দৈনিক ইনডিপেনডেন্ট কাগজে জেরেমি আতিয়া নামের একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক বাংলাদেশের বিষ্টি নিয়ে বেশ একখানি চমৎকার রচনা লিখে নাম দিয়েছিলেন ‘অড টু দ্য উইন্ড অ্যান্ড রেন’। সে ঘটনা দশ বছর আগের। তিনি ছিলেন ভ্রাম্যমাণ সাংবাদিক। সে রচনায় তিনি বাংলাদেশের বর্ষার গুণগান গেয়েছেন। জেরেমি আতিয়ার প্রবন্ধের কিছু অংশ আমি বাংলায় অনুবাদ করে দিলাম :’আমি যখন ছোট ছিলাম সেখানে একটি সাংঘাতিক যুদ্ধ হয়েছিল। আর তার ফলে জর্জ হ্যারিসন নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে একটি চমৎকার কনসার্টের আয়োজন করেছিলেন, যে কনসার্টে অংশ নিয়েছিলেন বব ডিলান ও ক্লাপটন। এখন বড় হয়ে বাংলাদেশকে তেমন মনে করতে পারি না, যদিও প্রতিদিন প্রচুর বাংলাদেশি ‘টেকওয়ে’ খাবার নিয়ে ঘরে ফিরি। আর তখন কেবল জানি রেস্টুরেন্টের সেই সুট পরিহিত ভদ্রলোকটির বাড়ি বাংলাদেশে। কেবল জানি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের মতো আর একটি দেশ এবং এই বাংলাদেশই এককালের পাকিস্তানের বিফল চাচাতো ভাই। কলকাতার চৌহদ্দির বাইরে একটি দেশ, যেখানকার ১৫০ মিলিয়ন মানুষ সারাক্ষণই ভয়ে ভয়ে থাকে আবার কখন আর একটি বড় সাইক্লোন এসে হানা দেবে। আমি ভেবেছিলাম এর চেয়ে বেশি আর কী আছে বাংলাদেশে? কিন্তু গত সপ্তাহে আমি যখন বিমানে করে ঢাকা গেলাম দেখলাম বর্ষণ মুখরিত, কর্দমাক্ত একটি দেশ হাজার হাজার রিকশা আর বিবিধ গোলমালে চারপাশ মুখরিত করে রেখেছে। তখন মৌসুমি বিষ্টির সঘন সময়। দেখলাম এই বিষ্টির মধ্যে, ভেজা গাছপালার মধ্যে পূর্বের সেই অলীক কল্পনার দালান কার্জন হল লুকিয়ে আছে। আর অসংখ্য দরদালানে আকাশ পরিপূর্ণ হয়ে আছে। এই প্রথম আমি জানতে পারলাম, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ মুসলমান। সেই সংখ্যাগত কারণেই ব্রিটিশ শাসনকর্তা হাস্যকরভাবে একটি মুসলিম পাকিস্তানের সৃষ্টি করেছিলেন, মাঝখানে কেটে। এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই, সেই ভয়াবহ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে এদের একটি যুদ্ধ করতে হয়েছিল। আমাকে ওখানে অনেকেই বলেছিল, আমরা আগে বাঙালি, তারপর মুসলমান। কিন্তু সিরিল র্যাডক্লিফ নামে একজন ব্রিটিশ প্রথমে বাংলাকে কেটে দুই ভাগ করেন এবং দেশকে সৃষ্টি করেন টেবিলের ওপরের মানচিত্র কেটে। যদি সে সময় তার একটি বাংলাদেশ গড়ার কথা মনে হতো, তাহলে এত কাণ্ড হতো না। কেবল একটি বাংলাদেশ। আকাশ থেকে এই বর্ষার পানির রূপ অসাধারণ মনে হয়। সাগরে জেগে আছে ছোট ছোট অনেক দ্বীপ। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, এখানে এসে ইসলাম ধর্ম যদি নতুন রূপ পায়। এখানে প্রতিটি মানুষ ঈশ্বরের সঙ্গে সমঝোতা বা সংযোগ করেন তার পছন্দমতো নিজস্ব পথে। প্রধানত সঙ্গীত এবং কবিতার মধ্য দিয়ে। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মকে শেষ করা হয়নি বরং তারা মুসলিম সংস্কৃতিতে মিশে আছে। এরা সবাই মিলেই এখন বাঙালি। বাউল বলে আমরা যাদের জানি তারা এখানে আপনমনে গান গায়। আর এসব বাউলের ভক্ত অসংখ্য। এর ফলে ঘোরতর ইসলামের গোঁড়ামি কমে গেছে। আমার সবচেয়ে অবাক লেগেছে বাংলাদেশে কবিদের যেভাবে সম্মানিত করা হয়। এ দেশের এমন কোনো জায়গা নেই বা আলোচনা নেই, যেখানে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল বাদ দিয়ে কোনো আলোচনা হয়। আমি বেশ কয়েকজন কবির সঙ্গে মিলিত হয়েছিলাম, এদের মধ্যে শামসুর রাহমান একজন। তিনি জাতীয় কবি। তিনি আরও বলেন, হায় ভাবতেও খারাপ লাগে, এমন বর্ষণ মুখরিত শস্য শ্যামলা দেশেও মৌলবাদিতার ঝড় বয়ে যায়। আমরা জানি, এমন ব্যাপার কেন ঘটছে। এই মৌলবাদিতা কোনো এক বিশেষ শক্তি যেমন আফগানিস্তান, পাকিস্তান, কিছু আরব দেশ, ইরান এই মৌলবাদিতাকে ব্যবহার করছে, তেমন করে তা বাংলাদেশেও ব্যবহার করতে চাইছে। বর্ষণ মুখরিত বাংলাদেশে এমন হওয়া উচিত ছিল না। যেখানে বাউল, লালন, রবীন্দ্রনাথ, সেখানে মৌলবাদিতা মানায় না। তারেক মাসুদ আমাকে মুগ্ধ করেছে।’ —
এরপর তিনি কথা বলেছেন সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্ট নিয়ে। তার মতে, ‘যে ধর্ম একদিন পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল এখন দেখা যাচ্ছে এই ধর্মেও দুই পাকিস্তানের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান ছিল। একটি শস্য শ্যামল, বর্ষণমুখর কবি, গীতিকার ও বাউলের বাংলাদেশ যেখানে ৫০টিরও বেশি নদী আছে, আর একটি খেজুর গাছ, মরুভূমি এবং অন্য প্রকার সংস্কৃতি চর্চার দেশ।’ কাজেই পাকিস্তানের ধর্ম ঠিক বাংলাদেশের ধর্মচর্চার মতো কী করে হয়? আরব দেশের ঈশ্বর বাংলাদেশের শস্য শ্যামল ঈশ্বর যখন হন, তার চেহারা কি বদলায় না? যেমন বদলায় মানুষের চেহারা?
জেরেমি আতিয়া মুক্তিযোদ্ধা আক্কু চৌধুরীর সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। অনেক কথার পর আক্কু চৌধুরী বলেছিলেন তাকে_ আমরা মুসলমানরা সংখ্যাগতভাবে বাংলাদেশের আধিপত্য করার মতো অনেক সংখ্যা; কিন্তু সেদিন আমরা যুদ্ধ করেছিলাম আমাদের হিন্দু কমিউনিটিকে একটি বিশাল ‘হলোকাস্ট’ থেকে বাঁচাতে, একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ তৈরি করতে। আক্কু চৌধুরী এ ব্যাপারে এত বেশি সচেতন যে শহরের মাঝখানে একটি মুক্তিযুদ্ধের মিউজিয়াম তৈরি করে সেসব অত্যাচারিত মানুষের স্মৃতির উদ্দেশে মিউজিয়ামটি উৎসর্গীকৃত করেছেন। যারা ধর্মের নামে নানা কিছু করে তাদের বলতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহা