আব্বার কাছ থেকে সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি পেয়েছি তা হলো— স্বাধীনতা। ছোটবেলা থেকেই এটি পেয়েছি। ফলে নিজের ভালো লাগা, মন্দ লাগা, সব ধরনের সিদ্ধান্ত নিজের মতো করে নিতে পেরেছি। আব্বা আমাদের কোনো কাজে কখনো বাধা দিতেন না। যেমন: আমি নামাজ পড়ি। সবসময়ই পড়তাম। কিন্তু আব্বা কখনোই প্রশ্ন করতেন না—‘তুমি কেন নামাজ পড়?’ তিনি সবসময়ই আমাদের ব্যক্তি স্বাধীনতা দিয়েছেন। এখন আমি মধ্যবয়সী। বর্তমানে যেসব নারী আমার বয়সী তাদের অনেকেই নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারেন না। অন্যের উপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সেটা হয় না। এজন্য আমি আব্বার কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। আব্বার খারাপ গুণ যদি বলি, তিনি প্রচণ্ড রাগি ছিলেন। তাকে আমরা খুব ভয় পেতাম।
আব্বার যারা ছাত্রছাত্রী ছিলেন, বিশেষ করে মেয়ে শিক্ষার্থী; তারা বর্তমানে অনেক বড় বড় পজিশনে আছেন। আব্বা সবসময় চাইতেন মেয়েরা ভালো কিছু করুক। আব্বার এই চাওয়ার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে— এটা ভাবতে ভালো লাগে। আমাদের ভাই-বোনদের ক্ষেত্রেও আব্বা চাইতেন তার মেয়েরা যাতে ভালো চাকরি করে, স্বাবলম্বী হয়। তখন আমার বয়স খুব কম ছিল। তাই বিষয়গুলো বুঝতে পারতাম না, এখন গভীরভাবে উপলব্ধি করি। আসলে আব্বা যখন বেঁচে ছিলেন তখন অনেক কিছুই বুঝতে পারতাম না। আমার মনে হয়, এখন আব্বাকে বেশি উপলব্ধি করতে পারি। আব্বাকে মানুষ সম্মান করেন। তার সন্তান হিসেবে মানুষ আমাকে স্নেহ করেন, সম্মান করেন কিংবা ভালোবাসেন। আমি তার সন্তান হিসেবে গর্বিত ও সম্মানিত বোধ করি।
সব বাবারা যেমন আমার আব্বাও তেমন ছিলেন। তিনি কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। লেখক ছিলেন বলে সবসময় বাইরে বাইরে সময় কাটাতেন এমনটা করতে তাকে কখনো দেখিনি। তবে সবসময় পড়াশোনার বিষয়টিকে তিনি গুরুত্ব দিতেন। কারণ আব্বা সবসময় চাইতেন আমরা দুই বোন যাতে চাকরি করি, স্বাবলম্বী হই।
আব্বা ‘তারকা’ ছিলেন। ছোটবেলায় দেখেছি, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আব্বাকে নিয়মিত সাক্ষাৎকার দিতে হতো। মিডিয়ার সামনে আব্বার এসব কাজ দেখে একবার বলেছিলাম— বড় হয়ে আমি সেলিব্রেটিকে বিয়ে করব। শুনে আব্বা বলেছিলেন, ‘এই চিন্তা কখনো করো না। বরং মাথায় চিন্তা রাখো— তুমি সেলিব্রেটি হবে।’ বিষয়টি এখন বুঝি, তখন বুঝতাম না। বরং ভাবতাম, তারকার বউ হতে পারলে তো ভালো। আব্বার এই কথাগুলো এখনো মাঝেমধ্যে মাথায় ঘুরপাক খায়।
হুমায়ুন আজাদ শুধু আমার আব্বা নন, তিনি একজন শিক্ষক ছিলেন। দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি যে, বর্তমানে তার মতো শিক্ষক আমি দেখি না। তিনি আপাদমস্তক একজন শিক্ষক, একজন লেখক ছিলেন। পেশাগত বা ব্যক্তিগত জীবনে কোনোরকম পদ-পদবীর জন্য তাকে কখনো লালায়িত হতে দেখিনি। কোনো কিছু পাওয়ার জন্য কারো কাছে গিয়ে চাওয়া, তদবির এ জাতীয় কোনো কাজ তাকে করতে দেখিনি। কিন্তু এখন শিক্ষকদের একটু ভিন্ন মনে হয়।
আব্বা স্বভাবে স্পষ্টবাদী ছিলেন। এটা আমাকে ভাবাতো। আমি আব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, অনেক সম্মানিত ব্যক্তিদের মুখের উপর তুমি কথা বলে ফেলো। এটা তুমি কীভাবে পারো? আব্বা বলেছিলেন, ‘মৌলি, কখনো কারো কাছে আমার কিছু চাওয়ার নাই। আমি যা কিছু করব তা নিজের যোগ্যতায় করব। সুতরাং আমি কাউকে তোয়াক্কা করি না।’ এসব কথাও এখন আমি ভাবি। বর্তমানে আমরা যা কিছু করি তা অনেক ভেবেচিন্তে করি। কারণ আমার মনে হয়, আমাদের সবারই কোথাও না কোথাও কোনো স্বার্থ আছে। অথবা আমরা তার (হুমায়ুন আজাদ) মতো অতটা যোগ্য নই। তিনি যোগ্য ছিলেন বলেই তার কাউকে লাগত না। আমি হুমায়ুন আজাদের মেয়ে। কিন্তু আমি তার মতো সাহসী না। সমাজ ও পারিপার্শ্বিকতাসহ বিভিন্ন কারণে তার মতো সাহসী হতে পারিনি।
আব্বা পিএইচডি ডিগ্রি দেশের বাইরে থেকে নিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে বিদেশমুখী চিন্তা তার ছিল না। বিদেশের কোনো গল্প তার মুখ থেকে কখনো শুনিনি। তার প্রিয় স্থান ছিল রাঢ়িখালের গ্রাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও একুশে বইমেলা। আব্বা রাষ্ট্রীয় নানা অনুষ্ঠানে যাওয়ার দাওয়াত পেতেন কিন্তু কখনো এসব অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দেখিনি। না যাওয়ার কারণ হিসেবে আব্বা জানিয়েছিলেন, সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষের সঙ্গে মিশতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। তবে তরুণ কিংবা সাংবাদিকদের সঙ্গে মিশতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন এবং উপভোগ করেন। আমি দেখেছি, সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে চা পান করতে করতে ফোনের (ল্যান্ড ফোন) কাছে বসতেন। এরপর বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে ফোন আসতে শুরু করত। বিশেষ করে যখন কোনো ঘটনা ঘটত তখন সাংবাদিকরা মন্তব্যের জন্য ফোন করতেন। এখনো যখন দেশে বিভিন্ন ঘটনা ঘটে তখন আব্বাকে ভীষণ ফিল করি। ভাবি, আব্বা বেঁচে থাকলে হয়তো অনেক কিছু বলতেন। যা এখন অনেক বুদ্ধিজীবীই বলেন না।
আমার লেখা প্রথম বই ‘হুমায়ুন আজাদ আমার বাবা’। ২০১১ সালে বইটি প্রকাশিত হয়। আর আব্বা মারা যান ২০০৪ সালে। স্বাভাবিক কারণেই তিনি আমার লেখা বই পড়ে যেতে পারেননি। বিষয়টি নিয়ে আক্ষেপ রয়েই গেছে। যদিও এমন অনেক আক্ষেপ রয়েছে। কারণ আব্বা যখন মারা যান তখন আমি মাস্টার্সে পড়ি। আমার ছোট ভাই-বোনেরা তো অনেক ছোট। সুতরাং ওই অর্থে তিনি আমাদের কিছুই দেখে যেতে পারেননি। আমাদের পারিবারিক জীবন, পেশাগত জীবন কোনো কিছুই তিনি দেখে যেতে পারেননি। আব্বাকে নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। স্মারকগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তারপরও আব্বার যারা ভক্ত তারা ফোন করে বলতেন, ‘নানাজন নানাভাবে আপনার বাবাকে নিয়ে লিখেছেন। কিন্তু আপনি তো তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন, সুতরাং আপনি তাকে নিয়ে বই লিখুন।’ তারপরই মূলত ‘হুমায়ুন আজাদ আমার বাবা’ বইটি লিখি। আমার লেখালেখিতে আব্বার লেখার প্রভাব আছে কি নেই এ নিয়ে প্রশ্ন আছে। এ বিষয়ে বলব, সেটা হয়তো আছে কিংবা নেই। আমার লেখা ‘প্রিয়ানা, চোখ ও ঝরনার জলে স্নাত এক প্রপাতের ফোয়ারা’ বইটি পড়ে একবার এক পাঠক আমাকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘‘হুমায়ুন আজাদ স্যারের লেখা ‘সবকিছু ভেঙে পড়ে’ বইটির প্রভাব আপনার এই বইতে রয়েছে।’’ কিন্তু আমি যখন লিখি তখন চাই না, আব্বার লেখার প্রভাব আমার লেখায় পড়ুক। আর আব্বার লেখায় যে সাহসীকতা ছিল সেটা দেখাতে পারছি না। আমার মনে হয়, এই সাহসীকতাটা দেশের বিখ্যাত লেখকরাও এখন দেখাতে পারবেন না।
আব্বাকে ছাড়াই ১৫টি বছর পার করে দিয়েছি। দীর্ঘ সময় কেটে গেলেও তার অনুপস্থিতি ভীষণভাবে মিস করি। আমরা সব ভাই-বোনই এখন স্বাবলম্বী। আব্বা বেঁচে থাকলে হয়তো তার জন্য আমরা এখন অনেক কিছু করতে পারতাম। তখন আমরা স্টুডেন্ট ছিলাম— স্বাভাবিক কারণেই আব্বা আমাদের দিয়ে গেছেন। কিন্তু আমরা আব্বার জন্য কিছু করতে পারিনি। আব্বা যখন মারা যান তখন ‘বাবা দিবস’ পালনের বিষয়টি এতটা গুরুত্ব পেত না। বাবা দিবস উপলক্ষে বাবাকে কখনো কোনো কিছু দেইনি। এখন তো তিনি নেই। তাই কিছু দেয়া বা তার জন্য কিছু করার সুযোগ আর নেই। বিষয়টি খুব খারাপ লাগে!
শ্রুতিলিখন: আমিনুল ইসলাম শান্ত