কলকাতার ড্যান্সবারের চিত্রটা কেমন? কলকাতার একটি পত্রিকায় প্রকাশিত কলকাতার ড্যান্সবারগুলোর ভেতরের চিত্র নিয়ে স্থানীয় একটি অনলাইন পোর্টালে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সেই প্রতিবেদন পাঠকদের উদ্দেশে-
‘নেশা ধরানো মায়াবী আলো৷ আলোর ঢেউয়ে এসে মিশছে জনপ্রিয় গানের সুর-তাল৷ আর সেই তালে তালে দুলছে নেশাতুর শরীরগুলো৷ স্বপ্লবসনা৷ চড়া মেকাআপের চোখ ঠিকরানো আলোয় অতিথিকে বশীভূত করে তারা এগিয়ে দিচ্ছে শরীরী ভাঁজে লুকিয়ে রাখা রাতের ওম৷ আর তাতে বুঁদ নানাবয়সী কলকাতাবাসী৷ চলকে চলকে পড়া মোহের আবেশে ঢুলুঢুলু চোখে প্রবাসীরাও ডুব দিচ্ছে ছলকে ওঠা উদ্দামতায়৷ আর তারপর? তারপর তো সব আলো বদলে শুধু নীল আলোর রমরমা৷ এ ছবি শহর কলকাতার ডান্স বারগুলোর প্রতিদিনের ছবি৷ নেশার গেলাসে লোক টেনে দেহের খোরাক জুগিয়ে চলা বার ডান্সারদের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা৷ শহর এবং শহরতলীর উপকন্ঠে কার্যত ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে ডান্স বার।
বাগুইআটি-লেকটাউনের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রায় ৬০টিরও বেশি এহেন ডান্স বার রয়েছে। জনমুখে এ অঞ্চলের নাম এখন ‘বাইজিপাড়া’৷ ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এইসব ডান্সবার ছড়িয়ে পড়ছে সল্টলেক-রাজারহাট এলাকাতেও। রাত বাড়তেই যেখানে শুরু হয় অশ্লীল নাচের আসর। মায়াবী আলোয় সাহসী হওয়ার নেশায় ভিড় জমান নানাবয়সী ‘কাস্টমার’রা। যদিও এদের মধ্যে এলাকার প্রভাবশালীদের ভিড় অনেকটাই বেশি থাকে। নারীদের অশ্লীল নাচের সঙ্গে চলে কোমর দুলুনি। একেবারে সিনেপরদার মতো নাচ, দিল খুশ হলে চলে টাকা ওড়ানোও। ১০০-৫০০ নয়! মায়াবী আলোয় উড়তে থাকে হাজারের লাল নোট।
এখানেই শেষ নয়, ওই সুন্দরী যদি ‘অতিথি’কে পাগল করে তোলে, তাহলে তার সঙ্গে একরাত কাটানোর সুযোগও থাকছে। মানেটা বুঝলেন না তো! আসলে ডান্সবারের আড়ালে বসছে অবাধ দেহব্যবসার আসর৷ যদিও পুরো বিষয়টিই হচ্ছে আড়ালে আবডালে। কারণ এইভাবে দেহব্যবসা করার অনুমতি আইন দেয় না। তাই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই চলছে এই ব্যবসা। কেমন সেটা? ধরা যাক কোনও সুন্দরীর আবেদনে সাড়া দিলেন কোনও ‘অতিথি’৷ তাঁকে শুধু একটা চিরকুট বারে থাকা বয়দের হাত দিয়ে পৌঁছে দিতে হবে সেই সুন্দরীর কাছে। আর সেই চিরকুট দেখে যদি সেই সুন্দরী ইশারায় সাড়া দেয় তাহলেই কেল্লাফতে। তবে ওই নারীর সঙ্গে ব্যক্তিটি কতক্ষণ থাকতে চান, কত টাকা দেবেন সমস্ত কথাই হবে চিরকুটের মাধ্যমে। গাড়ি থেকে হোটেল সমস্ত কিছু ব্যবস্থা হয়ে যাবে মুহূর্তের মধ্যে। বাড়তি কোনও চিন্তাই করতে হবে না। পুরোটাই হয় কলসেন্টারের মতো। এক ফোনেই হোটেল থেকে গাড়ি সব বুক হয়ে যাবে। গাড়ি হোটেলে পৌঁছে দেবে দু’জনকে, আবার ‘কাজ’ শেষ হয়ে গেলে ওই গাড়িটাই আবার বাড়ি পর্যন্ত নামিয়ে দেবে। পরে আবার বারের কর্তৃপক্ষ ফোন করে খোঁজখবরও নেয়, ‘অতিথি’ সন্তুষ্ট হলেন কি না৷ এভাবেই পুলিশ ও প্রশাসনের নাকের ডগায় রমরমিয়ে চলছে শহরের ডান্সিং বারের আড়ালে দেহ ব্যবসা।
ঘনিষ্ঠসূত্রে খবর, এই বারগুলির বেশিরভাগ মালিকই অবাঙালি এবং ভিনরাজ্যের। মূলত এ শহরে ডান্সবারের আড়ালে খাটছে তাদের কালো টাকা। শুধু তাদের বলা ভুল, এই ডান্সবারে অনেক প্রভাবশালী কিংবা রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিরও টাকা খাটছে। এমনকী ব্যবসা ফুলেফেঁপে ওঠার জন্য পুলিশ এবং আবগারি দফতরের একাংশ জড়িত রয়েছে বলেও অভিযোগ সাধারণ মানুষের। তাদের আরও অভিযোগ, এই ধরনের ব্যবসা চালানোর জন্য লাইসেন্স থেকে শুরু করে নজরদারি কোনওটাই চালানো হয় না। যদিওবা কোনও ভাবে নজরদারি চালানো হচ্ছে তাতেও কিছু হচ্ছে না। প্রতি বার কর্তৃপক্ষই মোতায়েন করে রেখেছে বাউন্সারের সাজে ‘গুন্ডাবাহিনি’৷ একে মাথার উপর প্রভাবশালীদের হাত তার উপর পেশীশক্তির দাপট, ফলে মুখ খোলার সাহসও করেন না সাধারণ মানুষ। ফলে লেকটাউন-বাগুইআটি এলাকায় ক্রমশ ছেয়ে গিয়েছে এই ডান্সবারগুলোয়। এমনকি, ঘন জন বসতি এলাকাগুলিতেও একের পর গজিয়ে উঠছে এমন ডান্সবার। যেমন বাগুইআটি এলাকার ‘স্পাইস গার্ডেন’ কিংবা ‘বে ওয়াচ’। যেগুলির ঢিল ছোঁড়া দূরত্বেই রয়েছে কলেজ এবং হাসপাতাল। এমনকী প্রভাবশালী এক সিপিএম নেতার বাড়ির ঢিল ছোঁড়া দূরত্বেই রয়েছে ‘বে ওয়াচ’ ডান্সবারটি। কিন্তু সকলে জানলেও কেউই বারগুলি বন্ধ করার কোনও উপায় নেননি৷ ফলত চরম অস্বস্তিতে পড়েছেন সাধারণ অধিবাসীরা৷ কলেজ ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে তো রীতিমতো অস্বস্ততিতেই আছেন অভিবাবকর৷ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন তো বলেই ফেললেন, ‘‘ নেতাদের মদত না থাকলে কী এগুলো চলে৷ কিন্তু কে মুখ খুলে বিপদে পড়বে৷ মেয়ে কলেজে আসে, ভয়ে থাকি৷ কিন্তু কিছু করার তো নেই৷ কটাদিন মুখ বুজিয়ে কাটিয়ে দিতে পারলেই হল৷’’ বস্তুত এলাকার অধিকাংশ অধিবাসীরা চোখ বুজিয়ে কাটিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কোনও উপায়ও খুঁজে পাচ্ছেন না৷