জেলা শহরের দুটি সরকারী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোচিং বাণিজ্য, অনিয়ম ও শিক্ষক সঙ্কটে লেখাপড়া মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বর্তমানে এই অবস্থা বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে।
জেলা শহরের এভিজেএম সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও কে কে গভ. ইনস্টিটিউশন এই দুই প্রাচীন শিক্ষালয় এখন দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য হারাতে বসেছে।
বালক ও বালিকা এই দুই প্রতিষ্ঠানেই সাধারণত জেলা শহর বা আশপাশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়ে থাকে। ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে কঠোরভাবে বাছাই করে এখানে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। এই দুই প্রতিষ্ঠানে সন্তানদের পড়ানোর জন্য গ্রামের বা উপজেলা পর্যায়ের অনেক পরিবার শহরে বাসা নিয়েছেন। কিন্তু এই দুই বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারা অনেক শিক্ষার্থী অন্য প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করে ফল ভাল করছে।
তাই অভিভাবকরা অভিযোগ করছেন সরকারী এই দুই প্রতিষ্ঠানে সন্তানদের মেধা বিনষ্ট করা হচ্ছে।
তাই একদা শিক্ষানগরী হিসেবে পরিচিত মুন্সিগঞ্জ তথা বিক্রমপুরে মানসম্মত শিক্ষার প্রসার হচ্ছে না। তাই অনেক সচ্ছল পরিবার এখন ঢাকামুখী।
এই দুটি শিক্ষালয়ে সরেজমিন ঘুরে এসে শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্লাসে আশানুরূপ শিক্ষা হচ্ছে না। অঙ্ক, বিজ্ঞানসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের শিক্ষকরা মাত্রাতিরিক্ত প্রাইভেট বা কোচিং বাণিজ্য করে হাঁপিয়ে উঠছেন। তাই ক্লাসে মনোযোগ দেয়ার মতো সময় বা এনার্জি তাদের কারও নেই। তাই কেউ কেউ ক্লাসে নানা রকম অনির্ধারিত আলোচনা করেই কোনক্রমে সময়টা কাটিয়ে দেন বা নিজেদের প্রাইভেট পড়ানোকে প্রসারিত করার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেন। এছাড়া এখানে গাইড এবং ব্যাকরণ বই পাঠ্য নিয়েও এক রকম ব্যবসা চলছে। দুটি বিদ্যালয়েই শিক্ষক ও কর্মচারী সঙ্কট প্রকট। দুটি প্রতিষ্ঠানেই সহকারী প্রধান শিক্ষকরা কয়েক বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন।
দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে, কেকে গভ. ইনস্টিটিউশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ২০১৮ সালে একটি প্রকাশনীর গাইড ও ব্যাকরণ বই পাঠ্য করে প্রায় চার লাখ টাকা এবং ২০১৯ সালে আগের প্রকাশনীটি বাদ দিয়ে অন্য দুটি প্রকাশনীর গাইড ও ব্যাকরণ বই পাঠ্য করে প্রায় তিন লাখ টাকা এককভাবে গ্রহণ করেন বলে একাধিক শিক্ষক অভিযোগ করেছেন। এই টাকায় পিকনিক বা সব শিক্ষকদের বিনোদনে কিছু টাকা ব্যবহারের কথা উঠলে তাও হয়নি।
এই বিদ্যালয়ে ৪৯ শিক্ষকের স্থলে কর্মরত আছেন ৩২ শিক্ষক। এই শিক্ষকদের মধ্যে কয়েকজন শিক্ষক প্রাইভেট বা কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত।
সকাল ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত একটানা প্রাইভেট পড়িয়ে অনেকেই বিদ্যালয়ে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়েন। অনেক শিক্ষকই ক্লাসে নির্ধারিত সিলেবাস না পড়িয়ে অনির্ধারিত আলোচনা করে ক্লাসের সময় পার করেন।
স্টপ গ্যাপে কোন শিক্ষককে দায়িত্ব দিলে গড়িমসি করেন এবং এতে কোন কোন সময় ক্লাস গ্যাপ থাকে। টিফিন পিরিয়ডে টিফিন দেয়া সত্ত্বেও অনেক শিক্ষক নিজের বাসায় চলে যান। টিফিন শেষে নির্ধারিত সময়ের ১০ থেকে ১৫ মিনিট পরে আসেন। এতে ক্লাস বিঘ্নিত হয়।
এছাড়া দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মনসুর রহমান খানের বিরুদ্ধে বিদ্যালয়ের বিভিন্ন ফান্ডের ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে টাকা গ্রহণের অভিযোগ রয়েছে।
শিক্ষক স্টাফদের সঙ্গে খারাপ আচরণসহ সঠিক সমন্বয় না থাকার কারণে জেএসসি এবং এসএসসির ফলাফলে ধস নেমেছে।
পূর্ব পাশে স্কুলের জায়গায় ৬ দোকান অবৈধভাবে নির্মাণ হয়েছে বা হচ্ছে।
এ থেকেও বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে।
এসব বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মনসুর রহমান খান অভিযোগ স্বীকার করে জানান, জেলা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসে অনেক টাকা চাঁদা দিতে হয়। গ্রীষ্মকালীন ক্রীড়াসহ নানা কারণে শিক্ষা অফিসগুলোতে চাঁদা দিতে হচ্ছে।
এছাড়া বিভিন্ন খেলাধুলায় বাচ্চাদের জার্সিসহ নানা কিছু কিনে দিতে হয়। এতে ফান্ড ব্যয় হয়ে যায়।
৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ম্যাগাজিন করেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোন ফান্ড তছরুপ করিনি। ম্যাগাজিনের বিজ্ঞাপন কোন পত্রিকায় দেয়া হয়েছে জানতে চাইলে বলেন, জাতীয় পত্রিকায় দেয়া হয়েছে। তবে পত্রিকার নাম বলতে পারেননি।
তিনি বলেন, প্রাইভেট পড়ানো এখন ওপেন সিক্রেট। আইন অমান্য করে সব স্কুলের শিক্ষকরাই প্রাইভেট পড়াচ্ছেন।
তিনি জানান, দুইটি শিফট মিলিয়ে বিদ্যালয়ে বর্তমানে ১৬৭৫ শিক্ষার্থী রয়েছে। আর ৪৯ শিক্ষকের স্থলে ৩২ শিক্ষক রয়েছেন। কর্মচারীদের অবস্থা আরও খারাপ।
সর্বশেষ এসএসসি পরীক্ষায় এই বিদ্যালয়ে পাসের হার ৮৭ শতাংশ।
কে কে গভ. ইনস্টিটিউশনের শিক্ষার্থীরা জানান, ক্লাস ঠিকমতো হয় না। কখনও কখনও ছয় ক্লাসের বিপরীতে চার ক্লাস হচ্ছে। শিক্ষকরা ক্লাসে এসে বাসায় প্রাইভেট পড়ানোর জন্য বলেন। স্কুলে বসে পড়ায় মনোযোগ দেয়ার পরিবেশ বেশিরভাগ সময় থাকে না। শ্রেণীগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি থাকায় স্বাভাবিক পাঠদান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
এদিকে এভিজেএম সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে দুই শিফটে ৫৩ পদের বিপরীতে বর্তমানে শিক্ষক আছেন ৩৫ জন। বর্তমানে শিক্ষার্থী রয়েছে ১ হাজার ৮৩২ জন। এভিজএম সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা জানান, শিক্ষকরা ক্লাসে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আসেন না। কিছু শিক্ষক আছেন যারা বাসায় প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার জন্য ছাত্রীদের নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করেন।
বিদ্যালয়টির সদ্য বদলি হওয়া ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শিউলি আক্তার জানান, স্কুলের সব শ্রেণীকক্ষ সিসি ক্যামেরার আওতাভুক্ত। সব সময় নজরদারিতে থাকে। প্রাইভেট নিয়ে যে সব শিক্ষকরা ব্যস্ত থাকেন তারা সঠিক সময়ে ক্লাসে আসতেন না, আগেই বেরিয়ে যেতেন। এখন সিসি ক্যামেরার কারণে অনিয়ম করতে বাধাগ্রস্ত হওয়ায় এতে ক্ষিপ্ত হন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের ওপর। বিদ্যালয়ের বিভিন্ন পরীক্ষার বিষয়ভিত্তিক প্রশ্ন করার ক্ষেত্রেও সিন্ডিকেট ছিল। প্রাইভেট বা কোচিং ব্যবসার স্বার্থেই এসব প্রশ্ন তারা সিন্ডিকেট করে তৈরি করতেন। তবে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক এই কয়েক শিক্ষক থেকে প্রশ্ন নিয়ে নিজে পরিবর্তন করে দেয়ার কারণে তাদের ব্যবসা বিঘ্নিত হয়। এ কারণেও ক্ষিপ্ত হন তারা।
এছাড়া মেয়েদের টাকায় শিক্ষকরা টিফিন গ্রহণ করতেন। নিজস্ব টাকায় টিফিন গ্রহণের জন্য শিক্ষকদের বলা হলেও সমস্যা সৃষ্টি হয় বলে শিউলি আক্তার জানান।
এসব কারণেই তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ও ষড়যন্ত্র করে বদলি করা হয়েছে।
তিনি গত ২০ আগস্ট কেকে গভ. ইনস্টিটিউশনে প্রভাতী শাখায় সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছেন।
আর কেকে গভ. ইনস্টিটিউশনে প্রভাতী শাখার সহকারী প্রধান শিক্ষক আনোয়ারুল হক এভিজেএম সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছেন।
তিনি বৃহস্পতিবার বলেন, সমস্যা আছে। এর মধ্য থেকেই ভাল কিছু করার চেষ্টা করছি। তিনি আরও জানান, আগের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকের বিরুদ্ধে খারাপ আচরণের অভিযোগ ছিল। আবার অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে প্রাইভেট পড়ানোর অভিযোগ ছিল।
সবকিছু মোকাবেলা করেই প্রতিষ্ঠানটি এগিয়ে নেয়া হবে।
বিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তৌফিকুল ইসলাম তালুকদার, শামসুল আলম, মোঃ শাহাবুদ্দিন, অনিল চন্দ্র বর্মণ, নিবিড় রঞ্জন গুহ, সোহানা বিনতে হাফিজ, আব্দুল গফুর সরকার, রানা কুমার সরকার, রাসেল আহম্মেদ ও মনোরঞ্জন ধর প্রাইভেট বা কোচিংয়ের সঙ্গে জড়িত।
সদ্যবদলি হওয়া ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শিউলি আক্তার অভিযোগ করেন, প্রায় ২৭ বছর এখানে কর্মরত আছেন তৌফিকুল ইসলাম তালুকদার। সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক হয়েও তিনি ইংরেজী ক্লাস চান এবং প্রশ্ন করতে দিতে বলেন। বিশৃঙ্খলা করেন এবং প্রধান শিক্ষককের বিরুদ্ধে নানা রকম গ্রুপিং করেন। প্রায় ২১ বছর ধরে আছেন শামসুল আলম। তিনিও সমাজবিজ্ঞান বিষয়ের শিক্ষক। তিনিও ইংরেজী পড়াচ্ছেন। তৌফিকুল ইসলাম তালুকদার নিজেই প্রভাব খাটিয়ে ধূমপান কক্ষ তৈরি করেন। প্রার্থনা কক্ষের পাশে এই ধূমপান কক্ষ হওয়ায় নামাজে সমস্যা হতো। তাই এই কক্ষে ধূমপান না করার জন্য বলে এটি কমন রুম করার প্রক্রিয়া শুরু করতেই ক্ষেপে যান।
এদিকে শিক্ষক শামসুল আলম অভিযোগ করেছেন, সদ্য বিদায়ী ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক শিউলি আক্তার ঈদ পুনর্মিলনীর নামে টিফিন ফান্ড ও কম্পিউটার ফান্ডের টাকা তছরুপ করেছেন। একজন স্নাতক তৃতীয় বর্ষের শিক্ষাথী সত্ত্বেও তাকে বিভিন্ন জাতীয় পরীক্ষায় সহকারী শিক্ষক হিসেবে পরিদর্শককের দায়িত্ব দেয়া হয়। কম্পিউটার ল্যাবের অবস্থা খুবই নাজুক। যে ৯টি কম্পিউটার রয়েছে তার সবই প্রায় বিকল। এখানে ব্যবহারিক পরীক্ষায়ও কম্পিউটার ব্যবহার করতে দেয়া হতো না। তার স্বামী বিদ্যালয়ের সরকারী-বেসরকারী সব কেনাকাটা করতেন। সঙ্গে তার পক্ষের ২/১ জন শিক্ষক নিতেন।
পরে কমিটির আহ্বায়ক ও সদস্যদের ভাউচারে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করতেন। এছাড়া বিজ্ঞান ল্যাবের যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং গ্রহণের ব্যাপক অনিয়ম রয়েছে। যন্ত্রপাতি না কিনে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারের সঙ্গে আঁতাত করে নগদ টাকা তুলে নিতেন। নন ক্যাডারের নতুন শিক্ষকদের কথায় কথায় শোকজ করতেন। একই গ্রেডের সহকারী প্রধান শিক্ষককেও শোকজ করেছেন। প্রভাতী শাখার নবম শ্রেণীর চার শিক্ষার্থীকে ব্যবহার করে একটি গ্রুপ তৈরি করে তার স্বার্থে ব্যবহার করেন। এই গ্রুপের একটি মেয়েকে পদার্থ বিজ্ঞানে ১০ এর পরিবর্তে ১৭ দিয়ে উত্তীর্ণ দেখান।
তবে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করে শামসুল আলম বলেন, ২১ বছর ধরে তিনি এই বিদ্যালয়ে আছেন। ভালোভাবেই আছেন।
তবে প্রাইভেট তিনি পড়ান। আর অন্যান্য যাদের নাম এসেছে তারাও পড়ান। প্রাইভেট পড়ানো কোচিং ব্যবসায় জড়ানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কর্মরত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ানো যাবে না। তবে প্রতিষ্ঠানের অনুমতি সাপেক্ষে নির্দিষ্ট সম্মানিতে বিদ্যালয়েই পড়তে হবে। আর বাসায় অন্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১০ জনকে পড়নো যাবে।
কিন্তু এই নিয়ম কেউ মানছেন না। সবকিছু অবজ্ঞা করেই প্রতিযোগিতা করে প্রাইভেট পড়ানো হচ্ছে।