মুন্সিগঞ্জ, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২, নিজস্ব প্রতিনিধি (আমার বিক্রমপুর)
আজকের মুন্সিগঞ্জ জেলা এক সময় বিক্রমপুর নামে ভারতবর্ষে পরিচিত ছিল। এ বিক্রমপুর ছিল প্রাচীন বাংলার রাজধানী। রাজা বিক্রমাদিত্য অথবা বঙ্গরাজ চিত্রসেন বিক্রমপুর নগরীর স্থাপন করেন। এখন থেকে ১০০০ বছর আগে যে বঙ্গরাজ্য সভ্যতার সূচনা হয় সে বঙ্গরাজ্যের রাজধানী বিক্রমপুর।
প্রাচীন বঙ্গের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। বর্তমানে বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার একটি অঞ্চল হিসেবে শুধু বিক্রমপুর নামটি বেঁচে আছে। দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গের প্রাচীন রাজ্যের রাজধানী বিক্রমপুর শহরের ধ্বংসাবশেষ বিলীন হয়ে গেছে।
প্রাচীনকালে নিঃসন্দেহে বিক্রমপুর বঙ্গ জনপদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কেন্দ্র ছিল।
অঞ্চলটি খ্রিস্টীয় দশ শতকের শুরু থেকে তেরো শতকের প্রথম পর্যন্ত চন্দ্র, বর্মন ও সেন রাজাদের রাজধানী ছিল। বিক্রমপুরের উল্লেখ ‘স খলু শ্রী বিক্রমপুর সমাবাসিত শ্রীমজ্জয়স্কন্ধবারাত’ (বিজয় অথবা রাজধানীর রাজকীয় স্থান যা বিক্রমপুরে অবস্থিত)-রূপে শ্রীচন্দ্রের তাম্রশাসনে সর্বপ্রথম দেখা যায় এবং পরবর্তী বর্মন ও সেন রাজবংশের শাসনামলে বিক্রমপুরের এ মর্যাদা অব্যাহত ছিল।
এমনকি সেনদের শাসনামলে, যাঁরা বলতে গেলে প্রায় সমগ্র বঙ্গের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করেছিলেন, বিক্রমপুর তাঁদের রাজধানী রূপে বলবৎ ছিল এবং নদীয়ায় মুসলমান আক্রমণকারী বখতিয়ার খলজীর হাতে পরাজিত হওয়ার পর লক্ষ্মণসেন এ অঞ্চলে এসেছিলেন।
তাঁর দুই পুত্র বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেন স্বল্পকালের জন্য এ অঞ্চল শাসন করেছিলেন।
বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেনের তাম্রশাসনগুলিতে রাজধানী রূপে বিক্রমপুরের উল্লেখ না থাকলেও তাঁরা যে ভূমি দান করেছিলেন তার অবস্থান ছিল বিক্রমপুর ভাগে। এতে এ অঞ্চলের ওপর তাঁদের কর্তৃত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। বিক্রমপুরের খ্যাতি ১২৮০ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিক পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। এসময় দনুজমাধব দশরথদেব কিংবা জিয়াউদ্দীন বরনীর দনুজ রায় সুবর্ণ গ্রামের (সোনারগাঁও) সন্নিকটে তাঁর রাজধানী স্থানান্তর করেন। তখন থেকে সমগ্র সুলতানি আমলে এ অঞ্চলটি বিস্মৃতির পাতায় থেকে যায়। এরপর মুগল যুগে রাজস্ব তালিকায় শুধু পরগনা হিসেবে এর নামের উল্লেখ পুনরায় দেখা যায়। মুগল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদ রায় ও কেদার রায়এর (বাংলার বারো ভূঁইয়াদের উল্লেখযোগ্য দুজন) বীরোচিত প্রতিরোধ বিক্রমপুরকে কিছুটা স্বল্পস্থায়ী গৌরব প্রদান করে।
প্রাচীনকালে বিক্রমপুর ছিল এক বিশাল এলাকার নাম। মুঘল যুগে বিক্রমপুরের আয়তন ছিল ৯০০ বর্গমাইল। বৃটিশ শাসনামলে বিক্রমপুরকে আরো ছোট করা হয়। তখন বিক্রমপুরের আয়তন দাড়ায় ৪৮৬ বর্গ মাইল। সমগ্র মুন্সিগঞ্জ জেলা, মাদারীপুর জেলা, শরীয়তপুর জেলা, ফরিদপুরের পূর্বাংশ, নারায়ণগঞ্জ সদর, ঢাকার দোহার, নবাবগঞ্জ বিক্রমপুরের অন্তর্গত ছিল।
অর্থাৎ ঢাকার শ্যামপুর থেকে বরিশালের উত্তর সীমান্ত পর্যন্ত ভূ-ভাগই প্রাচীন বিক্রমপুর নামে অবহিত হতো। উত্তর নিরক্ষরেখার ২৩ ডিগ্রী ১৪ ইঞ্চি থেকে ২৪ ডিগ্রী ২৮ ইঞ্চি কলার মধ্যে, পূর্ব দ্রাঘিমা ৮৯ ডিগ্রী ৪৫ ইঞ্চি ও ৯০ ডিগ্রী ৫৬ ইঞ্চি কলার মধ্যে বিক্রমপুর অবস্থিত।
১৮৪৫ সালে মুন্সিগঞ্জ মহকুমায় রূপান্তরীত হয়। তখন মুন্সিগঞ্জ, শ্রীনগর, রাজাবাড়ী ও মুলফতগঞ্জ এ চারটি থানা নিয়ে ১৮৪৫ সালের মে মাসে মুন্সিগঞ্জকে বৃটিশ সরকার মহকুমায় উন্নীত করে।
১৮৬৯ সালে পদ্মার গতি পরিবর্তনে মুন্সিগঞ্জ ছোট হয়ে যায়। অর্থাৎ ১৮৬৯ সালের আগে পদ্মা মুন্সিগঞ্জ বিক্রমপুরের ১০০ মাইল পশ্চিম দিয়ে প্রবাহিত হতো। পদ্মা মুন্সিগঞ্জের মধ্যভাগ দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় রাজাবাড়ী ও মুলফতগঞ্জ থানা মুন্সিগঞ্জ মহকুমা হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাখেরগঞ্জ জেলার অন্তর্ভূক্ত হয়। রাজাবাড়ী ও মলফতগঞ্জ থানায় ৪৫৮টি গ্রাম ছিল। পদ্মাই মুন্সিগঞ্জকে ছোট করে দেয়।
১৮৮২ সালে মুন্সিগঞ্জ মহকুমা থেকে নারায়ণগঞ্জকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। এর আগ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ মুন্সিগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত ছিল। ১৯১৪-১৫ সালে বৃটিশ সরকার টংগিবাড়ী, সিরাজদিখান ও লৌহজং থানা বৃদ্ধি করে। ফলে মুন্সিগঞ্জ, শ্রীনগর, লৌহজং, সিরাজদিখান ও টংগিবাড়ী মিলে পাঁচটি থানা করা হয়। ১৯৪৮ সালে গজারিয়া থানাকে কুমিল্লা থেকে কেটে মুন্সিগঞ্জ মহকুমায় সংযুক্তি করা হয়। ফলে মুন্সিগঞ্জ মহকুমায় ছয়টি থানা নিয়ে পূণর্বিন্যাস হয়। এরপর এরশাদ সরকার ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ মুন্সিগঞ্জ মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর করে।
বিক্রমপুর থেকে কিভাবে মুন্সিগঞ্জ হলো এ বিষয়টি নিয়ে অনেকের কৌতুহল রয়েছে। ১৮৪৫ সালে মুন্সিগঞ্জ মহকুমা হলেও মুঘল আমলে “মুন্সিগঞ্জ” নামের সূচনা ঘটে হয়তো। সুলতানী আমলের ১৪৬৯ সালে বিক্রমপুর সম্পূর্ণরূপে মুসলমানদের আয়ত্তে চলে আসে। ১৬৬০ সালে আওরঙ্গজেবের শাসনামলে মুন্সিগঞ্জ “ইদ্রাকপুর কেল্লা” নির্মাণ করেন মীর জুমলা।
মুন্সিগঞ্জ শহরের উত্তর পাশে ইছামতি ও ধলেশ্বরী নদীর নিকটে “ইদ্রাকপুর নামে একটি গ্রাম রয়েছে। এ গ্রামটি কেন্দ্র করেই “গঞ্জ” বা শহর গড়ে ওঠে। বিক্রমপুরের রাজধানী শহর রামপালের কাজীকসবা গ্রামে এক বিখ্যাত মুসলিম জমিদার বা ফৌজদার বাস করতেন।তার নাম মুন্সী হায়দার হোসেন। আবার কারো কারো মতে মুন্সী এনায়েত আলী জমিদারী করতেন। ইদ্রাকপুর গ্রামটি মুন্সী হায়দার হোসেনের অথবা এনায়েত আলীর নামে হয়েছে। তাদের যে কারো নামের প্রথমাংশ “মুন্সী” দিয়ে শহরের নাম করে হয় মুন্সিগঞ্জ।
বিক্রমপুর শহরের অবস্থানকে মুন্সিগঞ্জের আধুনিক শহর থেকে অনতিদূরে রামপাল অঞ্চলের সঙ্গে শনাক্ত করা হয়েছে। অঞ্চলটির প্রত্মতাত্ত্বিক নিরীক্ষণের ভিত্তিতে অনুমেয় যে, প্রাচীন রাজধানীটি প্রায় ১৫ বর্গ মাইল জুড়ে বিস্তৃত ছিল এবং সেখানে প্রায় ১৭/১৮টি গ্রাম ছিল। এ অঞ্চলের উত্তর দিকে ইছামতি নদী প্রবাহিত এবং প্রাচীন নদীর স্রোতোধারার সমান্তরালে পূর্ব-পশ্চিমে প্রসারিত বেশ উঁচু পাঁচিলের ধ্বংসাবশেষ দৃষ্ট হয়। পূর্ব দিকে ব্রহ্মপুত্রের প্রাচীন স্রোত প্রবাহিত। পশ্চিম ও দক্ষিণে দুটি প্রশস্ত পরিখা রয়েছে যা বর্তমানে যথাক্রমে মিরকাদিম খাল ও মাকুহাটি খাল নামে পরিচিত। ২০০ ফুট প্রশস্ত পরিখা দ্বারা বেষ্টিত মাটির দুর্গে অবস্থিত বল্লালবাড়ি রাজপ্রাসাদটি এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত।
রামপালের চারপাশে প্রাক-মুসলিম যুগের অনেক পুকুর দেখা যায়। তবে স্থাপত্যের দিক দিয়ে বিভিন্ন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ছাড়া সেযুগের অন্য কোন ইমারত কদাচিৎ নজরে পড়ে।
১৯২৯ সালে এন.কে ভট্টশালী প্রায় ৩০টি ধ্বংসাবশেষ শনাক্ত করেন। তিনি ধীপুর ও সোনারং নামে দুটি গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরস্থলের কথা উল্লেখ করেন।
রাখাল দাস ব্যানার্জীও রঘুরামপুরের সন্নিকটে কিছু কাঠামো দেখেন। পার্শ্ববর্তী বজ্রযোগিনী গ্রাম ছিল প্রসিদ্ধ বৌদ্ধ পন্ডিত অতীশ দীপঙ্কর এর জন্মস্থান।
সমগ্র অঞ্চলটিতে অতি মূল্যবান প্রাচীন নিদর্শনসমূহ দেখা যায়। যেমন, মূল্যবান ধাতুতে নির্মিত নিখুঁত কারুকার্যপূর্ণ (হিন্দু ও বৌদ্ধ) ভাস্কর্যসমূহ। এ অঞ্চল (চুরাইন) থেকে প্রাপ্ত একটি রূপার বিষ্ণুমূর্তি বর্তমানে ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। দীর্ঘ কাষ্ঠখন্ড নির্মিত অপ্সরা আকৃতির (সুরসুন্দরী) এগারো শতকের একটি স্তম্ভ (বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত) সমগ্র উপমহাদেশে এক অদ্বিতীয় নিদর্শন হিসেবে বিবেচ্য।
ভাস্কর্য অলঙ্করণসহ আরও দুটি কাঠের স্তম্ভ বিখ্যাত রামপাল দিঘি (২২০০ ফুট ৮৪০ ফুট) থেকে পাওয়া গেছে। যদিও রামপালের চতুর্দিকের বর্তমান প্রাকৃতিক ভূদৃশ্য প্রাচীন কালের মহানগরীর অস্তিত্বের কোন ইঙ্গিত প্রদান করে না, তথাপি প্রাচীন নিদর্শন ও লোককাহিনীসমূহ প্রাচীন শহরের অতীতের গৌরবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। চারদিকের নদীর গতিধারাও এক সময়ের সমৃদ্ধিময় শহরের বিলুপ্তির কারণ হতে পারে। রামপালে মধ্যযুগীয় একটি মসজিদ ও বাবা আদম শহীদ এর সমাধির ধ্বংসাবশেষ বর্তমানে একমাত্র দর্শনীয় ঐতিহাসিক নিদর্শনরূপে দাঁড়িয়ে আছে।
বাংলাপিডিয়ায় মুন্সিগঞ্জ নামের উৎপত্তির কথা এভাবে বলা হয়েছে
During the Mughal rule the present munshiganj town incloding the outlaying areas was known as Idrakpur which was named after then the mughal Faujder Idrak a village on the Out skirts of Munshiganj twon is still Known as Idrakpur. During the British rule Idrakpur was renamed as munghiganj after the name of munshi Enaet Ali, Local zaminder and the in habitant of the village Kazikasba in Rampal.
আর ১৮৪৫ সালের মে মাসে মুন্সিগঞ্জ মহকুমা হলে বৃটিশ সরকারের সকল রাজস্ব বিভাগের নকশা, দলিল, পর্চা, মৌজা- খতিয়ান ও সেরেস্তায় মুন্সিগঞ্জ নাম স্বীকৃত ও লিপিবদ্ধ করা হয়।
অদ্যবধি বিক্রমপুরের এ অংশ মুন্সিগঞ্জ নামেই খ্যাত। মুন্সিগঞ্জ জেলার আয়তন ৩৮১ বর্গমাইল।
মুন্সিগঞ্জের উত্তরে ধলেশ্বরী নদী, নারায়নগঞ্জ, বুড়িগঙ্গা নদী ও ঢাকা জেলা, পশ্চিমে ঢাকার দোহার নবাবগঞ্জ ও পদ্মা নদী, দক্ষিণে পদ্মা নদী, শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা, পূর্বে চাঁদপুর ও কুমিল্লা জেলা।