মুন্সিগঞ্জ, ২ আগস্ট, ২০২১, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)
একেকটি টিনের ঘর যেন প্রাসাদ! ১ তলা, ২ তলা এমনকি ৩ তলা পর্যন্ত উঠছে টিন ও কাঠ দিয়ে তৈরি করা বিক্রমপুরের রেডিমেড ঘরগুলো।
পর্যাপ্ত আলো বাতাস পাওয়া যায় এই ঘরের ভেতর।আবহাওয়াভেদে ঘর ঠাণ্ডা বা গরম থাকে। গরমের সময়টা ঘরের ভেতর শীতল আর শীতের সময় থাকে উষ্ণ।
প্রকারভেদে একেকটি ঘরের স্থায়ীত্ব হয় ৫০ থেকে ৮০ বছর। বর্তমানে সেরার মধ্যে সেরা হয়ে উঠেছে বিক্রমপুর তথা মুন্সিগঞ্জের এই রেডিমেড ঘরগুলো।
মানসিক প্রশান্তি আর নান্দনিক ডিজাইনের কারনে মুন্সিগঞ্জ সহ শরীয়তপুর, ফরিদপুর, টাঙাইল ও ময়মনসিংহ থেকে ক্রেতারা আসছেন ঘর কিনতে। এছাড়া মুন্সিগঞ্জের সবকয়টি উপজেলায় এই ঘরের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে মুন্সিগঞ্জের প্রবাসীদেরও প্রথম পছন্দ এই দোচালা আটচালা, ষোল চালার বাহারি ডিজাইনের টিনের ঘর।
মুন্সিগঞ্জের সদর, টংগিবাড়ী ও লৌহজং উপজেলা সহ বিভিন্ন এলাকায় বর্তমানে এই ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়।
ঘর নির্মাণ শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিদেশী নাইজেরিয়ান লোহা কাঠ দিয়ে বেশিরভাগ ঘরগুলো তৈরি করা হয়। এছাড়া সেগুন, শাল, বাচালু ও ওকান কাঠের ঘরের চাহিদাও রয়েছে। একেকটি ঘর নির্মাণ করতে ৫-৭ জন শ্রমিকের সময় লাগে ৪-৫ দিন। ঘরগুলো বিক্রি হয় ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৬ লাখ টাকায়। এর চাইতে বেশি দামেও ঘর পাওয়া যায়। তবে সেগুলো অর্ডার করার পরে বানিয়ে দেয়া হয়।
ঘর নির্মাণে যেসব কাঠ ব্যবহার করা হয় সেগুলো গাছ হিসেবে চট্রগ্রামের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কিনে আনেন ঘর ব্যবসার সাথে জড়িত মহাজনরা। এরপর গাছগুলোকে স মিলে কেটে সাইজ করা হয়। সেগুলোতে নকশা করেন নকশা মিস্ত্রিরা। টিনগুলো আনা হয় বাইরে থেকে। ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় টিনের ডিজাইন কিনতে পাওয়া যায়। ঘরগুলো জমির উপর দাড় করাতে ব্যবহার করা হয় সিমেন্ট ও লোহার খাম্বা। সেগুলোও তারা নিজেরা তৈরি করেন। এরপর একটি পূর্নাঙ্গ ঘর রেডি করতে আরেক দফা কাজ করেন শ্রমিকরা। ঘর নির্মাণে গোপালগঞ্জ জেলার শ্রমিকদের আলাদা চাহিদা রয়েছে মুন্সিগঞ্জে।
এসব এলাকায় প্রতিমাসে ৪-৫ টি ঘর বিক্রি হয়। একেকজন ব্যবসায়ী ১০-১৫ বছর যাবৎ রয়েছেন এই ব্যবসায়। তারা বলছেন, করোনার প্রভাবে তাদের বিক্রি কমেছে। সরকারের কাছে সহজ শর্তে রিনের ব্যবস্থার দাবি তাদের।
এই রেডিমেড ঘরগুলো যারা কিনতে চান তারা ঘর ব্যবসায়ীদের সাথে দুই ধরনের চুক্তি করতে পারেন। তারা তাদের নিজস্ব খরচে ঘরগুলো খুলে নিয়ে পৌছে দিয়ে আপনার দেখানো জায়গায় বসিয়ে দিবে অথবা আপনি কিনে নেয়ার পর নিজের খরচেও বসিয়ে নিতে পারবেন।
মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বজ্রযোগিনী ইউনিয়নের এলাকার ঘর ব্যবসায়ী, আওলাদ ট্রেডার্স এর মালিক আওলাদ মৃধা জানান, তিনি ১৪-১৫ বছর যাবৎ এই পেশায় রয়েছেন। তার এখানে তেইশ ঘর, আই তেইশ, টব, নাক-টিন মডেলের ঘর রয়েছে। এসব ঘরে ৩২-৩৪-৪২ ও ৪৮ মিলিমিটারের টিন ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া তিনি অর্ডার অনুযায়ী ঘর বানিয়ে দেন। ঘরে ব্যবহৃত কাঠগুলো নাইজেরিয়া দেশের। চট্রগ্রাম থেকে বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে গাছ কিনে আনেন মুন্সিগঞ্জের কাঠ ব্যবসায়ীরা। এরপর ব্যবসায়ীদের চাহিদানুযায়ী সেগুলো সাইজ করে বিক্রি করেন তারা। কাঠের উপর ডিজাইন করেন নকশি মিস্ত্রিরা। টিনের উপর নকশা কিনে আনেন ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে।
একই এলাকার ঘর ব্যবসায়ী ইসলাম মৃধা জানান, প্রতিমাসে তিনি ৮-১০ টি ঘর বিক্রি করেন। ৩ লাখ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা দামের রেডিমেড ঘর আছে তার এখানে।
ঘর ব্যবসায়ী স্বপন ঘর বিতান এর মালিক মো. স্বপন জানান, তিনি চূড়াইন এলাকায় ৮ বছর যাবৎ ঘরের ব্যবসা করেন। প্রতি মাসে ৪-৫ টি ঘর বিক্রি হয়। ৫-৬ লাখ টাকা দামের ঘর আছে তার এখানে।
সদর উপজেলার ধলাগাও এলাকার কথামনি ঘর বিতান এর মালিক আব্দুর রহমান জানান, তার এখানে সবসময় ১৫-১৬ টি ঘর রেডি করা থাকে। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতির কারনে ঘর বিক্রি কম হচ্ছে। তার এখানে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে সাড়ে ৬ লাখ টাকা দামের ঘর আছে।
ঘরমিস্ত্রি নিহার বালা জানান, ৩ বছর যাবৎ তিনি মুন্সিগঞ্জে কাজ করেন। তিনি মিস্ত্রি কাজ করেন ৬-৭ বছর যাবৎ। আগে তিনি মুন্সিগঞ্জের টংগিবাড়ী উপজেলায় কাজ করতেন।
কাঠ মিস্ত্রি মনোজ বৈরাগি জানান, ঘর বানানো মিস্ত্রির মধ্যে গোপালগঞ্জ জেলার মিস্ত্রি বেশি। তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বেশি। মুন্সিগঞ্জে যারা ঘর নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন তাদের বেশিরভাগ গোপালগঞ্জের।
ঘর নকশা ডিজাইন মিস্ত্রি মোহাম্মদ ইমন জানান, ১৪ বছর যাবৎ তিনি কাঠের উপর নকশা করার কাজ করেন। তার হাতে নকশা করা ১ হাজার ঘর রয়েছে। এই কাজে তার পরিবারের আরও ৫ জন সদস্য যুক্ত আছে। তার ডিজাইন করা ঘরে মানুষ শখ করে থাকছেন এ বিষয়টি ভেবে তিনি বিশেষ অনুভূতি পান।
সুমন সরকার নামের একজন ঘড়ের ক্রেতা বলছেন, মুন্সিগঞ্জের মানুষ শখ করে বিল্ডিং না করে রেডিমেড ঘর কিনে বসবাস করছে। এই ঘরে থাকার আলাদা শান্তি আছে।