য করে চার দিনব্যাপী রয়ানি পালাগান শেষ হয়েছে ১৬ আগস্ট। মনসা মঙ্গল থেকে কাহিনী চয়ন করে শিল্পীরা নৃত্য গীতের মধ্য দিয়ে করুণ রস ফুটিয়ে তোলেন। যুগ যুগান্তর থেকে রয়ানি গানের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের মানুষ মনসার তুষ্টি লাভের চেষ্টা করেন। আজ বাৎসরিক পুজো উপলক্ষে সকালে পুজো অর্চনা শুরু হয়ে পর্যায়ক্রমে চলবে ভোগরাগ, বলিদান ও ভোগের প্রসাদ বিতরণ। জানা গেছে, বরিশালের বর্তমান আগৈলঝাড়া উপজেলা তৎকালীন গৌরনদী মহাকুমার গৈলা গ্রামে ইংরেজী ১৪৫০ সালে বিজয় গুপ্ত জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম সনাতন গুপ্ত ও মায়ের নাম রুক্সিনী দেবী। বিজয় গুপ্ত ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। ৪৪ বছর বয়সে তিনি বিষহরি দেবী মনসা কর্তৃক স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে ফুল্লশ্রী গ্রামের মনসা কুন্ড নামে খ্যাত বর্তমান মন্দিরের পার্শ¦বর্তী দিঘী থেকে স্বপ্নে প্রাপ্ত ঘট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মন্দিরে। এরপর তিনি দেবী পদ্মা বা দেবী মনসা কর্তৃক পুনরায় স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে দিঘীর পার্শ্ববর্তী বকুল গাছের নিচে বসে নবাব হোসেন শাহর শাসনামলে (১৪৯৪ সালে) পদ্মপুরাণ বা মনসা মঙ্গল কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন, যা পরবর্তীতে বাঙলা সাহিত্যের অমরগ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। মনসা মঙ্গল কাব্যগ্রন্থ রচনা করায় কবি বিজয় গুপ্ত ‘মহাকবি’ উপাধি লাভ করেছিলেন। কিছুকাল তিনি স্ব-দলবলে মনসা মঙ্গল গানও করেছেন। এরপর তিনি তীর্থ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে কাশীধাম গমন করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাক সেনারা বিজয় গুপ্তের প্রতিষ্ঠিত মনসা মন্দিরে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। রেখে যায় মন্দিরে তার প্রতিষ্ঠিত ঘট। স্বাধীনতার পর থেকে ওই ঘটেই চলে আসছে নিত্যদিনের পুজো অর্চনা। জনশ্রুতি রয়েছে, দেবী পদ্মা বা মনসা বিজয় গুপ্তের কাব্য রচনায় সন্তুষ্ট হয়ে আশির্বাদ হিসেবে বিজয় গুপ্তকে স্বপ্নে হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘তুই নাম চাস, না কাজ চাস?’ উত্তরে বিজয় গুপ্ত বলেছিলেন ‘আমি নাম চাই’। যে কারণে তার নাম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়লেও তিনি দেহত্যাগ করেছেন উত্তরাধিকারবিহীন। বিজয় গুপ্তর জন্মতারিখ গবেষণার প্রাপ্ত তথ্যে নির্ণয় করা হলেও মৃত্যুকাল সম্পর্কে সঠিক কোন দিন তারিখ জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে সম্ভবত ৭০ বছর বয়সে ১৫২০ খ্রিস্টাব্দে কাশীধামে তিনি দেহত্যাগ করেছেন। বর্তমানে মনসা মন্দিরটি ধর্মীয় উপাসনালয়ের পাশাপাশি আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। বরিশাল জেলা প্রশাসন জেলার দ্রষ্টব্য স্থানের তালিকার শীর্ষে রেখেছে বিজয় গুপ্তের মনসা মন্দিরের নাম। দেশ-বিদেশের পুণ্যার্থী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের পর্যটনের উল্লেখযোগ্য স্থান হিসেবে রয়েছে এ মন্দিরের স্বীকৃতি।