মুন্সিগঞ্জ, ১৩ জানুয়ারি ২০২৪, নিজস্ব প্রতিনিধি (আমার বিক্রমপুর)
সেতুটিতে নির্মাণ ব্যয় ৪ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু দুই পাশে সংযোগসড়ক নেই। যাতায়াতের জন্য সেতুর একপাশে একটি, অন্যপাশে দুটিসহ বানানো হয়েছে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে তিনটি খাড়া সাঁকো। এ সেতু দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করতে হচ্ছে দুটি গ্রামের বাসিন্দাদের। প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা।
ভোগান্তির এই সেতুর অবস্থান মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার চরকেওয়ার ইউনিয়নের দক্ষিণ চরমসুরা এলাকার মেঘনা খালের ওপর।সেতুটি দক্ষিণ চরমসুরা ও ঝাপটা এলাকার মানুষের যাতায়াতের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে।
এলজিইডির তথ্য মতে, ২০২১ সালের অক্টোবরে ৪ কোটি ২৩ লাখ ৫৩ হাজার ৮৫ টাকা ব্যায়ে ৩৯ মিটার দৈর্ঘ্য ও ২৪ ফুট প্রস্থের এ সেতু নির্মাণ কাজ শুরু হয়। কাজটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় টিএন-এএস আই যৌথ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি সংযোগ সড়কসহ সব কাজ শেষে সেতুটি হস্তান্তর করার কথা ছিল। পরে নকশা জটিলতার কারণ দেখিয়ে জুন পর্যন্ত সময় বাড়ায় তারা। সে সময়েও কাজ শেষ না হওয়ায় আবারো ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় নেয় ঠিকাদার।
তবে সেতুর সংযোগ সড়ক ও রেলিং নির্মাণের কাজ শেষ হয়নি। ফলে সেতুর সুফলের পরিবর্তে দুর্ভোগই পোহাতে হচ্ছে যাতায়াতকারীদের।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, সদর উপজেলার চরকেওয়ার ইউনিয়ের দক্ষিণ চরমসুরা-রমজানবেগ সড়কের পূর্বপাশ লাগোয়া সেতুটি। মেঘনার খালের পূর্বপাশের ঝাপটা ও দক্ষিণ চরমসুরা গ্রামের একটি অংশকে এ সেতুটি মূল সড়কের সঙ্গে যুক্ত করেছে। সেতুটি মূল সড়ক থেকে অন্তত ১০ -১২ ফুট উচুঁতে। সেতুর পূর্বপাশের উচ্চতা কাঁচা মাটির সড়ক থেকে অন্তত ১৮- ২০ ফুট উপরে।
দুপাশে সংযোগ সড়ক না থাকায় সেতু দিয়ে উঠা-নামা করতে বাশঁকাঠ দিয়ে তিনটি খাড়া সাঁকো বানানো হয়েছে। সাঁকো বেয়ে সড়কপথে যাতায়াত করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৭-৮ বছর আগেও ঝাপটা এলাকার মানুষ মেঘনার খালটি নৌকায় করে পারাপার হতে হতো। এরপর এখানে বাঁশের সাঁকো বানানো হয়। ঝাপটা ও দক্ষিণ চরমসুরা গ্রামের চার হাজার বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ প্রতিদিন সাঁকো পার হয়ে মুন্সিগঞ্জ শহরে যাতায়াত করত। সেতু নির্মাণ শুরু হওয়ায় খুশি হয় স্থানীয়রা। তবে সেতুতে উঠার সংযোগ সড়ক না করায় বাঁশের সাঁকো দিয়ে সেতু পারাপার হতে হচ্ছে। বাঁশের সাঁকোতে উঠতে গিয়ে প্রায় প্রতিদিন দুর্ঘটনা ঘটছে। সাঁকো থেকে পড়ে গিয়ে কয়েকজন হাত ভেঙেছেন। দুধ, ডিম ও কৃষিপণ্য নিয়ে সাঁকো থেকে পড়ে যায়।
মঙ্গলবার দুপুরে কাঁপা কাঁপা শরীরে পূর্ব পাশ থেকে সাঁকো বেয়ে উঠেন ঝাপটা গ্রামের হাজী বাচ্চু মিঝি (৬৫)।সেতুতে উঠার পর দুমিনিট জিরিয়ে নেন তিনি। এর পর আবার সেতুর পশ্চিম পাশে দুটি ভাঙা সাঁকো বেয়ে নিচে নামেন তিনি।
বাচ্চু মিঝি বলেন, প্রতিদিন অনেক কষ্ট করে আসা যাওয়া করতে হচ্ছে। এ সেতু পার হতে ভয়ে পুরুষদের ঘাম ছুটে যায়। নারী ও শিশুদের ভোগান্তি বলে শেষ করা যাবে না। আমাদের ভোগান্তি কমানোর জন্য সরকার কোটি টাকা খরচ করে সেতু বানালো। ঠিকাদাররা সংযোগ সড়ক না করায় সেতুটি আমাদের ভোগান্তি আরো বাড়িয়ে দিল।
এদিন সাঁকো বেয়ে সেতুতে উঠতে না পেরে হামাগুড়ির মত করে ওই খালে নামেন অন্নি আক্তার নামের এক নারী।সঙ্গে ছিলো তার ৫ বছরের ছেলে আবদুল্লা। খালের পূর্বপাশে ছেলেকে মাদরাসায় নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
অন্নি আক্তার বলেন, সেতু বানানোর আগে যখন সাঁকো দিয়ে খাল পার হতাম তখনও এমন ভোগান্তি ছিল না।সংযোগ সড়ক ছাড়া সেতু বানিয়ে আমাদের মত নারী ও ছোট শিশুদের আরো বিপদ বাড়িয়ে দিয়েছে। খাড়া সাকোঁ বেয়ে সেতুতে উঠতে পারিনা। খাল দিয়ে নেমে যেতেও পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে। বৃষ্টি হলে সেটিও পারবো না।
এ বিষয়ে চরকেওয়ার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আফসার উদ্দিন ভূইয়া বলেন, কয়েক দফা মেয়াদ বাড়িয়েও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাদের কাজ শেষ করেনি। বর্ষার পরে সংযোগ সড়ক করে দেওয়ার কথা ছিল, তারা কোন কাজ করছেনা। সরকারের কয়েক কোটি টাকা খরচ করে সেতুটি করা হয়েছে। ঠিকাদারের গাফিলতির কারনে মানুষ সেতুর সুফল পাচ্ছেনা। উল্টো দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। দুর্ভোগের কথা বলে শেষ করা যাবেনা।
এ বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিক ও পিরোজপুরের মঠবাড়িয়া উপজেলা আ.লীগের সভাপতি মো. রফি উদ্দিন আহম্মেদ ফেরদৌসের সঙ্গে গত বছরের নভেম্বরে মুঠোফোনে কথা হয় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। সে সময় তিনি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা জানিয়েছিলেন। এই প্রতিবেদন লেখার সময় কাজ শেষ না হওয়ার বিষয়টি জানতে ফোন করলে তিনি রিসিভ করেননি।
সদর উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী মো. শফিকুল আহসান বলেন, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে সেতুর কাজ আমাদেরকে বুঝিয়ে দিতে পারছে না। আমরা তাদেরকে কয়েকবার চিঠি দিয়েছি। সবশেষ তারা গত ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় নিয়েছিলো। এরপরেও সেতুটি বুঝিয়ে দিতে পারেনি। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।