২০শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
মঙ্গলবার | রাত ১০:৩৯
বিশ্লেষণ: যেসব কারণে মুন্সিগঞ্জ ১ আসনে এগিয়ে আছে নৌকা
খবরটি শেয়ার করুন:

মুন্সিগঞ্জ, ৬ জানুয়ারি ২০২৪, (আমার বিক্রমপুর)

মুন্সিগঞ্জ-১ আসন: বিগত ৬টি জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষনে কাগজে কলমে এগিয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থী তবে মাঠে রয়েছে কিছু চ্যালেঞ্জও

লিখেছেন আবু জাফর আহমেদ মুকুল

স্বাধীনতার ৫২ বছর পর মুন্সিগঞ্জ-১ আসনে (শ্রীনগর ও সিরাজদিখান উপজেলা) এই প্রথম সিরাজদিখান উপজেলা থেকে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন মহিউদ্দিন আহমেদ। তিনি ৩০ বছর ধরে (টানা ছয়বার) সিরাজদিখান উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও টানা ৩ বারের নির্বাচিত উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান। তাঁর স্ত্রী মালখানগর ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান যেখানে তিনিও টানা পাঁচবারের চেয়ারম্যান ছিলেন।

এছাড়া তার বড় ছেলে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। ছোট ছেলে সাফোয়ন আহমেদ রিফাত মালখানগর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের কার্যকরী সদস্য, মেঝো ভাই মালখানগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি, সেজো ভাই জেলা তাতীলীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক। তার পুরো পরিবারই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত।

এই আসনটি আওয়ামী লীগের ঘরে উঠবে বলে দাবি করছেন মুন্সিগঞ্জ-১ (শ্রীনগর ও সিরাজদিখান) এই দুই উপজেলার আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী অন্যান্য সংগঠনগুলো। পাশাপাশি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক গোলাম সারোয়ার কবির এবং তৃনমূল বিএনপি এর নির্বাহী চেয়ারপার্সন অন্তরা সেলিমা হুদা।

উল্লেখ্য যে, গোলাম সারোয়ার কবির ও এডভোকেট সেলিমা হুদা অন্তরা এর আগে মুন্সিগঞ্জ-১ আসন থেকে কখনো এমপি প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দিতা করেননি যার ফলে তাদের ভোটের নির্দিষ্ট শতকরা হার নিয়ে সম্ভাবনা যাচাই করা আমাদের গবেষনায় সম্ভবপর হয়নি। হয়তো পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনে এই কাজটি করা সম্ভব হতে পারে। গোলাম সারোয়ার কবির মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ায় তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ তাকে সমর্থন করেন যেটি গবেষনার পর্যবেক্ষণে আমরা পেয়েছি।

অন্যদিকে, বর্তমান সংসদ সদস্য মাহী বি চৌধুরির পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণে নির্দিষ্ট ভোট ব্যাংক রয়েছে। স্থানীয় নেতাদের প্রভাব, সময়ের প্রেক্ষাপট ও নানাবিধ মেরুকরণের কারনে যে কোন মুহুর্তে ভোটারদের সমর্থন পরিবর্তন হতে পারে ।

তারপরও চেষ্টা করেছি, বিগত ২৭ বছরের ফলাফল বিশ্লেষণ ও মাসব্যাপি ফিল্ড সার্ভে করে এবারের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য গবেষণা ও বিজ্ঞানধর্মী রুপরেখা দিতে।

উপরের টেবিল থেকে এটা স্পষ্ট যে, দীর্ঘ ২৭ বছরে আওয়ামী লীগের পক্ষে নৌকা মার্কায় ভোট বেড়েছে প্রায় দ্বিগুন।

যারা প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ করেন তাদের ভোট অন্য কোন প্রার্থী বা অন্য কোন মার্কায় দেওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম বললে চলে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে দল-মত-বর্ণ নির্বিশেষে নৌকা মার্কার প্রার্থী মহিউদ্দিন আহমেদকে তার নিজস্ব উপজেলা সিরাজদিখান থেকে একচেটিয়া ভোট পাবেন বলে আমাদের গবেষনায় পেয়েছি।

পাশাপাশি, চ্যালেঞ্জিং উপজেলা শ্রীনগর থেকেও আওয়ামী লীগের দলীয় ভোট নিশ্চিত হলে নৌকা মার্কার প্রার্থী এগিয়ে থাকবে বলে আমাদের গবেষণায় প্রতীয়মান হয়েছে।

এবারের নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ না করায় ধরে নেওয়া হয়েছে মোট ভোটারের প্রায় ৩০% ভোটার উপস্থিত হবে না। সেক্ষেত্রে সিরাজদিখানে অধিকাংশ বিএনপির ভোট এলাকার ছেলে হিসেবে স্বীকৃত মহিউদ্দিন আহমেদ এর পক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি কিন্তু শ্রীনগরে বিএনপির ভোট কোন প্রার্থীর পক্ষে যাবে সেটা বলা খুব মুশকিল। তবে, ধরে নেওয়া হয়েছে শ্রীনগর উপজেলার কিছু সংখ্যক বিএনপির ভোটার বিকল্পধারা ও তৃণমূল বিএনপির প্রার্থীকে ভোট দিবে।

সুতরাং, শ্রীনগর উপজেলায় বিএনপি এর ভোট ব্যাংক একটি বিশাল ফ্যাক্টর; তাদেরকে টানতে পারলে যে কোন প্রার্থী এগিয়ে থাকতে পারে। বিগত ২৭ বছরের ৬টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে এবারের নির্বাচনে মোট ভোটারের প্রায় ৫৫শতাংশ ভোটার উপস্থিত হতে পারে সে হিসেবে ভোটার সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ ৭৯ হাজার ৯শত ৪৫ জন।

সে হিসেবে, আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী নৌকা মার্কায় ভোট পেতে পারেন ১ লাখ ৭৭ হাজার ৮শত ২১ ভোট; যা উপস্থিত ভোটারের প্রায় ৬৩.৫২শতাংশ।

উল্লেখ্য যে, বিগত নির্বাচন ২০১৮, ২০১৪ সালেও মহাজোট ও আওয়ামী লীগের প্রার্থী নৌকা মার্কায় উপস্থিত ভোটারের যথাক্রমে প্রায় ৮৬শতাংশ ও প্রায় ৯৬শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছে।

স্থানীয় ভোটারদের সাথে কথা বলে তাদের অনেক ক্ষোভ সম্পর্কে জানা গেছে। যার মধ্যে অন্যতম দীর্ঘদিন ঢাকা-শ্রীনগর সরাসরি বাস সার্ভিস চালু না করা, শ্রীনগর ও সিরাজদিখানকে পৌরসভায় রুপান্তর না করা, সরকারি অফিসগুলোতে যথাযথ নাগরিক সেবা নিশ্চিত করতে না পারা, জগদীশচন্দ্র বসুর নামে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন না করা, আড়িয়াল বিলকে পর্যটন বান্ধব না করা, উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বেডের সংখ্যা না বাড়ানো, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, ক্ষতিগ্রস্থ আলু চাষীদের পাশে না দাঁড়ানো, প্রবাসীদের জন্য কোন ট্রেনিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা না করা ইত্যাদি।

অনেকে প্রশ্ন করেন, আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী নৌকা মার্কায় ভোটার উপস্থিতির সর্বনিম্ন শতকরা কত ভোট পেতে পারেন? সেক্ষেত্রে আমাদের কাছে সর্বোত্তম উদাহরণ হলো ২০১৪ সালের নির্বাচন। যেখানে বিএনপি অংশগ্রহন করেনি। সেই নির্বাচনে প্রায় ৫৪ শতাংশ ভোটার উপস্থিতির মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সুকুমার রঞ্জন ঘোষ পেয়েছিল ৫২ শতাংশ ভোট যা মোট উপস্থিতির প্রায় ৯৬ শতাংশ। সে হিসাব করলে বর্তমানে নৌকার প্রার্থী ভোটার উপস্থিতির মোট ৫৫ শতাংশ ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, শ্রীনগরের প্রার্থী বেশি হওয়ায় এখানে ভোট ভাগাভাগি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সেক্ষেত্রে শ্রীনগরে আওয়ামী লীগের যে নির্দিষ্ট ভোট আছে সেখান থেকে ভোট কমতে পারে।

পাশাপাশি, শ্রীনগর উপজেলায় রাঢ়িখাল ইউনিয়ন পরিষদ ও ভাগ্যকুল ইউনিয়ন পরিষদে নৌকার প্রার্থীর জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে কারন এখানে অন্য জেলা থেকে আগত ভাসমান ভোটারও রয়েছে। এমনকি নৌকার প্রতিদ্বন্দী প্রার্থীর নিজস্ব এলাকা কুকুটিয়া ইউনিয়ন, ভাগ্যকুল ইউনিয়ন ও বীরতারা ইউনিয়ন হওয়ায় নৌকার প্রার্থীকে শ্রীনগরে অনেক চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হবে। তবে, এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো। সেক্ষেত্রে অবশ্যই প্রার্থীদের কৌশলগত অবস্থান নিয়ে ভোটারদের আকৃষ্ট করে ভোটকেন্দ্রে স্বশরীরে আনার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি।

সাধারণ ভোটারদের মধ্যে দীর্ঘদিন পর সিরাজদিখান উপজেলা থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পেয়ে তাদের মধ্যে বেশিরভাগ উচ্ছ্বাস আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে। এ থেকে বলা যায়- অনেক প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দীতার মধ্যেও মুন্সিগঞ্জ-১ আসনে সুষ্ঠু নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা মহিউদ্দিন আহমেদ এর বিজয় সুনিশ্চিত।

লেখকঃ গবেষক ও বিশ্লেষক।

error: দুঃখিত!