মুন্সিগঞ্জ, ৮ জুলাই, ২০২২, আবু জাফর আহমেদ মুকুল (আমার বিক্রমপুর)
গত ২৫ জুন যখন পদ্মা সেতু উদ্ধোধনের অনুষ্ঠানে মাওয়া রোড দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন রাস্তার চারপাশে রঙিন ব্যানার, বিলবোর্ড ও ফেস্টুনে সয়লাব। ব্যানার, বিলবোর্ড ও ফেস্টুনে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের ছবিটা ছোট করে স্থানীয় নেতার নিজের ছবিটা আকাশ সমান বড় করে লেখা মুন্সিগঞ্জ-বিক্রমপুরের মাটি ও মানুষের নেতা।
গাড়ির মধ্যে একজন আমাকে বলে ফেললেন, এই বড় বড় বিলবোর্ডগুলো স্থানীয় নেতাদের খুশি করার জন্য অনেক কোম্পানি ও ব্যবসায়ীগন বিনিয়োগ করেছেন।
৯০’এর দশকে দেখতাম তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার পোস্টারে মা, মাটি ও মানুষের নেতা লিখা থাকতো।
আসলে মাটি ও মানুষের নেতা বলতে আমরা কী বুঝি?
যে এলাকা ও এলাকার মানুষকে ধারন করে সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসেন। এখন কথা হলো কখন এগিয়ে আসবেন, জনগন সমস্যা চিহ্নিত করার আগে নাকি পড়ে?
একজন প্রকৃত মাটি ও মানুষের নেতা সর্বদা সমস্যা হবার পূর্বে সমাধানে জনগনের সাথ সম্পৃক্ত হয় যাকে ম্যানেজমেন্টের ভাষায় বলে প্রোএকটিভ লিডারশীপ বা সক্রিয় নেতৃত্ব আর যে সকল নেতা সমস্যা হবার পর সমাধানের চেষ্টা করেন তাকে বলে রিএকটিভ লিডারশীপ বা প্রতিক্রিয়াশীল নেতৃত্ব।
বৃটিশ বিরোধী অধিকাংশ নেতা ছিলেন বিক্রমপুরের তারা সক্রিয় নেতৃত্ব বাস্তবায়ন করেছেন। আর বর্তমান সময়ে সত্যিই বলতে কী বিক্রমপুরে এ ধরনের নেতা পাওয়া দুস্কর।
এখন যেন সেই ব্রিটিশ বিরোধী নেতাগনসহ বিক্রম আদিত্যের প্রতাপ বর্তমান বিক্রমপুরে পাওয়া যায় না।
শুধু পোস্টারে মাটি ও মানুষের লিখার চেয়ে কাজের মাধ্যমে মা ও মাটি মানুষের নেতা প্রমাণ করা এলাকার জন্য সবচেয়ে মঙ্গলজনক।
বঙ্গবন্ধুকে আমার দেখার সৌভাগ্য হয়নি কিন্তু বিভিন্ন বই পড়ে বঙ্গবন্ধুকে জানার চেষ্টা করেছি।
এসব কথা আমি পাই বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’য় যা সঙ্গত কারনে উল্লেখ করছি- “কৈশোর পার করতে না করতেই কৃষক-মজুরের সংগ্রামী জীবনই যেন তাঁকে রাজনীতিতে উসকে দিল। ছাত্রজীবনেই রাজনীতির বীজ ভালোমতো রোপিত হলো মনে, তখন থেকেই মেহনতি কৃষক-মজুরের পক্ষে শুরু হলো তাঁর অনন্য সংগ্রাম। আর জেলায় জেলায় গণসংযোগ, বক্তৃতা, মেহনতি মানুষকে জাগ্রত করার কাজে শেখ মুজিব হয়ে উঠলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী এক নাম। প্রিয় এক নেতা। বহু বছরের বঞ্চিত মাটিঘেঁষা মানুষের পক্ষে যেন নতুন এক আহ্বান।”
“তখনকার সময়ে একেক জেলার তৃণমূল দিনমজুর কৃষক অন্য জেলায় যেত ধান কাটতে। তারা তাদের মজুরি বাবদ যে ধান পেত তা নৌকায় করে নিয়ে ফিরত। তাদের বলা হতো দাওয়াল। পাকিস্থান হওয়ার পর মুসলিম লীগ সরকার দাওয়ালদের ধানের নৌকা আটকাতে শুরু করল। ধান সরকারি ভান্ডারে জমা না দিলে ধান ও নৌকা বাজেয়াপ্ত করার ঘোষণা এলো। শেখ মুজিব দাওয়ালদের পক্ষে আন্দোলন গড়ে তুললেন। জেলায় জেলায় সমাবেশ করে কৃষক-মজুরদের পক্ষে সাধারণ মানুষকে জাগিয়ে তুললেন।”
আমার জানামতে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙালির একমাত্র মাটি ও মানুষের মহান নেতা আর বর্তমান সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর আদর্শের দীক্ষিত। তিনি শত ব্যস্ততার মাঝেও মানুষের সুবিধা-অসুবিধা খোঁজ খবর রাখেন এবং প্রয়োজনে সাহায্য প্রদান করেন যা বিরল নেতৃত্বের মাইলফলক বটে।
গত দুই (২) বছর আগে মুন্সিগঞ্জ-১ আসনের তরুণ প্রজন্মের ইশতেহার বাস্তবায়ন নিয়ে মত-বিনিময় সভায় আমরা গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ এক ঝাঁক তরুণ মুন্সিগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্য মাহী বি চৌধুরির বারিধারায় কার্যালয়ে ্উপস্থিত হয়েছিলাম। আমি মত-বিনিময় সভায় প্রায় ১ ঘন্টা প্রেজেন্টেশন দিয়েছিলাম।
আমার মনে আছে সভায় উপস্থিত আমাদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মিহা আক্তার ষোলঘরসহ সকল বাস স্টপে রাস্তা পারাপারের জন্য ফুট ওভার ব্রিজ নির্মানের প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং তৎকালীন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. আল আমিন হুসাইন ঢাকা-শ্রীনগর সরাসরি বাস সার্ভিস চালুর দাবি জানিয়েছিলেন।
পাশাপাশি আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকা-ভাঙ্গা সরাসরি বাস যাবে তখন স্থানীয় বাসিন্দারা যাত্রী সেবা হতে বঞ্চিত হবে।
মুন্সিগঞ্জ-১ আসনের সংসদ মাহী বি চৌধুরি আমাদের কথা শুনে উনি বলেছিলেন বিষয়টি নিয়ে ঢাকা-১ আসনের সংসদ সদস্য সালমান এফ রহমানের সাথে বলবেন বলে জানিয়েছিলেন।
খোঁজ নিয়ে জানলাম, সংসদ সদস্য সালমান এফ রহমান ঠিকই ঢাকা-দোহার সরাসরি বিআরটিসি বাস সার্ভিস চালু করেছেন কিন্তু আমরা পারি নি।
কয়েক মাস পূর্বে কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের নবনির্মিত আধুনিক ডিজিটাল কার্যালয়ের উদ্বোধনকালে ভিডিও কনফারেন্সে কুমিল্লা বিভাগ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী, আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. ক. ম বাহারউদ্দিন বাহারের মিনিটে দশেকের কথোপকথন জনগনের পক্ষে তীব্র দাবি তুলেছিলেন যা সর্বত্র প্রশংসা পেয়েছিল।
আমার কাছে এ কথোপকথনে মনে হয়েছে এখনো রাজনীতিতে নেতা-কর্মীর সম্পর্ক শেষ হয়নি। এখনো এখান থেকে নেতা-কর্মীদের শেখার আছে। নিজেকে তৈরি করার সুযোগ আছে। এখনো দলের নেতার সঙ্গে তৃণমূল নেতা যে আর্গুমেন্ট বা নিজের এলাকার স্বার্থে বা মাঠকর্মীদের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে যুক্তিতর্ক নির্ভয়ে করা যায় তার চিত্র হারিয়ে যায়নি।
নেতৃত্বের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা নিঃশর্ত আনুগত্য ও আবেগ-অনুভূতি রেখে ব্যক্তিত্ব নিয়ে যে কথা বলা যায় দেশবাসীর সামনে তা সেদিন দৃশ্যমান হয়েছে।
একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, দলের সভানেত্রীও যে তাঁর তৃণমূলের একজন পোড় খাওয়া নেতাকে গভীর স্নেহে তার বক্তব্য আবদার ও যুক্তি উপস্থাপন করার সুযোগ দিয়ে ধৈর্যের সঙ্গে শুনে জবাব দেন পাল্টা যুক্তিতে, তাও পরিষ্কার হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকে তাঁর নেতা সোহরাওয়ার্দী যেমন যুক্তিতর্ক করতে দিতেন তেমনি তিনিও নেতা-কর্মীর কথা শুনতেন। নেতা-সংগঠক তৈরি করতেন, বঙ্গবন্ধু কন্যাও দেন।
অত্যন্ত বিনয় ও শ্রদ্ধার সাথে বলছি, বর্তমান সরকারের সময়ে বিক্রমপুরের কোন নেতা এলাকার মানুষের পক্ষে এ ধরনের দাবির ধারে কাছেও যেতে পারেন নি।
যার ফলে বিক্রমপুরে প্রচলিত উন্নয়ন হয়েছে কিন্তু তৃনমূল লেভেলের উন্নয়ন, নেতা-কর্মীর সম্পর্ক বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
এমনকি আমাদের পাশের ঢাকা-১ এর সংসদ সদস্য সালমান এফ রহমান প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পদ্মা তীরে মেরিন ড্রাইভ অনুমোদন করে এলাকায় প্রশংসিত হয়েছেন।
বিক্রমপুর তথা মুন্সিগঞ্জে প্রাতিষ্ঠানিকসহ অবকাঠামো উন্নয়নে এমন নেতৃত্ব দরকার যেখানে সকল জনগনের সাথে সম্পৃক্ত হবে এবং কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ.ক.ম বাহারউদ্দিন বাহার ও ঢাকা-১ আসনের সংসদ সদস্য সালমান এফ রহমানের মতো দৃঢ় নেতৃত্ব মনোবল থাকবে।
কুমিল্লার বাহার বললেই যেমন তাকে সারা দেশ চেনে। ঐতিহ্যবাহী আওয়ামী লীগের ব্র্যান্ড নেইম সে। এদের মন্ত্রীও হতে হয় না। পদ-পদবিরও প্রয়োজন পড়ে না কখনো।
কুমিল্লার মতো আমাদের বিক্রমপুরে এমন বাহার দরকার যিনি সমস্যা সমাধানের কেন্দ্রবিন্দুতে সামনে এসে নেতৃত্ব প্রদান করবেন।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে বিক্রমপুর তথা মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান-শ্রীনগর ও লৌহজং উপজেলার কোন যাত্রী তুলছে না এবং তুললেও কেউ উঠে পরলে ভাড়া গুনতে হচ্ছে ঢাকা-ভাঙা রুটের।
পাশাপাশি উল্টোপথে কোন বাস স্টপে গাড়ী থামছে না যার ফলে লাখ লাখ যাত্রী ভোগান্তিতে পড়েছেন। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র বইছে ক্ষোভের বহি:প্রকাশ।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কর্মরত ডাক্তার রাশেদুল হাসান লিখেছেন, ”আমার গন্তব্য ঢাকা থেকে শ্রীনগর, কিন্তু কোন বাসই শ্রীনগরের যাত্রী উঠাচ্ছে না। তাই বাধ্য হয়ে ২৫০ টাকায় ভাঙার ভাড়া দিয়ে শ্রীনগর এসে নামলাম।”
একটি বিষয় বুঝতে হবে, ৭০ টাকার ভাড়া যাত্রীগন শখের বষে ২৫০ টাকা দিচ্ছে না, দিচ্ছে বাধ্য হয়ে। এ বিষয়টি নিয়ে যাদের মাথা ঘামানোর কথা তারা মাথা ঘামাচ্ছে না। অনেকে হয়তো ভাবছেন আমারতো প্রাইভেট কার আছে সমস্যা কোথায়?
এই মনোভাব থাকলে আপনি নেতা হলে স্বার্থবাদী নেতা আর সাধারন মানুষ হলে আপনার দ্বারা এলাকার কোন কাজ হবে না। একজন দায়িত্বশীল লোক যখন দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দেয় তখন জনগন তা মেনে নিতে পারে না। একজন জনপ্রতিনিধি জনবিছিন্ন হলে তার মূল্য থাকে না।
জনগন একদিন তার অধিকার ঠিক ফিরে পায় কিন্তু ক্রান্তিলগ্নে যে সমাধানে নেতৃত্ব প্রদান করে তাকে জনগন মনে প্রানে মাটি ও মানুষের নেতা ভাবে ঠিক যেভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার নেতৃত্ব প্রদান করে মাটি ও মানুষের নেতা হয়েছিলেন।
আমার জন্ম বিক্রমপুরে এবং ছেলেবেলার স্কুল জীবন আমার কেটেছে স্থানীয় এলাকায়। তাই এখন ঢাকায় থাকলেও আবেগের বিক্রমপুরের মানুষের অধিকার বঞ্চনা আমাকে ভীষনভাবে ব্যথিত করে।
প্রকৃতপক্ষে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে পরিবহন মালিকদের সেচ্ছাচারিতায় সরকারের সফলতায় বিক্রমপুরের সিরাজদিখান-শ্রীনগর ও লৌহজং এই তিন (৩) উপজেলার জনগন যাত্রী সেবা থেকে বঞ্চিত করেছে। যাত্রীদের এই দুর্ভোগ নিয়ে সরকার দলীয় নেতৃবৃন্দ ও প্রশাসনের ভূমিকায় প্রশ্ন দেখা দিলেও কার্যত কেউ সংকটের সমাধান করছেন না।
সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এগিয়ে যাক প্রাণের বিক্রমপুর। আমি বিশ্বাস করি, বিক্রমপুর এগিয়ে গেলে, এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ম্যানেজমেন্ট এন্ড ফাইন্যান্স বিভাগ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা এবং গবেষণায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ফেলোশীপ প্রাপ্ত।