মুন্সিগঞ্জ, ২৯ মার্চ, ২০২২, আমিনুল ইসলাম মাছুম (আমার বিক্রমপুর)
মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার ভাগ্যকুল ইউনিয়নের রাঢ়ীখালের বালাশুরে অবস্থিত বিক্রমপুর জাদুঘর। জমিদার যদুনাথ বাবুর জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে ২০১৪ সালে জাদুঘরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে বাংলাদেশ সরকার।
জাদুঘরটি শীতকালে শনিবার থেকে বুধবার সকাল ৯টা থেকে ১টা এবং দুপুর ২টা থেকে বিকেল ৪টা পযর্ন্ত খোলা থাকে। বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক ছুটি আর শুক্রবার ২টা থেকে ৫টা পযর্ন্ত খোলা থাকে। কোন প্রবেশ মূল্য নেই।
শ্রীনগর উপজেলার ভাগ্যকুল ইউনিয়নের উত্তর বালাশুর গ্রামে জমিদার রাজা শ্রীনাথ রায়ের বাড়ি। এ পরিবারের সর্বশেষ জমিদার ছিলেন যদুনাথ রায়। জমিদার বাড়িতে আছে দু’শ’ বছর আগে নির্মিত মন্দিরসহ বিশাল বিশাল পুরাতন ভবন। জমিদার যদুনাথ রায়ের এ বাড়িটির স্মৃতি রক্ষার্থে প্রায় সাড়ে ১৩ একর জায়গা জুড়ে অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ও সরকারি অর্থায়ণে নির্মান করা হয়েছে জাদুঘর, গেস্ট হাউজ, থিমপার্ক।
শ্রীনগরের রঘুরামপুর ও নাটেশ্বর গ্রামে অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ শুরু হয়। এসব খননে পাওয়া গেছে বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। একশ’টির মতো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে জাদুঘরটি।
তিনতলা ভবনের জাদুঘরের মূল ফটকের দু’পাশে রয়েছে দু’টি বড় মাটির পাতিল। নিচতলার বাঁ পাশের গ্যালারিটি জমিদার যদুনাথ রায়ের নামে। এ জাদুঘরে রয়েছে বিক্রমপুরের প্রাচীন মানচিত্র, এখানকার বিভিন্ন প্রত্নসামগ্রীর আলোকচিত্র, বৌদ্ধবিহার, হযরত বাবা আদম (রা.) শহীদ মসজিদ, ইদ্রাকপুর কেল্লা, অতীশ দীপঙ্করের পরিচিতিমূলক আলোকচিত্র। এছাড়া জাতীয় জাদুঘর, বরেন্দ্র জাদুঘর ও কলকাতা জাদুঘরে সংরক্ষিত কষ্টিপাথরের মূর্তিগুলোর আলোকচিত্র। এখানে রয়েছে রঘুরামপুর, নাটেশ্বরসহ বিক্রমপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে পাওয়া পোড়ামাটির নল, মাটির পাত্র, পোড়ামাটির খেলনাসহ প্রত্নতাত্ত্বিক বিভিন্ন নিদর্শন। বিক্রমপুরের বিভিন্ন মনীষীদের পরিচিতিসহ আলোকচিত্র, বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান, মঠ ও মন্দিরের আলোকচিত্র রয়েছে জাদুঘরে।
জাদুঘরের নিচতলার দু’টি কক্ষের নামকরণ করা হয়েছে আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু গ্যালারি ও জমিদার যদুনাথ রায় গ্যালারি। দ্বিতীয় তলার গ্যালারিটি মুক্তিযোদ্ধা গ্যালারি নামে নাম করণ করা হয়েছে। ২০১৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে এই জাদুঘর খুলে দেওয়া হয়।
বিক্রমপুর একটি প্রাচীন সমৃদ্ধ জনপদের নাম। অতীতে বিভিন্ন সময়ে বিক্রমপুর ছিল বঙ্গ ও সমতট রাজ্যের রাজধানী। প্রাচীন তাম্রলিপিতে একে শ্রীবিক্রমপুর-শ্রীমজ্জায় স্কন্ধাবারাৎ অথাৎ ভিক্টরি ক্যাম্প হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাচীনকালে ভিক্টরি ক্যাম্প আর সমার্থক ছিল মোগল আমলে বিক্রমপুর ভুক্তি সুবাহ বাঙলার একটি পরগণা। এক সময় বিক্রমপুর ফরিদপুর জেলার বিস্তৃত অঞ্চল নিয়ে গঠিত ছিল। তবে বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্গত পাঁচটি উপজেলাই কেবল বিক্রমপুর পরিচয় বহন করে। প্রাচীনকাল থেকেই বিক্রমপুর শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চায় উপমহাদেশের একটি পীঠস্থান হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে।
অনেকেরই ভুল ধারনা হতে পারে, বিক্রমপুরের প্রাচীন সভ্যতার প্রায় সব কীর্তি কীর্তিনাশা পদ্মাগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। প্রকৃতপক্ষে এই অঞ্চলে বিজ্ঞানসম্মত কোনও গবেষনা ও প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ না করেই দীর্ঘদিনের ভ্রান্ত ধারনা হয়ে আসছে। তবে অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন ২০১০ সালে এ অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান, খনন ও গবেষণার উদ্যোগ হাতে নেয়।
অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের সভাপতি ড. নূহ-উল-আলম লেলিনের উদ্যোগে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহযোগিতায় ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে জেলার রঘুরামপুরে খনন কাজ শুরু হয়। অধ্যাপক ড. সুফি মো¯াÍফিজুর রহমানের তত্বাবধানে জাহাঙ্গীরনগর ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক শিক্ষার্থী এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞগণ খনন কাজে অংশ গ্রহন করেন। দীর্ঘ কয়েক বছর ধারাবাহিক উৎখনন ও গবেষণার শ্রমসাধ্য সাধনার ফলে রঘুরামপুরে আবিস্কৃত হয় বৌদ্ধবিহারের আংশিক বিশেষ। বিক্রমপুর অঞ্চলে দশম শতাব্দীর যা কিনা এক হাজার বছরের আগের একটি বৌদ্ধবিহার আবিস্কার বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্ত্যন্ত স্মরণীয় ঘটনা। আবিস্কারটি বিক্রমপুরকে শুধু দেশে নয়, বিশ্বের ইতিহাসে নতুন করে জায়গা করে দেবে। কারণ বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনীর কীর্তিমান সন্তান ছিলেন অতিশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান (৯৮০-১০৫৪ খ্রিষ্টাব্দ) তিনি বিশ্ববিখ্যাত বৌদ্ধবিহার নালন্দায় অধ্যয়ন করেন। বৌদ্ধধর্মের অবক্ষয়রোধে রাজা চং ছপের বিশেষ আমন্ত্রণে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান চীনে গমন করেছিলেন। ১৬ বছর তিনি সেখানে অবস্থান করেন। তিব্বতিরা তাকে সম্মানসূচক হো-বো-জে মানে দ্বিতীয় বুদ্ধ, ভারতবর্ষ ধর্মপাল ও গোটা বিশ্বের বৌদ্ধ সম্প্রদায় মিলে দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান অতীশ উপাধিতে ভূষিত করেন। সদ্য আবিস্কৃত বৌদ্ধবিহারের খনন কাজ ও গবেষণা চলমান থাকলে এ সম্পর্কে আরও গুরুত্বপূর্ণ সূত্র আবিস্কৃত হবে। তারই ইঙ্গিত ইতোমধ্যে পাওয়া গেছে। রামপাল ও বজ্রেযোগিনীতে অনুসন্ধান ও খননে আরও বেশকিছু অমূল্য প্রত্নতাত্ত্বিক আবিস্কৃত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারনা করা হচ্ছে, সুখবাসপুর, মীরকাদিম, পঞ্চসার, নগর কসবা, সিপাহী পাড়া, দেওসার, সোনারং, টংগিবাড়ির নাটেশ্বর প্রভৃতি গ্রাম নিয়ে প্রাচীন বিক্রমপুর নগর সুবিস্তৃত ছিল। এরই মধ্যে বিভিন্ন খনন কাজে মিলেছে প্রায় ৫ ফুট দৈর্ঘ্যের কালো পাথরের অক্ষত বৌদ্ধ দেবী মূর্তি, প্রাচীন নৌকা, দারু, ও মৃৎ-ভাস্কর্য, কাঠের অলঙ্কৃত স্তম্ভ ও মৃৎ-পাত্র ইত্যাদি। প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও সংরক্ষণ এবং গবেষণা কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন কাজ করে যাচ্ছে।
মুন্সিগঞ্জের যেসব গ্রাম ও জনপদ প্রচীন সমতট ও বঙ্গের রাজধানী হিসেবে চিহ্নিত সেসব এলাকায় পরিকল্পিত ও বিজ্ঞানসম্মত খনন ও অনুসন্ধান অব্যাহত রাখা জরুরী।
এরই ধারবাহিকতায় অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন শ্রীনগর শাখার উদ্যোগে রাঢ়ীখালের বালাশুরে বিক্রমপুর যাদুঘর খোলা হয়েছে। যাদুঘরে রাখা হয়েছে আবিস্কৃত সব প্রত্ন-নিদর্শন। বিক্রমপুরের গৌরবোজ্জ্বল প্রাচীন সভ্যতাকে তুলে ধরা হয়েছে। জনসাধারণের জন্য বিনামূল্যে যাদুঘর ঘুরে দেখার সুযোগ রয়েছে এখানে।