মুন্সিগঞ্জ, ১৬ এপ্রিল ২০২৩, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)
বাংলা নববর্ষের আগমনকে ঘিরে দুইদিনব্যাপী জমজমাট গলুইয়া উৎসব হয়ে গেল পদ্মাপাড়ে।
প্রাচীন বিক্রমপুর অর্থাৎ বর্তমান মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার ঝাউটিয়া এলাকায় দুইশো বছর ধরে পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে এই উৎসব চলছে। স্থানীয়ভাবে এই আয়োজনকে গলুইয়া ডাকা হয়। যার আধুনিক নাম মেলা।
গলুইয়া উৎসব এই অঞ্চলের মানুষের মাঝে নিয়ে আসছে নতুন বছরের আগমন বার্তা।
বিশেষ উপায়ে চড়ক গাছের মাথায় বাঁশ আটকে মেলার মাঠে মাটিতে গাছটিকে পুতে দেয়া হয়। এরপর শুরু হয় চড়ক পূজা। নবজাতক বা শিশুদের চড়ক গাছে ছোয়ালে নতুন বছরে কোন অমঙ্গল তাদের ছুতে পারে না- এই বিশ্বাস রয়েছে অনেকের। চড়ক পূজাকে ঘিরে এলাকাটি হয়ে উঠে উৎসবমুখর। দুই দিনব্যাপী এই প্রাচীণ গ্রামীণ মেলায় স্থানীয় পাঁচ থেকে দশ হাজার মানুষ অংশ নেন।
মেলার আয়োজকরা জানান, পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে দুই দিনব্যাপী গলুইয়া হয়। আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে রঙ-বেরঙের পোষাকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল বয়সী নারী-পুরুষ অংশ নেন এখানে। উৎসবকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেলবন্ধন ঘটে। মেলার প্রধান আকর্ষণ চড়ক পূজা। এছাড়া শিব পার্বতীর পালা গেয়ে আয়োজকরা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ান। পহেলা বৈশাখের দিন হিন্দু ধর্মালম্বীরা গণেশ পূজা পালন করেন। আর মুসলিম ধর্মালম্বীরা হালখাতা ও মিলাদের আয়োজন করেন।
সাহিত্যিক ও গবেষক যোগেন্দ্রনাথ গুপ্তের বিক্রমপুরের ইতিহাস বইতে প্রাচীণ এই গলুইয়া উৎসবের ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তর উল্লেখ রয়েছে।
গলুইয়া আয়োজক কমিটির সভাপতি প্রদীপ কুমার দাস বলেন, ঝাউটিয়া এলাকার এই উৎসবটি ঐতিহাসিক উৎসব। প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়ে থাকে। আগে মেলার পরিধি অনেক বড় ছিলো, পদ্মা নদীতে গ্রামটির বেশিরভাগ অংশ নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়ায় এলাকাটি ছোট হয়ে গেছে। তারপরও বংশ পরম্পরায় আমরা যারা আছি তারা আয়োজনটি ধরে রেখেছি।
অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পলাশ কুমার দে বলেন, বিক্রমপুর একটি প্রাচীণ অঞ্চল। কালের বিবর্তনে এই অঞ্চলের বহু ঐতিহ্য বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ঝাউটিয়া এলাকার গলুইয়া ২০০ বছরের পুরোনো উৎসব। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এটি ধরে রেখেছে স্থানীয়রা। নদীভাঙনে উৎসবের আকার ছোট হয়ে আসছে। উৎসবটিকে প্রাচীণ উৎসবের স্বীকৃতি দিয়ে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আরও এগিয়ে নেয়া উচিৎ।
স্থানীয় ইউপি সদস্য পুলীন সরকার জানান, প্রায় দুইশো বছর ধরে পদ্মা পাড়ের ঝাউটিয়া এলাকায় হিন্দু ধর্মালম্বীরা নিজেদের উদ্যোগে এই মেলার আয়োজন করেন। বংশ পরম্পরায় এখনো সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন তারা। মেলা ঘিরে আগে ঘুড়ি উৎসব, পুতুল নাচ, পালার আসর, জারি-সারি, ঘেটু গান, আয়োজন হতো। বায়োস্কোপ-নাগরদোলার আয়োজনও দেখা যেত। এখন এসব আয়োজন নানা কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে মেলায় মাটির তৈরি হাড়ি পাতিল, খেলনা, মেয়েদের চুড়ি- লাল ফিতা ইত্যাদি পাওয়া যায়। তবে আয়োজকদের প্রচেষ্টায় কোন অপসংস্কৃতি গ্রাস করতে পারেনি মেলাটিকে। কারা মেলার আয়োজক হবেন তা নিয়েও আগে প্রতিযোগিতা ছিলো। এখন পদ্মার ভাঙনে গ্রামটির অর্ধেকের বেশি অংশ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। তাই মেলার আকার একেবারে ছোট হয়ে এসেছে। তাছাড়া আধুনিকতার প্রভাব তো রয়েছেই।
স্থানীয় সাংবাদিক অলক কুমার মিত্র জানান, বাংলা নববর্ষ ও পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে একসময় পদ্মা পাড়ের লৌহজং উপজেলায় চৈত্রের শেষ দিন শুরু হয়ে দুই-তিন দিন ব্যাপী ধারাবাহিকভাবে ৫-৬ টি স্থানে মেলা বসতো। এর মধ্যে কয়েকটি বন্ধ হয়ে গেছে, কয়েকটি সীমিত আকারে চালু রয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাব, ব্যক্তি উদ্যোগে অনাগ্রহ ও আধুনিকতার প্রভাবে মেলার আয়োজন কমেছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, এর মধ্যেও কিছু সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও মুষ্টিকয়েক ব্যক্তি নিজেদের আগ্রহে মেলার আয়োজন ধরে রেখেছে। ঝাউটিয়া এলাকায় দুইশো বছরের প্রাচীণ যে মেলাটি হতো সেটিও আগেরমত উৎসবমুখর নেই। আগে এলাকাটিতে অনেক হিন্দু ব্যবসায়ীর আড়ৎ ছিলো। এখন তা নেই।
স্থানীয় অনয় হাসান বেপারি বলেন, আরও ১৮-১৯ বছর আগে ঝাউটিয়ার মেলাটি খুবই জাকজমকপূর্ণ ছিলো। নদীভাঙনে সেই চিত্র বদলালেও এখনো ছোট আয়োজনে মেলাটি অনুষ্ঠিত হয়। ছোটবেলায় এখানকার ঘুড়ি উৎসব দেখতে এলাকার সবাইকে নিয়ে ছুটে আসতাম।
লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল আউয়াল বলেন, ঝাউটিয়া এলাকায় দুইশো বছর ধরে একটি মেলা হয়। স্থানীয়দের কাছ থেকে এর ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে শুনেছি। তবে, নদী ভাঙনে এই গ্রামটির বেশিরভাগ অংশ বিলীন হয়ে মেলার আকার ছোট হয়ে এসেছে। মূলত স্থানীয়রাই নিজেদের উদ্যোগে সীমিত আকারে মেলার আয়োজন ধরে রেখেছেন। তারা প্রশাসনের সহযোগিতা চাইলে তাদের সাথে সমন্বয় করা হবে।