ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার চার দিন আগে অর্থাৎ ২৪ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জেল সুপার তৌহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে ট্রায়াল দেয়া হয়। বালির বস্তা দিয়ে চলে এই মহড়ার কাজ। মহড়ায় জল্লাদ শাহজাহান ভুঁইয়াসহ ১২ জল্লাদই অংশ নেয়। ফাঁসির মঞ্চে দুই ঘণ্টা ধরে এই মহড়া চলে। একদিনের মহড়ায় ৫ খুনির ফাঁসি কার্যকর বিষয়টি সম্পর্কে তাদের সঠিক ধারণা চূড়ান্ত করা হয়। ২৪ জানুয়ারি রাত ৯টা থেকে সাড়ে ৯টায় ৫ খুনি লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, লে. কর্নেল (অব.) মহিউদ্দিন আহমদ (আর্টিলারি), মেজর (অব.) একেএম মহিউদ্দিন (ল্যান্সার) ও মেজর (অব.) বজলুল হুদা কনডেমড সেলে স্বাভাবিকভাবে রাতের খাবার খেয়েছেন। এর আগে তাদের আত্মীয়-স্বজন দেখা করে যান। আত্মীয়-স্বজনকে বুঝতে দেয়া হয়নি ঐ রাতেই ৫ বন্দির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে। রাত সাড়ে ১০টায় কেন্দ্রীয় কারাগারে মসজিদের ইমাম হাফেজ মো. মনির হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে জেল সুপার ৫ খুনির কনডেমড সেলে যান। ঐ সময় ডিআইজি (প্রিজন) গোলাম হায়দার উপস্থিত ছিলেন। তখনই ৫ খুনি বুঝতে পারেন যে, তাদের ফাঁসি কার্যকর হবে। জেল সুপার তাদেরকে জানিয়ে দেন যে, এটাই আপনাদের শেষ রাত। এই রাতেই আপনাদের ফাঁসি কার্যকর করা হবে। এখন আপনাদের তওবা পড়তে হবে। ইমাম প্রথমে সৈয়দ ফারুক রহমানকে এবং পরে সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, একেএম মহিউদ্দিন (ল্যান্সার), বজলুল হুদা ও মহিউদ্দিন আহমেদকে (আর্টিলারি) তওবা পড়ান। তারা তওবা পড়েন ঠিকমত। এরপর তারা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। সাড়ে ১১টার মধ্যে তওবা পড়ার কাজ শেষ হয়।
জল্লাদ রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে সৈয়দ ফারুক রহমান ও সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানকে পিছনে হাত বেঁধে মুখে কালো টুপি পরায়। ফাঁসির মঞ্চের পাশে অতিথিদের জন্য সামিয়ানা টানিয়ে বসার ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে আইজি (প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশরাফুল ইসলাম খান, অতিরিক্ত আইজি (প্রিজন) কর্নেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন, ঢাকার জেলা প্রশাসক জিল্লার রহমান ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক অমিতাভ সরকার, মহানগর পুলিশ কমিশনার একেএম শহীদুল হক, ডিআইজি (প্রিজন) গোলাম হায়দার ও ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন (ঢাকা) ডা. মুশফিকুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। স্বরাষ্ট্র সচিব আব্দুস সোবহান সিকদার কারাগারে জেল সুপারের কক্ষে বসা ছিলেন। তিনি ফাঁসির মঞ্চের কাছে যাননি। রাত ১২টা ৫ মিনিটে সৈয়দ ফারুক রহমান ও সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানকে ফাঁসির মঞ্চে আনা হয়। তাদের গলায় রশি পরিয়ে দেয়া হয় এবং দুই পা বেঁধে ফেলা হয়।
জেল সুপার রুমাল হাতে নিয়ে ফাঁসির মঞ্চের কাছে দাঁড়িয়ে থাকেন। জল্লাদ তার রুমালের দিকে নজর রাখে। জেল সুপার রুমালটি নীচে ফেলে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে জল্লাদ ফাঁসির মঞ্চের লিভারে টান দেয়। সৈয়দ ফারুক রহমান ও সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের ফাঁসির মঞ্চের পাটাতন পায়ের নীচ থেকে সরে যায়। তাদের গলায় ফাঁসির রজ্জু চেপে বসে এবং দেহ ঝুলন্ত অবস্থায় ৮ থেকে ১০ ফুট নীচে গর্তে ঝুলে পড়ে। ১৫ মিনিট পর তাদের তোলা হয়। ডাক্তার তাদের মৃত বলে ঘোষণা করেন। এর আগে ডাক্তার (ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন) সৈয়দ ফারুক রহমান ও সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের ঘাড়ের চামড়া কেটে দেখেন তাদের গলার হাড় ভেঙ্গে গেছে কিনা। এই হাড় ভাঙ্গলেই মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হন ডাক্তার। তারপর তিনি দেহ পরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করেন। ১২টা ৩৫ মিনিটে একইভাবে একেএম মহিউদ্দিন (ল্যান্সার) ও বজলুল হুদাকে ফাঁসির মঞ্চে আনা হয়। একই কায়দায় তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। রাত ১টা ৫ মিনিটে সর্বশেষ মহিউদ্দিন আহমেদকে (আর্টিলারি) ফাঁসির মঞ্চে আনা হয়। তার ফাঁসিও একইভাবে কার্যকর করা হয়। জেল সুপার এই পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর করতে তিনটি রুমাল ব্যবহার করেন। মৃত্যুদন্ড কার্যকরের সামগ্রিক প্রক্রিয়া মাত্র ৪০ মিনিটের মধ্যেই সম্পন্ন হয়।
ফাঁসি কার্যকর করার পর ইমামের উপস্থিতিতে জল্লাদরা ৫ জন কাফন পরায় এবং কফিনবন্দি করে লাশ গ্রামের বাড়িতে নেয়ার জন্য প্রস্তুত করে দেয়। জেল সুপার তৌহিদুল আলম এর আগে ২০০৭ সালে কাশিমপুর কারাগারে ২টি ও ২০০৮ সালে একই কারাগারে ২টি ফাঁসি কার্যকর করেন। জাতির জনক ও তার পরিবারের সদস্যদের এসব ঘাতকের ফাঁসি কার্যকর করার বিষয়টি তার জীবনে স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে বলে তিনি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।